ক্যাব’র নাগরিক সভায় বক্তারা

বিদ্যুতের দাম বাড়লে মানুষের মনের আগুন দাবানলে রূপ নিতে পারে  

বিদ্যুতের দাম বাড়লে মানুষের মনের আগুন দাবানলে রূপ নিতে পারে   

 

বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি হলে মানুষের মনের আগুন দাবানলে রূপ নিতে পারে বলে সতর্ক করেছেন কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর আলোচনা সভায় বক্তারা। তারা বলেন, সব জিনিসের দাম বাড়ছে, মানুষের অবস্থা খারাপ। সরকার বলছে, বিশ্বব্যাংক বলছে মানুষের আয় বেড়েছে। হয়তো বেড়েছে, কিন্তু বেসরকারি চাকরিজীবী ও সাধারণ জনগণ কিন্তু অনেক সংকটে রয়েছে।

বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) আয়োজিত নাগরিক সভায় তারা এসব মন্তব্য করেন। সভায় বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধি না করে আর্থিক ঘাটতি মোকাবিলায় বিকল্প প্রস্তাব উত্থাপন করেন জ¦ালানি বিশেষজ্ঞ, ক্যাবের সহ-সভাপতি ড. শামসুল আলম।

অনুষ্ঠানে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ প্রধান অতিথির বক্তব্যে বলেন, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দামের বিষয়টি এখন এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের হাতে। আমি এতটুকু বলতে পারি, প্রধানমন্ত্রী এমন কোন কিছু করবেন না যাতে বার্ডেন (বোঝা) হয়ে দাঁড়ায়।

প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমাদের লক্ষ্য নির্ধারিত, কাদের জন্য ভর্তুকি দিতে চাই, কতদর রাখতে চাই। আমাদের একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীর বিদ্যুতের মূল্য দেয়ার সক্ষমতা নেই। তাই ভর্তুকি দেয়া হয়, তবে আমি ভর্তুকি বলি না, বলি বিনিয়োগ। কারণ তারা এই টাকা যাতে নিজের উন্নয়নে কাজে লাগাতে পারে। ছেলে মেয়েদের শিক্ষার কাজে খরচ করতে পারে।
বিজ্ঞাপন
সারে ভর্তুকি দিচ্ছি বলে কোভিডকালেও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ আমরা।

তিনি বলেন, এলএনজিতে ৩০ হাজার কোটি টাকা কর দিচ্ছি, এ কর না দিলেই তো হয়ে যায়। বিদ্যুতেও ২০ থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকার মতো হবে। আমরা নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দেয়ার লক্ষ্যে কাজ করছি।

তিনি বলেন, সার্ভে করার পরও ড্রিল করে অনেক সময় গ্যাস পাওয়া যায় না। অনেকে মনে করেন সমুদ্রে গেলেই কালকে গ্যাস পাওয়া যাবে। এমন ধারণা সঠিক নয়, গ্যাস পেলেও আনতে ১০ বছর সময় লাগবে। সাগরে মাল্ট্রি ক্লেইন সার্ভে হচ্ছে, তারপর দেখব এটা আনা সাশ্রয়ী হবে কিনা। আমরা গ্যাস দিচ্ছি, চাহিদা আরও বেড়ে যাচ্ছে। নতুন নতুন শিল্প কারখানা হচ্ছে। এখনও ৫৫০ থেকে ৬০০ শিল্প সংযোগের আবেদন পড়ে রয়েছে। আমরা চাই শিল্প হোক কর্মসংস্থান বাড়ুক। গ্যাস আমদানি করতে খরচ পড়ছে ৫৯ টাকা। গ্যাস বিক্রি করছি ৭ টাকায়। সংকটের কারণে ইতালি এসি বন্ধ রেখেছে, এমন হতে পারে আমরা টাকা দিলেও গ্যাস মিলছে না।

তিনি বলেন, আমরা স্বল্প, মধ্য এবং দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা নিয়েছিলাম। প্রথম পরিকল্পনা ছিল দ্রুত বিদ্যুৎ দেবো, তেল দিয়ে উৎপাদনে গেছি। সেখানে সফল হয়েছি, শিল্পের উৎপাদন বেড়েছে, মানুষের জীবনমান বেড়েছে। শিল্প মালিকরা গ্রামে যেখানে কম দামে জমি পেয়েছে সেখানে কারখানা করেছে।

প্রতিমন্ত্রী বলেন, ক্যাবের উদ্যোগটা ভালো, আমি কিছু অংশ দেখেছি। তবে আরও গঠনমূলক পরামর্শ দিতে পারেন যাতে কাজে আসে। আরও একটু আধুনিক করা যায় কিনা ভেবে দেখা দরকার। কালকে যদি ৮শ মিলিয়ন গ্যাস আমদানি বন্ধ করি, তাহলে কি হবে সব শিল্প বন্ধ হয়ে যাবে। আমরা কি শিল্প বন্ধ করে দেবো।

কয়লা উত্তোলন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জমি নিয়ে যদি কয়লা উৎপাদন করি তাহলে কি হবে। ফসল উৎপাদন কমে যাবে। যে কারণে কয়লা উত্তোলন বন্ধ রয়েছে। সামান্য পরিমাণে উত্তোলন করা হচ্ছে।

