নিরাপদ সড়কের দাবি পূরণ হবে কবে

নিরাপদ সড়কের দাবি পূরণ হবে কবে

সড়কে প্রতিদিনই ঝরছে প্রাণ। ঘর থেকে বের হওয়া সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের কেউ ফিরছেন লাশ হয়ে, কেউ বরণ করছেন পঙ্গুত্ব। দুর্ঘটনার জন্য ফিটনেসবিহীন গাড়ি, অদক্ষ চালক, সড়কে অব্যবস্থাপনা এবং চালক, যাত্রী ও পথচারীদের নিয়ম না মানার প্রবণতাকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাবে, ২০২১ সালে দেশে ৫ হাজার ৩৭১টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। এসব দুর্ঘটনায় নিহত হন ৬ হাজার ২৮৪ জন। আহত হন ৭ হাজার ৪৬৮ জন। আগের বছর ২০২০ সালে পাঁচ হাজার ৩৭১টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। এতে প্রাণ হারান ছয় হাজার ২৮৪ জন। সংস্থাটির হিসাবে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ৪২৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৮৪ জন নিহত হন। আহত হন ৬৭৩ জন। ফেব্রুয়ারি মাসে ৪২১টি দুর্ঘটনায় নিহত হন ৫২৮ জন, আহত হন ৪৭৩ জন। মার্চ মাসে ৪৫৮টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন ৫৮৯ জন, আহত হন ৬৪৭ জন। এপ্রিল মাসে দেশে ৪২৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫৪৩ জন নিহত ও ৬১২ জন আহত হন। মে মাসে ৫২৮টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন ৬৪১ জন, আহত হন ১৩৪৬ জন।

বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) সহকারী অধ্যাপক কাজী সাইফুন নেওয়াজ বলেন, সড়কে বেশি ঘটছে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা। মোট সড়ক দুর্ঘটনার ৭০ শতাংশই মোটরসাইকেলের। এই বাহনের চালকদের বেশিরভাগই অপেশাদার, অদক্ষ। হেলমেট না পরা, দুইয়ের অধিক আরোহী নিয়ে চালানোর কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে। তিনি বলেন, শহরের সড়কগুলোতে প্রচুর ইন্টারসেকশন রয়েছে। এছাড়া সড়কে অবৈধভাবে দোকান বসানো, রাস্তায় নির্মাণ সামগ্রী ফেলে রাখাসহ বিভিন্ন কারণে রাস্তা সরু হয়ে যাওয়ায় একদিকে যানবাহনের গতি কমে যায়, অন্যদিকে পথচারীরা মূল রাস্তায় নেমে এলে দুর্ঘটনা ঘটে। মহাসড়কে বেশিরভাগই দুই লেনের রাস্তা, মাঝখানে কোনো ডিভাইডার নেই। অল্প কিছু সড়ক চার লেন হলেও স্থানীয় যানবাহন চলাচলের জন্য সার্ভিস রোড নেই। থ্রি হুইলারগুলো সড়কে উঠে আসছে। মহাসড়কে গতি বেশি থাকে। থ্রি হুইলার গতির মুখে পড়ছে। বড় গাড়ির চালকরা ধীরগতির যানবাহনকে একের পর এক ওভারটেক করতে গিয়ে অমনোযোগী হলেই ঘটছে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। তার মতে, জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের মাধ্যমে করা ১১১ সুপারিশ বাস্তবায়ন করা গেলেই দুর্ঘটনা কমে আসবে। সড়কে যত সমস্যা আছে, এই সুপারিশে সবই চিহ্নিত করা হয়েছে এবং সমাধানের ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য গাইডলাইন দেওয়া হয়েছে।

এআরআই’র এক সমীক্ষা বলছে, রাজধানীতে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে বাস ও মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় হতাহতের হার ৭০ শতাংশ। আর ট্রাফিক আইন না মেনে রাস্তা পারাপার হওয়ার সময় হতাহতের হার ৩০ শতাংশ। পুলিশের দেওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে এআরআই বলছে, দেশের অন্য সব মহানগরের চেয়ে শুধু ঢাকা মহানগরে দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা দ্বিগুণ। এর কারণ ঢাকায় মানুষ ও যানবাহন দুটোই বেশি। বাসের বেপরোয়া প্রতিযোগিতা, মোটরসাইকেলের অতিরিক্ত গতি ও হেলমেট ব্যবহার না করা দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ।

বিআরটিএ’র পরিসংখ্যান অনুযায়ী সারা দেশে মোটরচালিত যানবাহনের সংখ্যা ৫২ লাখ ৪৬ হাজার ৪৯২টি। আর ড্রাইভিং লাইসেন্সধারী চালকের সংখ্যা ৪৩ লাখ ২৩ হাজার ২৬৩ জন। এ হিসাবে স্পষ্ট যে, ৯ লাখ ২৩ হাজার ২২৯টি যানবাহন চালাচ্ছেন লাইসেন্সবিহীন চালক।

