ডিপোর মালিকেরা নিয়ম মানেননি

ডিপোর মালিকেরা নিয়ম মানেননি

বিপজ্জনক পণ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক ও দেশীয় যে নীতিমালা বা নিয়ম রয়েছে, তা মানা হতো না চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে। যে কারণে রাসায়নিকের কনটেইনারের পাশে রাখা হতো পোশাকসহ অন্য পণ্যের কনটেইনার। ফায়ার সার্ভিসের দেওয়া সব শর্তও ডিপো কর্তৃপক্ষ পূরণ করেনি। অন্যদিকে ডিপো কর্তৃপক্ষ যে নীতিমালা মানছে না, সেই তদারকিও সরকারি সংস্থাগুলো ঠিকমতো করেনি।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের দুটি নীতিমালায় থাকা বিভিন্ন শর্ত মানার পর কনটেইনার ডিপো পরিচালনার লাইসেন্স দেওয়া হয়। দুটি নীতিমালাতেই বিপজ্জনক পণ্য ব্যবস্থাপনার জন্য আন্তর্জাতিক নৌ সংস্থার ‘আইএমডিজি কোড’ বাস্তবায়ন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। মূলত বিপজ্জনক পণ্য থেকে পরিবেশ ও মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি অর্থাৎ সুরক্ষা নিশ্চিত করার পদক্ষেপের কথা বলা আছে এই কোডে।

আর নিরাপত্তার জন্য আইএসপিএস কোড (জাহাজ ও বন্দর স্থাপনার নিরাপত্তাঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম) বাস্তবায়নও বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। বিপজ্জনক পণ্য ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তার জন্য এই দুটি কোড ছাড়াও পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের ছাড়পত্র, অগ্নি ও দুর্যোগবিমা, ডিপো থেকে বন্দরে পণ্য পরিবহনের বিমা বাধ্যতামূলক। শ্রম আইনও মানা বাধ্যতামূলক। ডিপোটি সব ধরনের ছাড়পত্র পেয়েছে।

তবে ছাড়পত্রের শর্ত পূরণ করার অঙ্গীকার করলেও বাস্তবে ডিপো কর্তৃপক্ষ তা মানেনি। আগুন-বিস্ফোরণের পর সরকার গঠিত তিনটি তদন্ত কমিটির প্রাথমিক অনুসন্ধান, দুর্ঘটনার আগে লাইসেন্স প্রদানকারী সংস্থার পরিদর্শন প্রতিবেদন ও প্রথম আলোর অনুসন্ধানে ডিপো পরিচালনার ক্ষেত্রে অন্তত ১০ ধরনের ঘাটতি থাকার তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম জেলার উপপরিচালক ফেরদৌস আনোয়ার প্রথম আলোকে বলেন, বিএম ডিপোর কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ছাড়পত্রের আবেদনে রাসায়নিক পণ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়টি উল্লেখ ছিল না। সেটি থাকলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার শর্ত থাকত। আবার রাসায়নিক পণ্যবাহী কনটেইনারের কাছাকাছি পোশাকপণ্যের কনটেইনার ছিল। হাইড্রোজেন পার–অক্সাইড বিস্ফোরক না হলেও এগুলো আলাদা রাখতে হয়।

আগুন নেভানোর জন্য চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোর ভেতরে জলাধার থাকা বাধ্যতামূলক ছিল। কিন্তু জলাধার ছিল না। ডিপোর ভেতরে প্রতি ৫০০ বর্গফুট এলাকায় একটি করে ফায়ার এক্সটিংগুইশার (আগুন নেভানোর যন্ত্র) থাকা বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা পর্যাপ্ত ছিল না। এমনকি ফায়ার হাইড্রেন্টও (আগুন নেভানোর পানির লাইন) ছিল না। আগুন নেভানোর জন্য প্রশিক্ষিত কর্মীও ডিপোতে ছিলেন না।

৪ জুন রাতে বিএম ডিপোতে আগুন থেকে বিস্ফোরণের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৪৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশের সদস্যসহ দুই শতাধিক মানুষ। অগ্নিকাণ্ডে ডিপোর একাংশ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। পুড়ে গেছে পণ্যবাহী অন্তত ১০০ কনটেইনার।

আগুনের উৎস সম্পর্কে এখন পর্যন্ত নিশ্চিত হতে পারেনি ফায়ার সার্ভিস বা কোনো তদন্ত কমিটি। তদন্ত কমিটি সূত্রে জানা গেছে, আগুন লাগার সময় ডিপোতে ৩৭ কনটেইনার হাইড্রোজেন পার–অক্সাইড ছিল। এর মধ্যে ১২টি অক্ষত রয়েছে।
বিএম কনটেইনার ডিপো ২০১১ সালে বাংলাদেশ ও নেদারল্যান্ডসের দুটি প্রতিষ্ঠানের ১৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগে চালু হয়েছিল।

কোম্পানির ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বিএম কনটেইনার ডিপোর চেয়ারম্যান বার্ট প্রঙ্ক। ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে আছেন মোস্তাফিজুর রহমান। পরিচালক স্মার্ট জিনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুজিবুর রহমান। মুজিবুর সম্পর্কে মোস্তাফিজুরের ভাই। মুজিবুর রহমান চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ।

