ঢাকায় ফিরতে ভোগান্তি দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের

ঢাকায় ফিরতে ভোগান্তি দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের

অনেকটা স্বস্তিতেই ঢাকায় ফিরতে শুরু করেছেন প্রিয়জনের সাথে ঈদ করতে যাওয়া কর্মব্যস্ত মানুষ। রাস্তায় যানবাহন এবং মানুষের চাপ থাকলেও তা অসহনীয় হয়ে ওঠেনি। তবে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষের ভোগান্তি পিছু ছাড়েনি। পদ্মা নদী পার হতেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিতে হয়েছে ধু-ধু বালুচরে। রোদ-বৃষ্টির খেলায় প্রচণ্ড গরমে নাভিশ্বাস উঠেছে তাদের। এ দিকে ঢাকায় ফিরতে কয়েকগুণ ভাড়া গুনতে হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেছেন যাত্রীরা। বিশেষ করে লোকাল ও ভেঙে ভেঙে আসা যাত্রীরা চরম বিপদে পড়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন। তবুও অন্য যেকোনো বছরের তুলনায় এবারের ভোগান্তি অনেকটাই কম বলে জানিয়েছেন ঢাকায় ফিরে আসা এসব যাত্রী। কমলাপুরে ট্রেনে আসা যাত্রীদের চাপ থাকলেও শিডিউল বিপর্যয় বা অন্য কোনো ভোগান্তির অভিযোগ পাওয়া যায়নি। পরিবহন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ বছর ঈদের ছুটি দীর্ঘ হওয়ায় যাত্রীরা একই সময়ে মুভ করেননি, যার কারনে দুর্ভোগ অনেকটাই কম হয়েছে। গতকাল সকালে সদরঘাট টার্মিনালে ভেড়া লঞ্চগুলোতে খুব বেশি চাপ দেখা যায়নি। তবে শনিবার থেকে চাপ বৃদ্ধি পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কারণ বরিশাল-ভোলা থেকে বেশির ভাগ যাত্রী শুক্রবার বিকেল থেকে রওনা শুরু করবেন।

গতকাল সকাল ১০টা ৪৫ মিনিটে কমলাপুর রেলস্টেশনের ৫ নাম্বার প্লাটফর্মে এসে পৌঁছায় যমুনা এক্সপ্রেস। তারাকান্দি থেকে ছেড়ে আসা ট্রেনের প্রায় ১৫টি বগি থেকে ১০ মিনিট ধরে শুধু যাত্রীই নামেন। তাদের একজন ইলিয়াস হোসেন বলেন, করোনার কারণে গত দুই বছর বাবা-মায়ের কাছে ঈদ করতে যেতে পারিনি। এ বছর গিয়ে আর ফিরে আসতে ইচ্ছে করেনি; কিন্তু কিছু করার নেই, কাজ না করলে ওই প্রিয় বাবা-মায়ের মুখে আহার তুলে দেবো কিভাবে। তাই বাধ্য হয়ে আসতে হয়। তিনি বলেন, যাওয়ার সময়ে কিছুটা কষ্ট হলেও আসার সময় অনেকটাই কমফোর্ট ছিল। বেলা ১১টায় সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেসে আসা আফসানা নওরীন বলেন, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাজ করেন তিনি, একটি দিন বেশি কাটিয়ে আসার কোনো সুযোগ নেই। ঢাকায় ফিরতে যতটা কষ্ট সহ্য করার প্রস্তুতি নিয়ে আসছিলাম ততটা হয়নি, যা হয়েছে তা সহনীয়।

ফরিদপুর থেকে আসা ইমরান হোসেন বলেন, প্রাইভেট কারে শিশু সন্তানসহ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আসছি। বাংলাবাজার ফেরিঘাটে তিন ঘণ্টা অপেক্ষা করেও ফেরিতে উঠতে পারিনি। এ দিকে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িতে এসি চালাতে চায় না ভাড়া করা গাড়ির চালক। যার কারণে প্রচণ্ড গরমে অসুস্থ হয়ে পড়েছে আমার ছোট মেয়েটি। তার কান্না থামানো যাচ্ছিল না। তিনি অভিযোগ করে বলেন, ফেরির ঘাটতি ও ঘাটে চরম অব্যবস্থাপনার কারণে যাত্রীদের এই ভোগান্তি। ঘাট কর্তৃপক্ষের লোকজন ও নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যরা ভিআইপির দোহাই দিয়ে প্রতি গাড়ি থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে তাদের পার করে দিচ্ছে। আর যারা টাকা দিতে পারছেন না তারা পড়ে থাকছেন বিশাল আকৃতির মাঠের মধ্যে তৈরি করা খাঁচার ভেতরে। এ এমনই এক খাঁচা যেখানে একবার ঢুকলে আর ফিরে যাওয়া যায় না।