তবে একটি সূত্র জানায়, দেশে অনুমোদনহীন আরও কয়েক লাখ গাড়ি রয়েছে। যেগুলো চালনার দায়িত্বেও রয়েছে লাইসেন্সবিহীন অসংখ্য চালক। অদক্ষ এবং লাইসেন্সবিহীন চালকের কারণে সড়কে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে।

জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (নিটোর) জরুরি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, এখানে প্রতিদিন সাড়ে ৪শ থেকে ৫শ রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন। তাদের ৭০ শতাংশই সড়ক দুর্ঘটনার শিকার। চিকিৎসায় সুস্থ হলেও শরীরে শতভাগ ফিটনেস আসে খুব কম রোগীরই।

গত ৫ জুন রাজধানীর উপকণ্ঠ বলিয়াপুরে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে বাস-ট্রাকের ত্রিমুখী সংঘর্ষে মারা যান চার তরুণ বিজ্ঞানী ও তাদের বহনকারী গাড়ির চালক। নিউ গ্রিন এক্সপ্রেসের ব্যানারে চলা যে গাড়িটির কারণে দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে, সেটি ফিটনেস সনদ ও ট্যাক্স টোকেন ছাড়া ঢাকা-খুলনা রোডে সাত বছর ধরে চলছিল। হাইওয়ে পুলিশের উপপরিদর্শক গোলাম মোস্তফা জানান, বেপরোয়া গতির বাসটি প্রথমে বাম লেনে গরুবোঝাই ট্রাককে ধাক্কা দেয়। এরপর রোড ডিভাইডারের ওপর দিয়ে গিয়ে আরিচামুখী লেনে পরমাণু শক্তি কমিশনের স্টাফ বাসের সামনের দিকে ধাক্কা দেয়। এতে চার তরুণ বিজ্ঞানীসহ মোট ৬ জন মারা যান। তাদের একজন কাউসার আহমেদ রাব্বী ইস্কাটনে পরিবার নিয়ে থাকতেন। তার স্ত্রী ইন্টার্ন চিকিৎসক নিলুফা ইয়াসমীন নীলা ৯ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। তার দেড় বছরের একটি পুত্র সন্তান রয়েছে। নীলা বলেন, সড়ক তার এবং সন্তানদের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দিল। এ দুর্ঘটনার পর আহতদের দেখতে গিয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান বলেন, কত মানুষের ট্যাক্সের টাকা, কষ্টের টাকা দিয়ে তৈরি করি একেকজন বৈজ্ঞানিক। যারা মারা গেছেন, তাদের তো রিপ্লেসমেন্ট নেই আমাদের কাছে। এই দুঃখের কথা কাকে বলব!

এই দুর্ঘটনার পরদিন ৬ জুন দুপুরে কাওরান বাজারে ওয়েলকাম পরিবহণের একটি বাসের চাপায় মারা যান মোটরসাইকেল আরোহী কনস্টেবল কোরবান আলী। সাভারের নিজ বাড়ি থেকে কর্মস্থল রাজারবাগ পুলিশ টেলিকমে যাচ্ছিলেন তিনি। কোরবান আলীর মৃত্যুতে তার দুই ছেলে ও এক মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত স্বজনরা।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গের ইনচার্জ সেকান্দর আলী বলেন, প্রতিদিন দুর্ঘটনার কারণে ৬-৭টি লাশ আসে ঢামেক মর্গে। সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ মর্গ ও স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মর্গেও প্রতিদিন একই সংখ্যক লাশ আসে। এর অধিকাংশই সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, সড়কের পরিস্থিতি এতটাই বিশৃঙ্খল যে, চাইলেই সড়ক নিরাপদ করা যাচ্ছে না। যারা সড়কে বিশৃঙ্খলার সুবিধাভোগী, তারাই নীতিনির্ধারণী বিভিন্ন কমিটিতে বসে আছেন। শুধু বক্তব্য দিয়ে দায়িত্ব শেষ করা নয়, সত্যিকার অর্থে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া কোনোভাবেই সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো সম্ভব নয়। তিনি বলেন, গণপরিবহণকে একটি শৃঙ্খলার মধ্যে আনলে সড়ক দুর্ঘটনা কমে আসবে।

ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার মো. মুনিবুর রহমান বলেন, পথচারীরা যদি নিয়ম মেনে চলেন আর চালকরা যদি নিয়ম মেনে গাড়ি চালান, তাহলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে।