‘আমগো আবার কীসের ঈদ’

‘আমগো আবার কীসের ঈদ’

ঈদ মানেই আনন্দ, ঈদ মানেই খুশি। ঈদ মানেই নতুন পোশাক পরে নামাজ পড়া, বড়দের কাছ থেকে সালামি আদায় করা, সেমাই-পায়েস খাওয়া, স্বজন-বন্ধুদের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া। পবিত্র মাহে রমজান শেষে মুসলিম সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় খুশির উৎসব পবিত্র ঈদুল ফিতর। ঈদকে ঘিরে আনন্দের আমেজ বিরাজ করলেও পথশিশুদের ঈদ নিয়ে নেই কোনও উচ্ছ্বাস।

পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্ক এবং সদরঘাট এলাকায় অন্তত দুই শতাধিক পথশিশুর বাস। রাস্তার আইল্যান্ডে, ভিক্টোরিয়া পার্কে অথবা ওভারব্রিজের ওপরে বছরের পর বছর শীত, গ্রীষ্ম বর্ষা উপেক্ষা করে থাকে তারা।

এদের কাছে ঈদ কিংবা আনন্দের কোনও মানে নেই। পেট ভরে দু'বেলা দু'মুঠো খেতে পারলেই এরা খুশি। পথশিশুরাও জানে ঈদ মানে খুশি, ঈদ মানে আনন্দ। ঈদ আসে, ঈদ যায়, কিন্তু সেই ঈদ কখনই তাদের জন্য উৎসব হয়ে ওঠে না।

সদরঘাট এলাকার ভবঘুরে বেলাল (১১) ও মরিয়ম (৬) দুই ভাই বোন। করোনার শুরুর দিকে তাদের মা হাছিনা বেগম করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এরপর থেকেই তারা পথে পথে ঘুরে বেড়ায়। নতুন করে তাদের ঠাঁই হয়েছে শাঁখারি বাজার ওভারব্রিজের ওপর।

ঈদ কেমন কাটছে জিজ্ঞাসা করতেই বলে উঠলো, আমাগো আবার কিসের ঈদ। আমাগো তো বাড়ি-ঘরই নাই। দুই বেলা ঠিক করে খাইতে পারি না। আবার ঈদের কেনা-কাটা কিসের। কোনওদিন একবেলা ভালো মন্দ খাইতে পারলেই শান্তি। তয় গত ঈদে মা মারা যাওয়ার পর এক বড়লোক সাহেব আমাগোরে নতুন জামা কাপড় কিন্না দিছে। এবার কিছু পাই নাই।

ভিক্টোরিয়া পার্ক নিকটবর্তী শাঁখারি বাজার ওভারব্রিজের ওপর আরেক ভবঘুরে স্বাধীনের (১২) বসবাস। দীর্ঘ ৫ বছর পুরান ঢাকার কোর্ট-কাচারি এরিয়াতেই সে থাকে। বাবা মা কে- তা জানা নেই। ছোটবেলা থেকেই এখানে সেখানে ঘুরে বেড়ায়। বন্ধুরা তার নাম দিয়েছে স্বাধীন। স্বাধীনের ঈদ নিয়ে কোনও আনন্দ নেই। স্বাধীন বলেন, কোনওদিন পেট ভরে বিরিয়ানি খেতে পারলেই ওইদিনই আমার ঈদ। আমার ঈদের লগে আপনাদের ঈদ মিলবে না ।

সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে শুয়ে আছে রোগাক্রান্ত হ্যাংলা পাতলা মাত্র তেরো বছরের পথশিশু আলিফ। তার ৪ ভাই বোন। বাবার নাম কবির মায়ের নাম নাজমা। মা মারা যাওয়ার পর বাবা আরেক বিয়ে করেন।

সৎ মায়ের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে আসে মাত্র ৬ বছর বয়সে। এখন তার বাসা বাড়ি বলতে লঞ্চ টার্মিনাল অথবা ভিক্টোরিয়া পার্ক। আলিফ ঈদ নিয়ে খুবই আনন্দিত। কারণ সে এই ঈদে নতুন জামা পেয়েছে। আলিফ বলেন, ঈদ এত দেরি করে আসে কেন? ঈদ আসলে নতুন জামা কাপড় পাওয়া যায় মানুষে ভালা ভালা খাওন দেই। অনেক মজা করি ঈদে।

কখনও চকলেট বিক্রি করে আবার মাঝেমধ্যে ভিক্ষাও করে মিতু (৮)। তবে মিতু ভবঘুরে কিংবা পথশিশু নয়। সে নদীর ওপারে বাবা-মায়ের সঙ্গে বসবাস করে। তার বাবার নাম দিলু মায়ের নাম পারুল।

বাবা প্যারালাইজড রোগী মা অন্যের বাসায় কাছ করে সংসার চালায়। দুই ভাই বোনের সংসারে মিতুও কিছুটা ভার বহন করার চেষ্টায় ছোটবেলা থেকেই ভিক্টোরিয়া পার্ক এলাকায়। মিতুর মন খারাপ কারণ মিতুর জন্য এবার তার মা নতুন জামা কিনে দেয়নি।

মিতু বলে, আমার নতুন জামা লাগবে না। চকলেট বেচে আর মানুষের কাছ থেকে যা পাবো তা দিয়ে আমি আমার বাবা মায়ের জন্য লুঙ্গি আর শাড়ি কিনবো। এতেই আমার ঈদ হয়ে যাবে।

পুরান ঢাকা জুড়ে মিতু, স্বাধীন আলিফের মতো এরকম অসংখ্য পথশিশু রয়েছে যাদের ঈদের আনন্দ বলতে কিছু নেই। পথে প্রান্তরে কাটে তাদের ঈদ। ঈদের আনন্দ যে শিশুদেরই ঘিরে তা কখনো ভবঘুরে এই পথশিশুরা উপলব্ধি করতে পারেনি। সেটা শুধু সচ্ছল- বিত্তবানদের মাঝেই দেখা যায়। তবে অন্য সব শিশুর মত ছিন্নমূল ভবঘুরে পথশিশুরাও ইদের আনন্দ উপভোগ করবে, আর ফিরে পাবে স্বাভাবিক জীবন, এমন প্রত্যাশা সবার।