ভরা মৌসুমে চালের দাম বাড়ছে

ভরা মৌসুমে চালের দাম বাড়ছে

বোরো মৌসুমের চাল বাজারে আসা শুরু করতেই দেশের প্রধান এই খাদ্যশস্যের দাম বাড়ল। ঢাকা, কুষ্টিয়া ও নওগাঁর পাইকারি বাজারে চালের দাম ধরনভেদে কেজিতে ২ থেকে ৫ টাকা বেড়েছে। এর প্রভাব পড়েছে খুচরা বাজারেও। সেখানে দাম বেড়েছে কেজিতে ১ থেকে ২ টাকা। যদিও খুচরা বাজারের চাল ব্যবসায়ীদের আগের কেনা। বাড়তি দামের চাল খুচরায় পৌঁছায়নি।

সাধারণত বোরো মৌসুম শুরু হলে চালের দাম অনেকটাই কমে যায়। স্বস্তি পায় মানুষ। এ মৌসুমে দাম কমে যাওয়ার কারণ, বোরোতে দেশের মোট চালের প্রায় ৫৫ শতাংশ উৎপাদিত হয়। বিপুল সরবরাহ দাম কমিয়ে দেয়। এবার দেখা যাচ্ছে বিপরীত চিত্র। নতুন মৌসুমের চাল বাজারে এসে যখন দাম কমার কথা, তখনই সরবরাহ কম এবং দাম বাড়ছে।

খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার গত রোববার সুনামগঞ্জে এক মতবিনিময় সভায় বলেছিলেন, ‘সামনে নির্বাচন, তাই সরকার চালের দাম বাড়তে দেবে না।’ কিন্তু দেখা গেল, বাজারে ঘটেছে উল্টো ঘটনা।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবার বোরো মৌসুমের শুরুতে হাওরে আগাম পানি এসে কিছু ধান নষ্ট হয়েছে। এ ছাড়া ঘূর্ণিঝড় অশনির কারণে সারা দেশে ব্যাপক বৃষ্টিপাত পাকা ধানের ক্ষতি করেছে। ওদিকে রাশিয়া, ইউক্রেন ও ভারত থেকে বিশ্ববাজারে সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গমের দাম বাড়ছে। যার প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশের বাজারেও। বিশ্ববাজারে চালের দামও কিছুটা বাড়তি।

সব মিলিয়ে পরিস্থিতি এই যে এখন ধান ও চাল কিনে রেখে ভবিষ্যতে ভালো মুনাফা করার সুযোগ খুঁজছেন ব্যবসায়ীরা। উচ্চ হারে শুল্ক আরোপের কারণে বিদেশ থেকে চাল আমদানির সুযোগ কম, প্রতিযোগিতা কম। এমন পরিস্থিতিতে অনেক ব্যবসায়ী, চালকলের মালিক ও বড় কৃষক ধান কিনে রাখতে বিনিয়োগ করছেন; যা সরবরাহে টান তৈরি করে বাজারে দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে।

খাদ্যসচিব মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুমও মনে করেন, এই মুহূর্তে চালের দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি গুদামে যথেষ্ট পরিমাণে চাল মজুত আছে। বেসরকারি খাতেও চালের সংকট হওয়ার আশঙ্কা নেই। বিশ্বজুড়ে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার সুযোগে ব্যবসায়ীরা চালের দাম বাড়িয়ে দিলেন কি না, তা অনুসন্ধান করে দেখা হবে।

বোরোর উৎপাদন পরিস্থিতি
কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, বোরো ধানের ৬২ শতাংশ এরই মধ্যে কাটা হয়ে গেছে। এই ধানকে চালে রূপান্তর করলে দেখা যায়, কৃষক ও ব্যবসায়ীর কাছে সোয়া কোটি টন চাল রয়েছে। হাওরে আগাম পানি এসে যাওয়া ও অতিবৃষ্টির কারণে ৮০ হাজার টন চাল নষ্ট হয়েছে। কিন্তু এরপরও এবার বোরোতে ২ কোটি ৭ লাখ টনের ওপরে চাল উৎপাদিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) চলতি সপ্তাহের বৈশ্বিক দানাদার খাদ্যশস্য উৎপাদনবিষয়ক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে আগের বছরের তুলনায় এ বছর দেড় লাখ টন চাল বেশি উৎপাদিত হবে। সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরে ৩ কোটি ৬০ লাখ টন চাল হওয়ার কথা।

কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, এবার হাওরে সামান্য পরিমাণে ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে সামগ্রিকভাবে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি ধানের আবাদ হয়েছে। ফলে এ বছর চালের কোনো ঘাটতি হওয়ার আশঙ্কা নেই। তিনি বলেন, দামও এই সময়ে বৃদ্ধি পাওয়ার কথা নয়। কারণ, দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণে চালের মজুত আছে।

দাম বাড়ছে বাজারে
ঢাকার পাইকারি ও খুচরা বাজার, কুষ্টিয়া ও নওগাঁর পাইকারি বাজার এবং চট্টগ্রামের বাজারে খোঁজ নিয়ে গতকাল সোমবার চালের দাম বাড়ার কথা জানা যায়।

ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, মোটাদাগে গত এক সপ্তাহে ঢাকার খুচরা বাজারে চালের দাম কেজিতে ১ থেকে ২ টাকা, পাইকারি বাজারে ২ থেকে ৫ টাকা, নওগাঁর আড়তে ২ থেকে ৪ টাকা এবং কুষ্টিয়ার চালকল পর্যায়ে ২ থেকে ৩ টাকা বেড়েছে।