বিএম ডিপোর নিরাপত্তায় ঘাটতি থাকার বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক মুজিবুর রহমান দাবি করেন, সব বিধিবিধান অনুসরণ করা হয়েছে। এর বেশি কিছু বলতে চাননি তিনি।

বিপজ্জনক পণ্য ব্যবস্থাপনার ঘাটতি
আন্তর্জাতিক নৌ সংস্থা প্রণীত ‘ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম ডেঞ্জারাস গুডস’ বা ‘আইএমডিজি কোড’ অনুযায়ী হাইড্রোজেন পার–অক্সাইড ৫ দশমিক ১ শ্রেণির বিপজ্জনক পণ্য। ১ থেকে ৯ ক্যাটাগরির বিপজ্জনক পণ্যে এক নম্বর হলো বিস্ফোরক। এভাবেই শ্রেণিবিভাজন করে ব্যবস্থাপনার কথা বলা হয়েছে এই কোডে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ও রাজস্ব বোর্ডের নীতিমালাতেও ডিপো পরিচালনার জন্য এই কোডের নীতিমালা মানতে হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

২০১৭ সালে আন্তর্জাতিক নৌ সংস্থা বাংলাদেশে এই কোড বাস্তবায়নে ঘাটতির কথা জানিয়েছিল নৌপরিবহন অধিদপ্তরকে। এ জন্য নৌ সংস্থা তদারকি কমিটি গঠন করে এর বাস্তবায়ন দেখার কথা সুপারিশ করেছিল অধিদপ্তরকে। কিন্তু গত পাঁচ বছরেও এসবের কিছুই হয়নি।

আইএমডিজি কোড অনুযায়ী, কোনো দুর্ঘটনার পরপরই বিপজ্জনক পণ্য আগে সরিয়ে ফেলার নির্দেশনা হয়েছে। এই কোড বাস্তবায়নের জন্য প্রশিক্ষণের কথাও বলা আছে। আবার বিপজ্জনক পণ্য পরিবহন থেকে শুরু করে সংরক্ষণে কী ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে, সেটি বলা আছে আইএমডিজি কোডে।

এ বিষয়ে নৌ খাত সম্পর্কে অভিজ্ঞ একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ডিপোতে আইএমডিজি কোডের সঠিক বাস্তবায়ন হলে ক্ষয়ক্ষতি এতটা হতো না। সামনে যাতে এই কোডের নীতিমালা বাস্তবায়িত হয়, সে জন্য এখন থেকেই নৌপরিবহন অধিদপ্তরের জোরালো পদক্ষেপ দরকার।

অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থায় ঘাটতি
আগুন লাগার পর তা নিয়ন্ত্রণে আনতে গিয়ে ফায়ার সার্ভিসের কর্মী ও কর্মকর্তারা বড় ধরনের ঘাটতি দেখতে পেয়েছেন এই ডিপোতে। ফায়ার সার্ভিসের একাধিক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, লাইসেন্সের শর্ত অনুযায়ী খোলা জায়গায় ফায়ার হাইড্রেন্ট থাকার কথা থাকলেও সেখানে তা ছিল না।

স্বয়ংক্রিয় পাম্পসহ জলাধার থাকার শর্ত থাকলেও সেটি ছিল না। রাসায়নিক রাখার আলাদা বিশেষ ব্যবস্থাও ছিল না। শর্ত অনুযায়ী, প্রতি ৫০০ বর্গফুটে একটি করে ফায়ার এক্সটিংগুইশার থাকার কথা ছিল। ডিপোর আয়তন ৯৭ হাজার ১৫৯ বর্গমিটার। সে হিসাবে দুই হাজারের বেশি ফায়ার এক্সটিংগুইশার থাকার কথা থাকলেও ছিল অপর্যাপ্ত। ফায়ার নিয়ন্ত্রণকক্ষও ছিল না।

ডিপোর আগুন নিয়ন্ত্রণের কাজে অংশ নিয়েছিলেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স ফেনী স্টেশনের উপসহকারী পরিচালক পূর্ণচন্দ্র মুৎসুদ্দী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অগ্নিনির্বাপণের সহায়ক ব্যবস্থার ঘাটতি ছিল ডিপোতে। পানির সংকটেও ভুগতে হয়েছে।

দক্ষ জনবলের ঘাটতি
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ডিপোতে কনটেইনার পরিচালনার কার্যক্রম তদারকি করে। সংস্থাটির সর্বশেষ পরিদর্শন প্রতিবেদনে বিএম ডিপোর পরিচালন কার্যক্রমে ঘাটতির কথা তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, স্ক্যানার, যন্ত্রপাতিসহ চার ধরনের ঘাটতি রয়েছে। বিস্ফোরণের পর এখন তদন্ত শুরু করেছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ।

