‘ভিক্ষা নিয়ে চলা’ ওয়াসায় ১৯ কোটি টাকার বোনাস

‘ভিক্ষা নিয়ে চলা’ ওয়াসায় ১৯ কোটি টাকার বোনাস

গ্রাহক পর্যায়ে পানির দাম আরেক দফা বাড়ানোর পক্ষে বলতে গিয়ে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খান দাবি করেছিলেন, সংস্থাটি সরকারের কাছ থেকে ভিক্ষা নিয়ে চলে। অথচ ২০২০-২১ অর্থবছরে সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সাড়ে তিনটি করে মূল বেতন ‘পারফরম্যান্স অ্যাওয়ার্ড’ হিসেবে প্রণোদনা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে ঢাকা ওয়াসা। এতে ব্যয় হবে ১৯ কোটি টাকা।

সরকারের ভর্তুকিতে চলা ঢাকা ওয়াসার নিয়মিত বেতন-ভাতার বাইরে এমন বোনাস ঘোষণা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। গত বছরও সংস্থাটি সব কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের চারটি মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ বিশেষ পুরস্কার হিসেবে দিয়েছিল।

ঢাকা ওয়াসার নথি অনুযায়ী, ২৭ এপ্রিল ঢাকা ওয়াসা বোর্ডের ২৯১তম সভায় পারফরম্যান্স অ্যাওয়ার্ড (উৎসাহ বোনাস) দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। করোনা মহামারি–পরবর্তী ২০২০-২১ অর্থবছরের পারফরম্যান্সের জন্য ঢাকা ওয়াসার স্থায়ী, চুক্তিভিত্তিক ও প্রেষণে নিয়োজিত কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদের তিনটি মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ বোনাস দেওয়া হবে। আর গত ২৫ জানুয়ারি ২৮৬তম সভায় কর্মীদের একটি মূল বেতনের অর্ধেক ইন্টেরিম (অন্তর্বর্তীকালীন) পারফরম্যান্স বোনাস দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।

২০২০-২১ অর্থবছরে বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তিতে ঢাকা ওয়াসা প্রথম স্থান অর্জন করায় এই বোনাস দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। পারফরম্যান্স বোনাস কীভাবে দেওয়া হবে, সে বিষয়ে একটি নীতিমালা তৈরি করেছে ওয়াসা। সে অনুযায়ী, ২০২০ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২১ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ঢাকা ওয়াসার বেতনভুক্ত (পে-রোল) যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী ছিলেন, তাঁরা সবাই তিনটি মূল বেতন এবং একটি মূল বেতনের ৫০ শতাংশ বোনাস পাবেন।

যাঁরা অবসর প্রস্তুতিকালীন ছুটিতে গেছেন, তাঁরা অবসরে যাওয়ার আগপর্যন্ত কর্মদিবসের আনুপাতিক হারে বোনাস পাবেন। আর ওয়াসায় চুক্তিভিত্তিক কর্মীদের মধ্যে যাঁরা ২০২০-২১ পুরো অর্থবছরে কর্মরত ছিলেন, তাঁরাও এই বোনাস পুরোটা পাবেন। সম্পূর্ণ বছর কাজ না করলে কর্মদিবসের আনুপাতিক হারে বোনাস প্রাপ্ত হবেন।

মে মাসের বেতন-ভাতার তথ্য অনুযায়ী, ওয়াসার স্থায়ী কর্মী ২ হাজার ৭২৩ জন। তাঁদের মূল বেতন ৫ কোটি ৮১ লাখ ৪০ হাজার টাকা। এ ছাড়া ওয়াসার প্রকল্প অফিসে ১৯ জন এবং নারায়ণগঞ্জ ওয়াসার ২৬ জন কর্মীর বেতনও ঢাকা ওয়াসা থেকে দেওয়া হয়। সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর সাড়ে তিনটি পারফরম্যান্স বোনাস দিতে সংস্থাটির ব্যয় হবে ১৯ কোটি টাকার বেশি।

২০০৯ সালে এমডি হিসেবে প্রথম দফায় নিয়োগ পাওয়ার পর আর পদ ছাড়তে হয়নি তাকসিম এ খানকে। ষষ্ঠবারের মতো তাঁকে ওয়াসার এমডি হিসেবে নিয়োগের অনুমোদন দেওয়া হয় ২০২০ সালের ১ অক্টোবর। ১৩ বছরে তাকসিম এ খানের মাসিক বেতন বেড়েছে ৪২১ শতাংশ। বর্তমানে ওয়াসার এমডি হিসেবে তাঁর মাসিক বেতন ৬ লাখ ২৫ হাজার টাকা। এর মধ্যে মূল বেতন ২ লাখ ৮৬ হাজার টাকা। সে হিসেবে তাকসিম এ খান এবার পারফরম্যান্স বোনাস পাবেন ১০ লাখ ১ হাজার টাকা।

জানতে চাইলে ওয়াসা কর্তৃপক্ষের হয়ে বক্তব্য দেন উপপ্রধান জনতথ্য কর্মকর্তা এ এম মোস্তফা তারেক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকা ওয়াসা কোনো বিধিবহির্ভূত কাজ করছে না। ওয়াসা বোর্ড সর্বসম্মতিক্রমে এই বোনাস দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

ঢাকা ওয়াসা গত ১৩ বছরে ১৪ বার পানির দাম বাড়িয়েছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতে আরেক দফা পানির দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নেয় সংস্থাটি। এ নিয়ে সমালোচনা শুরু হলে গত ৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকা ওয়াসা ভবনে পানির দাম বাড়ানোর ব্যাখ্যা তুলে ধরে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ। তখন তাকসিম এ খান বলেন, বর্তমানে প্রতি ১ হাজার লিটার পানিতে সরকারকে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে ১০ টাকা। ভিক্ষা করে কোনো সংস্থা নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে না।

একদিকে পানির দাম বাড়ানোর উদ্যোগ, অন্যদিকে ১৯ কোটি টাকার বোনাস ঘোষণাকে যুক্তিসংগত মনে করেন না ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক আদিল মুহাম্মদ খান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বোনাস ঘোষণা ওয়াসার স্ববিরোধিতা। পারফরম্যান্স বোনাস দেওয়ার ক্ষেত্রে সেবার মান অবশ্যই বিবেচনা করা উচিত। পানির দাম বাড়িয়ে কর্মীদের পারফরম্যান্স বোনাস দেওয়া, জনগণের সঙ্গে উপহাসের শামিল।-প্রথম আলো