ঢাকার খুচরা দোকানে মোটা চাল ৪৫ থেকে ৪৮, মাঝারি চাল ৫০ থেকে ৫৫ ও সরু চাল ৬০ থেকে ৭০ টাকা দরে বিক্রি করতে দেখা যায়। কোনো কোনো দোকানে সরু নাজিরশাইল চাল প্রতি কেজি ৮০ টাকা দরেও বিক্রি হচ্ছে।

রাজধানীর মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটের চালের আড়তের ব্যবসায়ীরা জানান, মোটা ও মাঝারি চালের দাম কেজিতে ২ টাকা এবং সরু চালের দাম ৪ থেকে ৫ টাকা বেড়েছে। মিল থেকে চাহিদা অনুযায়ী চাল সরবরাহ করা হচ্ছে না।

মোহাম্মদপুর সরকারি কৃষিপণ্যের পাইকারি বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মনিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, চালকলমালিকেরা ধানের দাম বেশি বলে চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। সরু চালের দাম বেশি হারে বেড়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা কেজিতে ৬ থেকে ৭ টাকা। তিনি আরও বলেন, তিনি ১২ দিন আগে ৩০০ বস্তা (১৫ হাজার কেজি) চালের ফরমাশ দিয়েছেন। অগ্রিম টাকাও পরিশোধ করা আছে। সেই চাল এখনো আড়তে আসেনি।

মোহাম্মদপুরের পাইকারি বাজারের পাশেই খুচরা বাজার। সেখানে মেসার্স নওগাঁ রাইস এজেন্সি নামের একটি দোকানে গতকাল মোটা চাল ৪৬ টাকার আশপাশে, মাঝারি চাল ৫৩ থেকে ৫৫ টাকা এবং মিনিকেট চাল ৬৮ টাকা দরে বিক্রি করতে দেখা যায়। আর নাজিরশাইল চাল ৮২ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছিল।

দোকানের মালিক মো. কামরুজ্জামান বলেন, প্রতিবছর বোরো মৌসুম শুরুর পর চালের দাম প্রতি বস্তায় (৫০ কেজি) ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত কমে যায়। এবার হয়েছে উল্টো। প্রতি বস্তায় ১৫০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে গেছে।

পাইকারি বাজারে নতুন চাল আসছে; যা পুরোনো চালের চেয়ে কিছুটা কম দামে বিক্রি হচ্ছে। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, নতুন চালের দামও অন্যান্য বছরের চেয়ে অনেক বেশি।

মিরপুর-১ নম্বর সেকশনের চালের আড়তের নিউ জিয়া রাইস এজেন্সির মালিক মো. হোসেন রানা বলেন, এ বছর নতুন চালের দামও বেশি।

চট্টগ্রাম, নওগাঁ ও কুষ্টিয়া
চট্টগ্রামের বড় বাজারগুলোতে চালের দাম আগে থেকেই চড়া ছিল। ঈদের পর প্রায় সব চালের দামই কেজিতে ২ থেকে ৫ টাকা বেড়েছে বলে দাবি ব্যবসায়ীদের। বহদ্দারহাট, কর্ণফুলী কমপ্লেক্স ও চকবাজার ঘুরে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

দাম বাড়ার বিষয়ে চট্টগ্রাম চাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ওমর আজম বলেন, হাওরে পানি ঢুকে ফসল নষ্ট হয়েছে। এ কারণে ধানের দাম বেড়েছে, যা চালের দাম বাড়ার কারণ।

দেশের অন্যতম চালের মোকাম নওগাঁয় গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতি বস্তায় (৫০ কেজি) চালের দাম ২০০ থেকে ২৫০ টাকা বেড়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ধানের দাম বাড়ার কারণে স্বাভাবিকভাবেই চালের দাম বাড়ছে।

হঠাৎ করে চালের দাম বাড়ার কারণ কী, তা জানতে চাইলে নওগাঁ জেলা চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন চোকদার বলেন, উৎপাদন কম হওয়ার আশঙ্কায় ব্যবসায়ীদের মধ্যে ধান কেনার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। এ জন্য ধানের দাম বাড়ছে। স্বাভাবিকভাবে চালের দাম একটু বেড়েছে। বোরো ধান পুরোদমে উঠতে শুরু করলে দাম আবার কমে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

কুষ্টিয়া সদর উপজেলার খাজানগরে গতকাল মিনিকেট চাল প্রতি কেজি বিক্রি হয়েছে ৫৯ থেকে ৬০ টাকা দরে, যা আগের চেয়ে বেশি।

বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল মালিক সমিতি কুষ্টিয়া শাখার সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদীন প্রধান বলেন, প্রচুর ফরমাশ আসছে। কিন্তু চাহিদার তুলনায় চাল উত্পাদন করা সম্ভব হচ্ছে না। সরকারকে চাল দিতে মিলাররা ব্যস্ত। ধানের দামও ঊর্ধ্বমুখী।

দেশের বাজারে চালের দাম আগে থেকেই চড়া। বাড়ছে আটা-ময়দা, ভোজ্যতেল, ডাল, পেঁয়াজ, রসুন, সাবান-টুথপেস্টসহ প্রায় সব পণ্যের দাম। এমন পরিস্থিতিতে চালের আরও মূল্যবৃদ্ধি মানুষকে সংকটে ফেলবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।- প্রথম আলো