শ্রীলঙ্কা সংকট থেকে শেখার আছে বাংলাদেশেরও

শ্রীলঙ্কা সংকট থেকে শেখার আছে বাংলাদেশেরও

শ্রীলঙ্কায় চরম রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করছে। মাহিন্দা রাজাপাকশে সোমবার প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন। এ সপ্তাহে সরকার দলের সমর্থকদের সঙ্গে সংঘর্ষে কয়েকজন নিহত হয়েছেন। সরকারের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সুশাসনের ব্যর্থতার দায়ভার বহন করতে হচ্ছে জনগণকে। এ বিষয়ে বাংলাদেশকেও সজাগ থাকতে হবে বলে মনে করেন শ্রীলঙ্কায় দায়িত্ব পালন করা সাবেক এক রাষ্ট্রদূত। তার মতে, দ্বীপ রাষ্ট্রটির ব্যর্থতা থেকে বাংলাদেশের অনেক কিছু শেখার আছে।

সাবেক ওই রাষ্ট্রদূত বলেন, আমরা যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা এখন দেখছি, এর শুরু হয়েছে অনেক আগে থেকে। তামিল গেরিলাদের বিরুদ্ধে ২০০৯ সালে জয়লাভের পরে ওইদেশে বুদ্ধিস্ট সিনহালা জাতীয়তাবোধ প্রবলভাবে সক্রিয় হয়ে উঠে। এর ফলে সামাজিক যে সম্প্রীতি সেটি ব্যাহত হওয়া শুরু করে।

তিনি বলেন, মুসলিম সম্প্রদায়ের দুজন প্রাদেশিক গভর্নর এবং নয় জন মন্ত্রী ২০১৯ সালে একযোগে পদত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন। পরবর্তীতে ক্ষমতার কাঠামোতে একঘরে হয়ে পড়ে মুসলিমরা। এর ফলে সামাজিক বন্ধনের মধ্যে একরকম শূন্যতা তৈরি হয়, যা সমাজে কিছুটা বিশৃঙ্খলা তৈরি করে।

সাবেক ওই রাষ্ট্রদূত মনে করেন, উগ্র মতবাদ যেমন—জাতীয়তাবাদ, ধর্মীয় উন্মাদনা যেকোনও দেশের জন্য ক্ষতিকর, সেটির বড় উদাহরণ শ্রীলঙ্কা। বাংলাদেশে সঠিকভাবে ধর্মীয় উগ্রবাদকে মোকাবিলা করা হয়েছে। সামাজিক বন্ধন ধরে রাখার জন্য বিরাজমান পরিস্থিতি অব্যাহত রাখতে হবে।

অপরিকল্পিত অভিবাসন
শ্রীলঙ্কান জনগোষ্ঠীর এক বড় অংশ বিদেশে অভিবাসী হিসাবে কর্মরত ছিল এবং আছে। ওই জনগোষ্ঠী যখন দেশে ফেরত আসে তখন সমাজে তাদের পুনঃপ্রতিষ্ঠার কোনও ব্যবস্থা রাখা হয়নি। এতে সমাজে এক ধরনের অব্যবস্থাপনা তৈরি হয়েছে।

সাবেক এই রাষ্ট্রদূত বলেন, ওই অভিবাসীরা দীর্ঘদিন বিদেশি সংস্কৃতির মধ্যে অবস্থানের কারণে তাদের মনোজগতে এক ধরনের পরিবর্তন আসে। তারা যখন দেশে ফিরে তখন শ্রীলঙ্কার অভ্যন্তরীণ পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারেনি। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের কৃষি খাত।

তিনি বলেন, আমি যখন বিভিন্ন অঞ্চলে গাড়ি নিয়ে যেতাম, তখন অনেক পতিত জমি দেখতাম। চাষাবাদের কেউ নেই। এর বড় কারণ ছিল কৃষকের ছেলে বিদেশে কাজ করে ফেরত আসার পরে কৃষি খাতে সম্পৃক্ত হতে পারেনি। বাংলাদেশের একটি বড় জনগোষ্ঠী বিদেশে বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থান করছে। ওইসব দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে বাঙালি সংস্কৃতির মিল নেই। তারা যখন দেশে ফিরে তখন অবস্থানরত দেশের সংস্কৃতিও সঙ্গে নিয়ে আসে।

তিনি বলেন, অর্থনৈতিক কারণে অভিবাসন হবে, এক্ষেত্রে পরিকল্পিতভাবে বিদেশে লোক পাঠানো দরকার। অভিবাসীরা ফেরত এলে সমাজে পুনরায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পরিকল্পনার পাশাপাশি তাদের সাংস্কৃতিক মনোজগতের পরিবর্তন মোকাবিলার জন্যও একটি কৌশল প্রয়োজন।

অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা
শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা অনেক আগে থেকে শুরু হয়েছে। তামিল গেরিলাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে পর্যটন খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ করা হয়। এছাড়া আরও বন্দর নির্মাণসহ কয়েকটি বৃহৎ প্রকল্পে বিনিয়োগ করা হয় যেখান থেকে লাভ পায়নি শ্রীলঙ্কা। ওই রাষ্ট্রদূত বলেন, হাম্বানতোতা বন্দর বা নতুন বিমানবন্দর টার্মিনাল তৈরি করার সময়ে সেগুলো থেকে কী পরিমাণ লাভ আসতে পারে সেটি সঠিকভাবে বিবেচনায় আনা হয়নি। ফলে বড় ধরনের দেনায় জড়িয়ে পড়ে দেশটি।

অন্যদিকে পর্যটন খাতে অনেক বিনিয়োগ করা হলেও কোভিডের আগে থেকেই অস্থিতিশীলতার কারণে পর্যটক যাওয়া কমে আসে। করোনাকালে সেটি শূন্যে নেমে যায়। ফলে বিনিয়োগকৃত অর্থ থেকে কোনও মুনাফা ঘরে তুলতে পারেনি।

তিনি বলেন, এক্ষেত্রে বাংলাদেশ দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছে। বাংলাদেশের বৃহৎ প্রকল্পগুলো ভবিষ্যৎ অভ্যন্তরীণ শক্তির ওপর নির্ভরশীল, সে কারণে এটি অনেক বেশি টেকসই।

উদাহরণ হিসাবে তিনি বলেন, মেট্রো রেলের যাত্রীরা সবাই বাংলাদেশি হবে। পদ্মাসেতু দিয়ে বাংলাদেশের যানবাহন চলাচল করবে। এগুলো ব্যবহার এবং এখান থেকে মুনাফা আসার জন্য বিদেশি কোনও পক্ষের উপর নির্ভরশীল নয় বাংলাদেশ।

শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে বিষয়টি হচ্ছে তাদের বন্দরে বিদেশি জাহাজ আসতে হবে বা বড় ধরনের বিনিয়োগকৃত পর্যটন শিল্পে বিদেশি পর্যটক প্রয়োজন কিন্তু এধরনের কোনও প্রয়োজন বাংলাদেশি প্রকল্পগুলোর মধ্যে নেই।