সিলেটে বন্যা অপরিবর্তিত

বাড়ছে দুর্ভোগ আছে ত্রাণ সংকটও

বাড়ছে দুর্ভোগ আছে ত্রাণ সংকটও

সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। বেশ কয়েক দিন ধরে পানিবন্দি লাখ লাখ মানুষ চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে। আটকে থাকা পানি চারদিকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই পাওয়া অসহায় লোকজন প্রয়োজনীয় খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি ও ওষুধ পাচ্ছে না। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে ত্রাণ সংকট দেখা দিয়েছে। বন্যাদুর্গতদের মাঝে বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ অব্যাহত রয়েছে। এদিকে, সরকারি হিসাবে ত্রাণ বরাদ্দ পর্যাপ্ত এবং ত্রাণ দেওয়া অব্যাহত আছে। কিন্তু সংশ্লিষ্টদের হাত পেরিয়ে সময়মতো ত্রাণসামগ্রী বন্যাদুর্গত মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। এ কারণে প্রতিদিন বন্যাকবলিতদের দুর্ভোগ ও ভোগান্তি বাড়ছে।

সিলেট : সিলেটের ছয় উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। দক্ষিণ সুরমা, বিশ্বনাথ, গোলাপগঞ্জ, ওসমানীনগর, বালাগঞ্জ ও ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলায় দুদিন ধরে খুব ধীরগতিতে বন্যার পানি নামছে। পানি না নামায় দুর্ভোগ বাড়ছে। লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি। এর মধ্যে স্থানীয় বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কয়েকগুণ বেড়েছে। বন্যাকবলিত এলাকায় বিশুদ্ধ পানির চরম সংকট দেখা দিয়েছে। সিলেট নগরীর বিভিন্ন এলাকার পানি নামলেও চারদিকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে।

নগরীর চৌহাট্টার রেড ক্রিসেন্ট মাতৃমঙ্গল হাসপাতাল প্রাঙ্গণে ডেনিশ রেড ক্রসের সহযোগিতায় শতাধিক পরিবারের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি সিলেট ইউনিট। ত্রাণ বিতরণকালে উপস্থিত ছিলেন রেড ক্রিসেন্ট সিলেট ইউনিটের সেক্রেটারি আব্দুর রহমান জামিল, কার্যকরী সদস্য মজির উদ্দিন, সোয়েব আহমদ, সিলেট ইউনিটের উপ-পরিচালক আব্দুস সালাম প্রমুখ।

গোলাপগঞ্জ (সিলেট) : সিলেট-জকিগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে হাঁটুপানি থাকায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে বিয়ানীবাজার-কানাইঘাট, বড়লেখা, গোলাপগঞ্জসহ পাঁচটি উপজেলার কয়েক লাখ মানুষ যাতায়াতে ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। বিশেষ করে সিএনজি অটোরিকশা চলাচল বন্ধ রয়েছে। এজন্য বিকল্প হিসাবে ট্রাক্টর মানুষের যাতায়াতের একমাত্র ভরসা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাঝেমধ্যে মাইক্রোবাসে গাদাগাদি করে যাত্রীরা যাতায়াত করছে। এক ট্রাক্টর চালক জানান, দুদিন থেকে গোলাপগঞ্জ থেকে যাত্রী আনা-নেওয়া করছি। সড়কের বিভিন্ন জায়গায় পানি। এজন্য ঝুঁকি নিয়েও ধীরে ধীরে চলতে হচ্ছে।

ছাতক (সুনামগঞ্জ) : ছাতকে সুরমা, চেলা, পিয়াইন ও বটের নদীর পানি কিছুটা কমলেও বন্যা পরিস্থিতির তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। বন্যা কবলিত এলাকায় ত্রাণের জন্য বানভাসিদের হাহাকার বাড়ছে।

তবে প্রশাসনের পাশাপাশি পুলিশ-সেনাবাহিনী, জাতীয় পার্টি, বিএনপি, জামায়াত, খেলাফত মজলিসসহ এনজিও সংস্থা ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত রেখেছে। বন্যার পানির স্রোতে ১৮টি সড়কের মধ্যে বুড়াইরগাঁও-আলমপুর পাকা সড়ক প্রবল তোড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এদিকে, ১০টি গ্রামে ১৫ দিন ধরে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ থাকায় শতাধিক সিএনজির চালক খেয়ে না খেয়ে চরম কষ্টে দিন যাপন করছেন।