ক্যাবের বিকল্প প্রস্তাবে বলা হয়, বিতরণ ও সঞ্চালন লাইসেন্সির পুঞ্জিভূত নীট মুনাফার পরিমাণ প্রায় ১৪ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা। এমন মুনাফা বিইআরসি আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন এবং লুন্ঠনমূলক। গ্যাসের চুরি কমানো গেলে দৈনিক ৬৩ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আমদানি কম করলেও চলে। চুরি কমানো, উৎস ও অগ্রিম আয়কর প্রত্যাহার করা হলে ভর্তুকি অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব। জ্বালানি খাতে সর্বক্ষেত্রে লুন্ঠনমূলক ব্যয় এবং অবচয় ব্যয় সমন্বয় হলে ভর্তুকি কিংবা মূল্যবৃদ্ধি কোনটারই প্রয়োজন পড়ে না। বরং ইউনিট প্রতি ১৬ পয়সা কমানো সুযোগ রয়েছে।

বিদ্যুৎ খাতের বিকল্প প্রস্তাবে বলা হয়, কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো ৭০ শতাংশ হারে চালানো গেলে নীট উৎপাদন বাড়ে ৪১২ কোটি ইউনিট। হ্রাসকৃত গ্যাস সমন্বয়ের পর নীট খরচ বাড়ে ২ হাজার ৩০৮ কোটি ঘনফুট। অন্যদিকে ফার্নেস অয়েল প্লান্টে দশমিক ৫ শতাংশ কমানো হলে ৫ হাজার ৪৭৩ কোটি টাকা কমানো যায়। পাইকারি বিদ্যুতে নতুন করে করারোপ না করলে ২ হাজার ১৪৯ কোটি টাকা সাশ্রয় হয়। আমদানি পর্যায়ে ফার্নেস অয়েলের উপর শুল্ক কর অব্যাহতি প্রত্যাহার করায় ৬ হাজার ৮৯৭ কোটি টাকা খরচ বেড়েছে। পাইকারি মূল্যহারের সমন্বয়হীনতা দূর করা গেলে ১১ হাজার ৯০৫ কোটি টাকা ঘাটতি কমানো যায়।

তিনি বলেন, ইকুইটির উপর পিডিবি ৩ শতাংশ, পাবলিক কোম্পানি ১২ শতাংশ, যৌথ মালিকানাধীন কোম্পানি ১৬ শতাংশ মুনাফা পাচ্ছে। কুইক রেন্টালের তথ্য পাওয়া না গেলেও ধারণা করা হয় ১৮ শতাংশের কম না। বিইআরসির মানদণ্ডে এই মুনাফা ৭ শতাংশের বেশি হওয়ার কথা না। এখানে মুনাফা কমানো গেলে খরচ সাশ্রয় হয়।

ক্যাব সভাপতি গোলাম রহমান সভাপতির বক্তব্য বলেন, আমরা প্রত্যাশা করি সরকার সাধারণ জনগণের কল্যাণে কাজ করতে কার্পণ্য করবে না। আমরা যেটুকু দেখি তাতে মনে হয় মিতব্যয়িতার ঘাটতি রয়েছে। ব্যয় যৌক্তিক পর্যায়ে রাখা গেলে অনেক সাশ্রয় হতো। জ্বালানির ক্ষেত্রে আমদানি নির্ভরতা বাড়ানোর প্রবণতা লক্ষ্যণীয়। এখান থেকে বের হয়ে আসতে না পারলে সংকট থেকেই যাবে। দেশের কয়লা ক্ষেত্রগুলো ফেলে রাখা হয়েছে।

সব জিনিসের দাম বাড়ছে, মানুষের অবস্থা খারাপ। সরকার বলছে, বিশ্বব্যাংক বলছে মানুষের আয় বেড়েছে। হয়তো বেড়েছে, কিন্তু বেসরকারি চাকরিজীবী ও সাধারণ জনগণ কিন্তু অনেক সংকটে রয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

ক্যাব সভাপতি বলেন, আমেরিকার মতো মূল্যস্ফীতি আমাদের দেশে হয়নি। এর প্রধান কারণ হচ্ছে বিদ্যুৎ জ্বালানির মতো পণ্যের প্রশাসনিক প্রাইস। বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি হলে মানুষের মনের আগুন দাবানলে রূপ নিতে পারে।

অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলেন, আজকের এই সংকটের মূলে হচ্ছে চড়া এলএনজি আমদানি করায়। আমরা স্পর্ট থেকে আর দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় এলএনজি আমদানি করছি। দাম বেড়েছে স্পর্ট মার্কেটে। আমরা যদি যথাযথভাবে গ্যাস উত্তোলন ও অনুসন্ধান করতে পারতাম তাহলে আজকে স্পর্ট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি করতে হতো না। বঙ্গবন্ধু সরকার ছাড়া আর কোন সরকার গ্যাস অনুসন্ধানে সঠিক ভূমিকা রাখতে পারেনি। এখানে মনযোগ দেওয়া জরুরি না হলে সংকট থেকেই যাবে।

ক্যাবের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবীর ভূইয়া, স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান, অধ্যাপক এমএম আকাশ আলোচনায় অংশ নেন।