খরার প্রভাব : দেশজুড়ে ফসলহানির আশঙ্কা

খরার প্রভাব : দেশজুড়ে ফসলহানির আশঙ্কা

বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলে কিছুটা বৃষ্টি হলেও দেশের বিরাট এলাকাজুড়ে কার্যত এখন খরা পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এর প্রভাব পড়ার আশঙ্কা আছে কৃষিখাতে। বছরের শুরু থকেই আবহাওয়ার আচরণকেই স্বাভাবিক মনে করছেন না আবহাওয়াবিদরা। এর ফলে হয় টানা বৃষ্টি কিংবা টানা খরা পরিস্থিতির আশঙ্কা করা হচ্ছে।

এ বছর আবহাওয়ার যে পূর্বাভাস তাতে দেশের কিছু এলাকায় বৃষ্টিপাতও কম হতে পারে। আবার কিছু এলাকায় তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি কমতে পারে। কিন্তু বৃষ্টিপাত কম হলেও যেমন দেশের কৃষিতে এর প্রভাব পড়বে আবার অতিরিক্ত হলেও এর প্রভাব হবে নেতিবাচক। অর্থাৎ ফসলহানির মতো পরিস্থিতিও তৈরি হতে পারে।

উত্তরাঞ্চলের খরা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক চৌধুরী সারওয়ার জাহান।

তিনি বলছেন, বোরো ধানের মৌসুমে খরার কারণে অতিরিক্ত পানি সরবরাহ করতে হলে সেটি পরিবেশেও প্রভাব ফেলবে।

টানা বৃষ্টি বা খরার আশংকা-
আবহাওয়াবিদ বজলুর রশীদ বলছেন, চলতি বছরের শুরু থেকেই দেশের আবহাওয়া অস্বাভাবিক আচরণ করছে এবং এর বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণের কাজ এখন চলছে। এখন যে বৃষ্টি হওয়ার কথা সেটি হচ্ছে না, আবার বিস্ময়কর হলেও কোথাও কোথাও মাঝে মধ্যে শীতের আমেজ টের পাওয়া যায়।

আবহাওয়া অধিদফতরের রোববারের বিভাগীয় পূর্বভাস বলছে, সিলেট বিভাগে সর্বনিম্ন ২২ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা নামতে পারে, রংপুর বিভাগে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা হতে পারে ২৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত। অথচ বাদবাকী বিভাগগুলোর কোথাও সর্বনিম্ন ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে তাপমাত্রা নামার পূর্বাভাস নেই।

আবহাওয়াবিদ বজলুর রশীদ বলেন, ‘দেশের কোনো কোনো গণমাধ্যম খবর দিচ্ছে, রংপুরে কয়েকদিন ধরে শীত শীত অনভূতি হবার। এদিকে এখন আবার দেশজুড়ে শুষ্কতা বিরাজ করছে এবং এ সময়ে আবার যেমন বৃষ্টি হওয়ার কথা তেমনটা হচ্ছে না। কিন্তু ফেব্রুয়ারি মাসে এখনকার চাইতে কম বৃষ্টি হওয়ার কথা থাকলেও সে সময় স্বাভাবিকের চাইতে ৫০ শতাংশ বেশি বৃষ্টি হয়েছে। এমনকি ফেব্রুয়ারির প্রথম ও দ্বিতীয় সপ্তাহে কোথাও কোথাও কালবৈশাখীর মতো ঝড় এবং শিলাবৃষ্টি হয়েছে। অথচ ওই সময়ে এমন ঝড় হওয়ার কথা না। অন্যদিকে শিলার আকারও কিছুটা বড় রকমের ছিল। ওদিকে এখন সারাদেশে কিন্তু প্রত্যাশিত বৃষ্টি নেই। আবার হয়তো দেখা যাবে সাত থেকে আট দিন ধরে টানা বৃষ্টি হচ্ছে। আবার হয়তো কিছুদিন কোনো বৃষ্টিই হলো না।