মাসুম আলী নামে অপর এক যাত্রী বলেন, ঘাটে এলে গাড়িগুলোকে বাঁশ ও রড দিয়ে তৈরি ওই খাঁচার ভেতরে ঢুকানো হয়। এরপর ধীরে ধীরে সে গুলো ফেরিঘাটের দিকে যায়; কিন্তু যে গাড়িগুলো পুলিশ ও ঘাট কর্তৃপক্ষের লোকদের টাকা দিয়ে খুশি করতে পারে তাদের গাড়ি আর খাঁচার ভেতের ঢোকানো হয় না। সেগুলোকে ভিআইপি সাজিয়ে বাইরে রাখা হয়। ঘাটে ফেরি এলে আগে ওই গাড়িগুলো ছাড়া হয়। এরপর ফেরি পূর্ণ হতে যদি চার-পাঁচটি গাড়ির প্রয়োজন হয় তাহলে ওই খাঁচায় আটকে রাখা গাড়িগুলো থেকে দু-একটি ছাড়া হয়। তিনি বলেন, এই ঘাটগুলোতে টাকার এই ঘটনা নতুন নয়। তবু আগে নেয়া হতো প্রাইভেট কার প্রতি ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। এর এখন ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকা।

আমাদের রাজবাড়ী প্রতিনিধি এম মনিরুজ্জামান জানান, দৌলতদিয়া দিয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় ঢাকার পথে সাড়ে ছয় হাজার যানবাহন, দুই লক্ষাধিক যাত্রী পার হয়েছে। গতকাল বেলা বাড়ার সাথে সাথে ঘাটে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে যাত্রী ও যানবাহনের চাপ। তবে বাসগুলোকে এক-দুই ঘণ্টা করে অপেক্ষা করতে হচ্ছে। তীব্র গরমে অতিষ্ঠ হয়ে অনেক যাত্রী বাস ছেড়ে দিয়ে হেঁটে ফেরি ও লঞ্চে উঠে নদী পার হচ্ছে। ফেরিঘাটে দালালরা ফেরি পারের জন্য নির্ধারিত ২৫ টাকা ভাড়ার বিপরীতে গত দুই দিন ধরে ৩৫-৪০ টাকা করে আদায় করছে। সাংবাদিকরা অভিযোগ করলে পরে পুলিশ চার দালালকে আটক করে।

বিআইডব্লিউটিসির ঘাট কর্র্তৃপক্ষ জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় প্রায় সাড়ে ছয় হাজার যানবাহন ও দুই লক্ষাধিক যাত্রী নদী পার হয়েছে। এর মধ্যে বাস ৮৮১টি, ট্রাক ৮১২টি, ছোট গাড়ি তিন হাজার ৮০৮টি। এ ছাড়া ৯৫৪টি মোটরসাইকেল পার হয়েছে। দৌলতদিয়া প্রান্তের দীর্ঘ ভোগান্তি ও অপেক্ষা ছাড়াই যাত্রীরা এবার ফেরি ও লঞ্চে উঠতে পারছেন। তবে অনেকসময় পন্টুনে ফেরির জন্য অপেক্ষায় থাকতেও দেখা গেছে যাত্রীদের। বিআইডব্লিউটিসি দৌলতদিয়া ঘাট ব্যবস্থাপক শিহাব উদ্দিন বলেন, যাত্রী ও যানবাহনের চাপ সামাল দিতে ২১টি ফেরির মধ্যে শুক্রবার ১৯টি চলাচল করছে। দু’টি ফেরি রেডি আছে, চাপ বাড়লে বহরে যোগ করা হবে।

সকাল ৬টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত ঘাটের জিরো পয়েন্ট থেকে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে ফেরি পারের অপেক্ষায় ছিল অর্ধশতাধিক যানবাহন। এসব দূরপাল্লার যাত্রীবাহী পরিবহন কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেই ফেরির দেখা পেয়েছিল। ফলে যাত্রী ও চালকদের তেমন ভোগান্তি পোহাতে হয়নি। কিন্তু বেলা বাড়ার সাথে সাথে দৌলতদিয়া ঘাট এলাকায় যাত্রী ও যানবাহনের চাপ বাড়তে শুরু করে। বেলা ১টার দিকে দৌলতদিয়া ফেরিঘাটের জিরো পয়েন্ট থেকে দৌলতদিয়া মডেল স্কুল পর্যন্ত দুই কিলোমিটার যাত্রীবাহী বাসের সারি দেখা যায়। সময় বাড়ার সাথে সাথে যানবাহনের এ সারি বাড়তে থাকে।