দিরাই (সুনামগঞ্জ) : শাল্লা ও দিরাই উপজেলায় প্রধানমন্ত্রীর মানবিক সহায়তা বিতরণ করা হয়েছে। রোববার বিভিন্ন এলাকায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে দুস্থ ও অসহায় মানুষের মাঝে ত্রাণ হিসাবে শিশু খাদ্য, শুকনা খাবার, বিশুদ্ধ খাবার পানি বিতরণ করেন জেলা প্রশাসক জাহাঙ্গীর হোসেন।

ধর্মপাশা (সুনামগঞ্জ) : ধর্মপাশা উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের বন্যাকবলিত ২০০টি পরিবারের মধ্যে চাল, ডাল, চিনি, তেল, গুড়, চিড়া, খাবার স্যালাইন, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বিতরণ করা হয়েছে। ধর্মপাশা থানা পুলিশের উদ্যোগে থানা চত্বরে এসব ত্রাণসামগ্রী ও রান্না করা খাবার বিতরণ করা হয়।

জামালগঞ্জ (সুনামগঞ্জ) : একদিকে বন্যার পানি কমছে অন্যদিকে মানুষের দুর্ভোগ বাড়ছে। খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি ও গোখাদ্যের চরম সংকট দিয়েছে। পানি কমতে দেখে অনেকে আশ্রয়কেন্দ্র থেকে বাড়ি ফিরতে চাইলেও বাড়ি-ঘর বানের পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তারা ফিরতে পারছেন না। এছাড়া গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগি নিয়ে তারা বিপদে পড়েছেন।

শায়েস্তাগঞ্জ (হবিগঞ্জ) : বৃষ্টি ও উজানের ঢলে শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলার নিম্নাঞ্চলে বন্যা দেখা দিয়েছে। উপজেলার মররা, নিশাপট, কাজীরগাও, ঢাকিজাংগল, লাদিয়া, ফরিদপুর, বারলাড়িয়া, চন্ডিপুর, নোয়াগাঁও, পুরাসুন্দা, কেশবপুর, উলুহর, পুটিয়া, শৈলজুড়া, বাখরনগর গ্রামের নিম্নাঞ্চল পানিতে তলিয়ে গেছে। আউশ ধানের ক্ষেত দু-তিন ফুট পানিতে তলিয়ে গেছে।

বড়লেখা (মৌলভীবাজার) : বড়লেখা-কুলাউড়া আঞ্চলিক মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে এখনও বন্যার পানি রয়েছে। এতে সড়কের বিভিন্ন স্থানে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। ফলে ঝুঁকি নিয়ে চলছে যানবাহন। যাত্রীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। এ সুযোগে অসাধু যানবাহন চালকরা অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছে বলে যাত্রীরা অভিযোগ করছেন। এদিকে গত ৮ দিন ধরে বড়লেখা-সিলেট সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। অটোরিকশা চালক হামিদ আহমদ বলেন, বন্যার পানি উঠার পর দূরে কোথাও যাত্রী নিয়ে যাই না। এখন যাত্রী নিয়ে বিপদে পড়েছি। কারণ গর্তগুলো দেখা যায় না। চলতে গিয়ে এসব গর্তে গাড়ি আটকে পড়ছে। এতে পানি ঢুকে গাড়ি বিকল হচ্ছে।

বড়লেখার বন্যাদুর্গত এলাকার মানুষের পাশে চান্দ্রগ্রাম এলাকার কয়েকজন তরুণ দাঁড়িয়েছে। দুদিনে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ৫০০ পরিবারের মাঝে তারা খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করেছে। তাদের আর্থিকভাবে সহযোগিতা করেছেন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ডা. সারাহ ও সিলেট আর্ট ফরেন এডুকেশন কনসালটেশন। খাদ্যসামগ্রীর মধ্যে ছিল তিন কেজি চাল, তিন কেজি আলু, দুই কেজি পেঁয়াজ, এক কেজি ডাল, এক লিটার তেল, মোমবাতি, স্যালাইন ও ওষুধ।