তদন্ত কমিটির একজন সদস্য গতকাল রোববার প্রথম আলোকে বলেন, আগুন লাগার পর তা কীভাবে তাৎক্ষণিক নির্বাপণ করা হবে, সে জন্য কোনো দক্ষ জনবল ডিপোতে ছিল না। ডিপো পরিচালনায় যুক্ত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বাসা থেকে গিয়ে আগুন নির্বাপণে কাজ করেছেন। ততক্ষণে রাসায়নিকের কনটেইনারে আগুন লেগে যায়।’

তদন্ত কমিটি সূত্র জানায়, ডিপোর যে সারিতে রাসায়নিকের কনটেইনার ছিল, তার পেছনে ছিল পোশাক ও অন্যান্য রপ্তানি পণ্যের কনটেইনার। নিয়ম অনুযায়ী, রাসায়নিকের কনটেইনার আলাদা জায়গায় রাখতে হয়।

ঘটনার পরদিন সরেজমিন পরিদর্শন করেছিলেন বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহান। সেদিন তিনি প্রথম আলোকে বলেছিলেন, কোনো কনটেইনারে আগুন লাগলে নিয়ম হচ্ছে প্রথমেই তা অন্য কনটেইনার থেকে আলাদা করে ফেলা। ডিপোতে এই কাজ হয়নি।

মেয়াদ শেষের পর নবায়নের আবেদন
ডিপো পরিচালনার জন্য মূল লাইসেন্স দেয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। ২০১৬ সাল থেকে দুই দফা বিএম ডিপোর লাইসেন্স নবায়ন করা হয়। দুবারই মেয়াদ পেরিয়ে যাওয়ার পর আবেদন করে প্রতিষ্ঠানটি।

সর্বশেষ ২০২০ সালে মেয়াদ পেরিয়ে যাওয়ার ৩ মাস ১৬ দিন পর লাইসেন্স নবায়নের আবেদন করে বিএম ডিপো কর্তৃপক্ষ। নিয়ম না মানায় কাস্টমস কারণ দর্শানো নোটিশ দিলে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা ভুলের পুনরাবৃত্তি হবে না জানিয়ে ছাড় পান সে সময়। রাজস্ব বোর্ডের সহযোগী সংস্থা চট্টগ্রাম কাস্টমস মূলত শুল্কসংক্রান্ত বিষয়গুলো তদারকি করে।

ডিজেল পাম্প থাকা নিয়েও প্রশ্ন
বিএম ডিপোতে বিস্ফোরণের পর ঘটনাস্থলের অদূরে নিজস্ব কনজ্যুমার (ডিজেল) পাম্প দেখতে পেয়েছেন তদন্ত কমিটির সদস্যরা। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বলছেন, জ্বালানির পাম্পে যদি আগুন লাগত, তাহলে ভয়াবহ অবস্থা হতো। ডিপোর ভেতরে নিজস্ব ব্যবহারের জন্য জ্বালানি পাম্প থাকলেও এ ক্ষেত্রে ফায়ার সার্ভিসের অনুমোদন নেওয়া হয়নি।

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের কাছেও এ–সংক্রান্ত কোনো আবেদন করা হয়নি বলে জানা গেছে। তবে বিস্ফোরক অধিদপ্তর চট্টগ্রামের পরিদর্শক তোফাজ্জল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, নিজেদের ব্যবহারের জন্য জ্বালানি তেল মজুতের অনুমতিপত্র ছিল ডিপোটির। বিস্ফোরণের পর সেটি অক্ষত ছিল।

তবে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের চেয়ারম্যান এ বি এম আজাদ গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, সারা দেশে বড় বড় শিল্পকারখানায় নিজস্ব ব্যবহারের যেসব পাম্প রয়েছে, সেগুলো নীতিমালায় আনার জন্য কাজ হচ্ছে।

কনটেইনার ডিপোর কার্যক্রম তদারকি করে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম কাস্টমস, পরিবেশ অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স এবং নৌপরিবহন অধিদপ্তর। এ ছাড়া বিনিয়োগ বোর্ড, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ থেকেও ছাড়পত্র নিতে হয়। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ডিপোর পরিচালন কার্যক্রম এবং চট্টগ্রাম কাস্টমস কর্তৃপক্ষ শুল্কায়ন কার্যক্রম তদারকি করে।

বিপজ্জনক পণ্য ব্যবস্থাপনা তদারকি করে নৌপরিবহন অধিদপ্তর। অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ও পরিবেশঝুঁকি তদারকি করার কথা ফায়ার সার্ভিস ও পরিবেশ অধিদপ্তরের।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিকৌশল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ইয়াসির আরাফাত খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘তদারকির জন্য অনেকগুলো সংস্থা থাকলেও সমন্বয় নেই। বিপজ্জনক পণ্য ব্যবস্থাপনার জন্য আন্তর্জাতিক কোডগুলো এখানে কীভাবে বাস্তবায়িত হবে, সে জন্য আমাদের নিজস্ব নীতিমালা দরকার ছিল, সেটি হয়নি।

আইনগুলোও যুগোপযোগী হয়নি। তাতে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে সব সংস্থার সমন্বয় এবং আন্তর্জাতিক বিধিবিধান বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে সরকারের জোরালো তদারকি প্রয়োজন।’