রাজবাড়ী থেকে ঢাকায় আসা লিয়াকত হোসেন জানান, লোকাল যাত্রীদের দৌলদিয়া ফেরিঘাটে খুব বেশি ভোগান্তি পোহাতে হয়নি। কিন্তু তাদের পকেট কেটেছে যানবাহনগুলো। রাজবাড়ী থেকে ঘাটে আসতে বাসভাড়া লাগে ৩০ টাকা করে। সেখানে গতকাল তাদের কাছ ৮০ টাকা করে ভাড়া নেয়া হয়েছে। এ ছাড়া পদ্মা পার হয়ে গাবতলী পৌঁছাতে যেখানে ১০০ টাকা ভাড়া লাগে, সেখানে লোকাল বাসগুলো প্রতি যাত্রীর কাছ থেকে ভাড়া নিয়েছে ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা করে। আর পাটুরিয়া টু গাবতলী পর্যন্ত সরাসরি চলাচলকারী বাসগুলো ১৫০ টাকার ভাড়া নিয়েছে ৪৫০ থেকে ৫০০ করে। তিনি বলেন, পাটুরিয়া থেকে ডি লিংক পরিবহনের বাসে ওঠেন তিনি। ১০০ টাকার ভাড়া ঠিক করা হয় ৩০০ টাকা। কিন্তু মাঝপথে এসে বাস থামিয়ে দেয় তারা। বলে, ‘বাসে সমস্যা আছে, যাওয়া যাবে না’। মেরামত করার কথা বলে যাত্রীদের কাছ আরো ৫০ টাকা করে আদায় করে। বিষয়টি নিয়ে জরুরি সেবা পেতে ৯৯৯ ফোন করেন তিনি। কিন্তু তাদের সব লাইন বিজি থাকায় যোগাযোগ করতে পারেননি।

ভোলা থেকে সাহাদাত শাহিন জানান, কর্মস্থলে ফিরতে ভোলার লঞ্চঘাটগুলোতে ভিড় বেড়েছে। ঈদের আমেজ না কাটলেও জীবিকার তাগিদে কর্মস্থলে ফিরছেন ভোলাসহ দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ। কেউ লঞ্চে, কেউ ফেরিতে কেউ বা সি ট্রাকে কর্মস্থলের দিকে ছুটছেন। এদের বেশির ভাগ মানুষের গন্তব্য ঢাকা-চট্টগ্রাম ও লক্ষ্মীপুর।

শুক্রবার সকাল থেকে ভোলার ইলিশা লঞ্চঘাটগুলোয় ছিল যাত্রীদের ঢল। ইলিশা ঘাটে কর্মমুখী মানুষের অধিকাংশ বিভিন্ন কারখানার শ্রমিক-কর্মকর্তা। তবে এদের মধ্যে নারী ও শিশুরা বেশি বিড়ম্বনার মধ্যে পড়ছেন।

ভোলার ইলিশা, দৌলতখান, চরফ্যাসন, বোরহানউদ্দিন ও লালমোহন উপজেলার মঙ্গলসিকদার ঘাটসসহ বিভিন্ন ঘাটে যাত্রী বোঝাই করে ঢাকার উদ্দেশ ছাড়তে দেখা গেছে লঞ্চগুলো। সবচেয়ে বেশি চাপ ভোলার ব্যস্ততম লঞ্চঘাট ইলিশা লঞ্চঘাট। এখান থেকে ১০ থেকে ১২টি লঞ্চ ঢাকা ও লক্ষ্মীপুরের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। এ ছাড়াও গ্রিন লাইন, সি ট্রাক ও চারটি ফেরি যাতায়াত করে।

হাসেম আলী নামে একজন যাত্রী বলেন, পরিবার নিয়ে ঈদ করতে নিজ বাড়ি বাংলাবাজার এসেছিলাম। ঈদ পালন করে তাড়াতাড়ি ঢাকা ফিরতে চাই। কেননা দিন যত বাড়বে, যানবাহনের চাপ তত বাড়বে। তাই ঈদের ছুটি এক দিন থাকলেও নিরিবিলি ঢাকায় যাওয়ার জন্য লঞ্চে উঠেছি পরিবার-পরিজন নিয়ে। কিন্তু এখনই লঞ্চে পা ফেলারও উপায় নেই।

মো: রুবেল বলেন, ঘাটে যাত্রীদের অস্বাভাবিক চাপ। লঞ্চগুলোতে ভিড় হলেও কিছুই করার নেই। কর্মস্থলে ফিরতে হবে। তাই ভোগান্তি নিয়েই ফিরছি। সুমাইয়া খামন বলেন, ঢাকা থেকে ঈদ করতে বাড়ি আসছি। এখন ঢাকা যাওয়ার পালা; কিন্তু লঞ্চে কেবিন তো নেই; বসে যে যাবো তারও কোনো ব্যবস্থা নেই।

মো: মাহফুজ বলেন, লঞ্চে এতো যাত্রী যে দাঁড়ানোরও কোনো ব্যবস্থা নেই। এখন দাঁড়িয়ে যেতে হবে। এই বাজে অবস্থার মধ্যেই লঞ্চে অধিক ভাড়া নিচ্ছে।

ইলিশা ঘাট থেকে বেশির ভাগ লঞ্চ ধারণক্ষমতার অধিক যাত্রী নিয়ে চলাচল করতে দেখা গেছে। তবে ঘাটে বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে পুলিশ ও নৌ পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। এ বিষয়ে ভোলা নদীবন্দরের সহকারী পরিচালক মো: শহিদুল ইসলাম বলেন, নৌ যানগুলো যাতে অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই করতে না পারে সে জন্য বিআইডব্লিউটিএ মনিটরিং করছে। তবে যাত্রীদের চাপ কিছুটা কম।

এমজে/