সিলেটের বন্যার্তদের জন্য হাজি কাউছ মিয়ার দুই ট্রাক খাদ্য : চাঁদপুর প্রতিনিধি জানান, সিলেটের বন্যাদুর্গতদের মাঝে বিতরণের জন্য ৫০০ বস্তা চাল দুই ট্রাকে করে পাঠিয়েছেন দেশের শীর্ষ করদাতা বিশিষ্ট শিল্পপতি সমাজসেবক হাজি মোহাম্মদ কাউছ মিয়া। শনিবার রাতে চাঁদপুর থেকে চাল বোঝাই ট্রাক দুটি সিলেটের উদ্দেশে রওয়ানা হয়। চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ আবু নঈম পাটওয়ারী দুলালের তত্ত্বাবধানে চাল পাঠানো হয়। রোববার সকালে বাহুবল উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) রুহুল আমিনের কাছে দুই ট্রাক চাল হস্তান্তর করা হয়। বন্যাকবলিত অসহায় মানুষদের মাঝে সেনাবাহিনীদের মাধ্যমে চাল বিতরণ করা হবে ।

বন্যার্তদের জন্য ভোলায় টিফিনের টাকা তুলে দিল কলেজ শিক্ষার্থীরা : ভোলার বাংলাবাজার ফাতেমা খানম কলেজের শিক্ষার্থীরা টিফিন না খেয়ে একদিনের টাকা সিলেটসহ বিভিন্ন প্রান্তের বন্যার্তদের সহায়তার জন্য দান করেছে। রোববার কলেজ অধ্যক্ষের হাতে ওই টাকা তুলে দেওয়া হয়। রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির মাধ্যমে টাকা বন্যার্তদের দেওয়া হবে।

রাজশাহীসহ তিন জেলার ১০ পয়েন্টে ভাঙন : পদ্মায় অব্যাহতভাবে পানি বৃদ্ধির ফলে রাজশাহী অঞ্চলের চার জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। একই সঙ্গে উজানে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ থেকে ভাটিতে পাবনার পাকশী পর্যন্ত ১৭৫ কিলোমিটার নদী এলাকার ১০টি স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। ভাঙনকবলিত এলাকাগুলোর লোকজন বাড়িঘর নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিচ্ছেন। কোথাও কোথাও ভাঙন রোধে বালির বস্তা ফেলার কাজ শুরু করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। গত কয়েকদিনের পানি বৃদ্ধিতে পদ্মার দুই পারের বিস্তীর্ণ নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। আউশ ধানসহ বিভিন্ন ফসলের ক্ষেত তলিয়ে গেছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ পাউবোর উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মাহবুব আলম জানান, পদ্মার বন্যা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য সাতটি পর্যবেক্ষণ টিম গঠন করা হয়েছে। সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত সার্বক্ষণিকভাবে বন্যা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে টিমগুলো। ফারাক্কার উজানে পানির উচ্চতা মনিটরিং ছাড়াও উজানে কোথায় ভারি বর্ষণ হচ্ছে সে তথ্যও সংগ্রহ করছে এসব মনিটরিং টিম। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় রাজশাহীর গোদাগাড়ী, চারঘাট ও বাঘা এলাকার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। গোদাগাড়ীর নিমতলা এলাকায় পদ্মায় ভাঙন শুরু হওয়ায় চারটি গ্রামের শতাধিক পরিবার ভাঙনের ঝুঁকিতে পড়েছে। চারঘাট ও বাঘা এলাকাতেও পদ্মার পাড় ভাঙছে।

পাবনার পাকশীসহ তিনটি স্থানে পদ্মায় ভাঙন হচ্ছে। বিশেষ করে সাড়া গ্রাম এলাকায় নদী ভাঙন তীব্র হয়েছে। পানির উচ্চতা বাড়ার সঙ্গে ভাঙনের তীব্রতাও বাড়ছে। এসব এলাকায় বালির বস্তা ফেলে ভাঙন রোধের চেষ্টা করছে পাউবো।