ভোক্তার ১৬০ কোটি টাকা লুট

ভোক্তার ১৬০ কোটি টাকা লুট

অসাধু ব্যবসায়ীদের গুদামে এখনো প্রায় ৪০ হাজার মেট্রিক টন ভোজ্যতেল মজুত আছে। কারসাজির মাধ্যমে বাজার শূন্য করতে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের হিসাবের এই তেল গোপন করা হয়।

সরকারকে চাপে ফেলে দাম বাড়িয়ে নিতেই এ কৌশল। আট থেকে দশ দিন লুকিয়ে রাখার পর এখন প্রকাশ্যে বাড়তি দামে বিক্রি করে ভোক্তার পকেট থেকে প্রায় ১৬০ কোটি টাকা লুটে নিচ্ছে অসাধুরা।

নতুন করে খোলা তেল লিটারে ৪৪ টাকা এবং বোতলজাত ৩৮ টাকা বৃদ্ধিকে অযৌক্তিক বলে মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, বিশ্ববাজারে এক মাস আগে যে দাম ছিল তা ধরে নতুন মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে।

এভাবে দাম বেঁধে দেওয়ায় শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি নয়। মঙ্গলবার অধিদপ্তর সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, কারসাজিতে জড়িত চক্রটি গোপনে ব্যবসায়ীদের মধ্যে খবর ছড়িয়ে দেয় ভোজ্যতেলের দাম বাড়বে। এ খবরে বেশি মুনাফার লোভে ঈদের আগ থেকে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী পণ্যটি লুকিয়ে মজুত করে।

মজুতের মাধ্যমে বাজার তেলশূন্য করা হয়। এ অবস্থায় ৫ মে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে নতুন করে দাম নির্ধারণ করলে বাজারে লুকানো তেল দৃশ্যমান হতে থাকে। কম দামে কেনা তেল মজুত থেকে বের করে নতুন বেঁধে দেওয়া বেশি দামে বিক্রি করছে বিক্রেতা।

গড়ে লিটারে ৪০ টাকা বাড়তি মুনাফা ধরে ৪০ হাজার টনের মূল্য ১৬০ কোটি টাকা। বাড়তি মুনাফার ১৬০ কোটি টাকা প্রকাশ্যে অসাধু ব্যবসায়ীরা পকেটে ভরছে । অথচ এদের বিরুদ্ধে কঠোর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না।

সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অভিযানে গিয়ে মজুত তেল বের করে আর্থিক জরিমানা করছে। যার পরিমাণ তুলনামূলক খুবই কম। এ পরিস্থিতিতে ভোক্তারা প্রশ্ন তুলেছেন অভিযানের মাধ্যমে মজুত তেল বের করে কেন নতুন দামে বাজারে ছাড়া হচ্ছে।

দাম বৃদ্ধির আগে কেন এ তেল উদ্ধার হলো না। এ সময়ে ভোক্তার নাজেহাল হওয়া এবং বাড়তি অর্থ ব্যয়ের দায়িত্ব কে বহন করবে তা জানতে চান তারা। কিন্তু ভোক্তা এর কোনো উত্তর পাচ্ছেন না।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামানের সঙ্গে প্রসঙ্গটি নিয়ে কথা হয়। তিনি বলেন, সংকটের এই ১০ দিন আমাদের হিসাবে প্রায় ৪০ হাজার টন তেল বাজারে ছিল।

যে তেলগুলো মিল থেকে পুরোনো দামে কেনা হয়েছে। যা এখনো ভোক্তার কাছে পৌঁছায়নি। আর এই ৪০ হাজার টন তেল লিটারে গড়ে ৪০ টাকা বেশি দামে বিক্রি করে প্রায় ১৬০ কোটি টাকা অসাধুরা লুটে নেবে।

ইতোমধ্যে বিক্রি শুরু হয়েছে। যা কাম্য নয়। তাই অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে তদারকি চলমান আছে। প্রতিদিনই বড় ধরনের মজুত করা তেল উদ্ধারের পর বাজারে ছাড়া হচ্ছে। পাশাপাশি অসাধুদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে।

তিনি বলেন, রোববার চট্টগ্রামের ষোলশহরে এক দোকানের গুদামে এক হাজার লিটার বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বোতলজাত সয়াবিন তেল খুঁজে পায় ভোক্তা অধিদপ্তর। সোমবার রাজধানীর ডেমরাসহ কয়েক স্থান থেকেও উদ্ধার করা হয়।

মজুতদারদের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার ঘোষণা দিয়ে সফিকুজ্জামান বলেন, আমরা খুব সহজেই এমনটি হতে দেব না। বাজারে অভিযান চলবে।