এসব বিষয় নিয়ে রোববার ঢাকায় আবহাওয়া দফতরে একটি পর্যালোচনা বৈঠক হওয়ার কথাও রয়েছে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা। তবে তারা বলছেন ভারত মহাসাগরের অস্বাভাবিক অবস্থার প্রভাবেই এমনটি হচ্ছে। এর প্রভাব কতটা কেমন হবে তার বিভিন্ন দিক নিয়ে গবেষকরা বিশ্লেষণ করছেন। সেসব বিশ্লেষণও আবহাওয়া পরিস্থিতি নিয়ে আজকের বৈঠকে উঠে আসতে পারে।

হিটওয়েভ বা দাবদাহ: বাংলাদেশের প্রবণতা
বিশ্লেষকরা বলছেন যে, খরা পরিস্থিতি কোনো কারণে প্রলম্বিত হলে দেশে হিটওয়েভ বা দাবদাহ বয়ে যেতে পারে।

বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার মতে একটি জায়গার দৈনিক যে গড় তাপমাত্রা সেটি ৫ ডিগ্রি বেড়ে গেলে এবং সেটি পরপর পাঁচদিন চলমান থাকলে তাকে হিটওয়েভ বলা হয়। তবে অনেক দেশ এটিকে নিজের মতো করেও সংজ্ঞায়িত করেছে।

দেশের আবহাওয়া বিভাগে তাপমাত্রা বেড়ে ৩৬ থেকে ৩৮ ডিগ্রি হলে সেটিকে মৃদু হিটওয়েভ, ৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রি হলে মধ্যম মাত্রার হিটওয়েভ, ৪০ থেকে ৪২ডিগ্রি হলে তীব্র এবং ৪২ ডিগ্রির বেশি হল অতি তীব্র হিটওয়েভ হিসেবে বিবেচনা করে। সে হিসেবে বাংলাদেশে হিটওয়েভ বা দাবদাহ শুরু হয় ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে। তবে এটা আসলে পুরোটা নির্ভর করে শরীরে খাপ খাইয়ে নেয়ার সক্ষমতার ওপর।

গত বছর এক পর্যালোচনায় আবহাওয়া অধিদফতর দেখেছে যে, মধ্য মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ের মধ্য হিট বা তাপমাত্রা বাড়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।

রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি, জার্মান রেড ক্রস এবং বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতর পরিচালিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে তিনটি সময়কালে ভাগ করা হয়েছে-ঠাণ্ডা ও শুষ্ক অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি, মার্চ থেকে মে গরমকাল এবং জুন থেকে অক্টোবর মৌসুমি বৃষ্টিপাতের সময়।

এবারের অস্বাভাবিক আবহাওয়া কৃষিতে কেমন প্রভাব ফেলবে?
অধ্যাপক চৌধুরী সারওয়ার জাহান বলছেন, হিটওয়েভ বা দাবদাহ হলে সেটি কৃষি উৎপাদনে-পরাগায়ন থেকে শুরু করে একটি ফসলের প্রতিটি ধাপে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। আবহাওয়া এমন উদ্ভট হয়ে উঠলে কৃষিতে তার প্রভাব এড়ানো কঠিন। এখন যে অনাবৃষ্টি তারও প্রভাব পড়বে। আবার বিকল্প ব্যবস্থা নিতে গেলেও প্রভাব পড়ে। যেমন বোরো ধানের চাষ হবে। সেখানে খরার কারণে অতিরিক্ত পানি সরবরাহ করতে গেলে পরিবেশে প্রভাব পড়বে।

তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য আবহাওয়ার যে উদ্ভট আচরণ সেটা ক্রমশ দৃশ্যমান হচ্ছে গত কয়েক বছর ধরেই।

প্রসঙ্গত জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে যেসব দেশ ঝুঁকিতে পড়তে পারে বলে বহুদিন ধরে বিজ্ঞানীরা আশংকা প্রকাশ করছেন বাংলাদেশও তার একটি। এর ফলে অতিরিক্ত গরমের পাশাপাশি ভারি বৃষ্টি এবং ঝড়ের প্রকোপ অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকবে। ফলে জীবন এবং জীবিকা হুমকিতে পড়বে।

গরীব দেশগুলোতে এসব বিপদ মোকাবেলার সক্ষমতা কম বলে তাদের ওপর এই আবহাওয়ার ধাক্কা পড়বে সবচেয়ে বেশি।সূত্র : বিবিসি