পাশাপাশি কেউ যাতে পুরোনো দামের তেল নিয়ে কারসাজির মাধ্যমে অতি মুনাফা করতে না পারে তা ধরতে নানা ধরনের মেকানিজম করছি। তেলের দাম কমালে বাজারে তার প্রভাব পড়তে দীর্ঘ সময় লাগে।

অথচ দাম বৃদ্ধির ক্ষেত্রে একদিনের মধ্যে কার্যকর হয়। তিনি বলেন, যখন আমরা তেলের দাম কমালাম বাজারে পণ্য শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত তারা দাম কমিয়ে বিক্রি করেনি। অজুহাত ছিল বেশি দরে কেনা।

কম দামে বিক্রি করতে প্রায় ১৫ দিন সময় লাগল। আর যখন মন্ত্রণালয় ৩৮ ও ৪৪ টাকা লিটারে বাড়াল, সেই বাড়তি দরের তেল সঙ্গে সঙ্গে বাজারে চলে এলো। এখানে আমি মিল মালিকদের ঊদ্দেশে বলব- দাম কমানো ও বাড়ানোর কার্যক্রম এক হওয়া উচিত।

ভোক্তা অধিদপ্তর সূত্র জানায়, ঈদের আগে-পরে দোকানে সরবরাহ না থাকায় সাপ্লাই চেইনের অন্তত ১০ দিনের তেল মজুত হয়েছে। দৈনিক ৫ হাজার টন চাহিদা বিবেচনায় প্রায় ৪০ হাজার টন তেল মজুত করা হতে পরে।

গোপন সংবাদের ভিত্তিতে কিছু তেল অভিযানের মাধ্যমে বের করা গেলেও অধিকাংশ তেল এখনো রয়ে গেছে। যা আগে কম দামের কেনা। এখন নতুন নির্ধারিত দামে বিক্রি শুরু হয়েছে।

৫ মে নতুন করে প্রতিলিটার বোতল সয়াবিন ১৯৮ ও খোলা সয়াবিন তেল ১৮০ টাকা দরে বিক্রির জন্য দাম নির্ধারণ করা হয়। যা আগের দাম ছিল ১৬০ ও ১৩৬ টাকা।

এদিকে বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ৫ মে নতুন করে ভোজ্যতেলের দাম নির্ধারণ করার প্রক্রিয়া অযৌক্তিক। কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে এক মাস আগে যে দাম ছিল তা সামনে এনে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দেশের বাজারে তেলের মূল্য নির্ধারণ করেছে।

এলসি থেকে শুরু করে সেই তেল আমদানি হয়ে দেশে পৌঁছতে প্রায় তিন মাস সময় লাগে। পাশাপাশি পরিশোধিত হয়ে সেই ভোক্তা পর্যায়ে আসতে আরও ২০ দিন থেকে এক মাস সময়ের দরকার হয়।

সব মিলে প্রায় তিন থেকে চার মাস সময় প্রয়োজন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে এসব বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। এক মাস আগের আন্তর্জাতিক বাজারের তেলের দাম ধরে দেশে বর্তমান বাজার মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে।

এদিকে ট্যারিফ কমিশনের তথ্য বিশ্লেষণেও একই চিত্র পাওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এপ্রিল মাসে বিশ্ববাজারে যে দাম ছিল সেটা আমলে নিয়ে নতুন করে তেলের দাম নির্ধারণ করে।

এ সময় বিশ্ববাজারে প্রটি টন তেল ১৭৯০ ডলারে এলসি নিষ্পত্তি হয়েছে। সেক্ষেত্রে প্রতি ডলার ৮৯ টাকা ধরে হিসাব করলে প্রতি টনের দাম দাঁড়ায় এক লাখ ৫৯ হাজার টাকা।

এর সঙ্গে আরও ৩০টি ব্যয়ের খাত যোগ করলে ট্যারিফ কমিশনের হিসাবে প্রতিলিটারে বোতলজাত সয়াবিনের দাম দাঁড়ায় ২০০ টাকা।

এ বিষয়ে কনজ্যুমাসর ফোরামের সাধারণ সম্পাদক এমদাদ হোসেন মালেক বলেন, যে তেলের দাম ঠিক করা হলো তা কবে আনা হয়েছে। বিশ্ববাজারের এক মাস আগের দাম অনুযায়ী দেশের নতুন করে দাম বাড়ানোর কোনো সুযোগ নেই।

এলসি খোলা থেকে বাজারে আসা পর্যন্ত সব পর্যায়ে সরকারের তদারকি করা দরকার। সরকার তেল আমদানিসহ তিন পর্যায়ে ভ্যাট প্রত্যাহার করেছে। এরপর এভাবে নতুন দাম বাড়ানো অযৌক্তিক। এতে একদিকে রাজস্ব ক্ষতি হবে, অন্যদিকে ভোক্তার পকেট কাটা যাবে।

এমজে/