লোডশেডিংয়ের সূচি আর বাস্তবতা ভিন্ন

লোডশেডিংয়ের সূচি আর বাস্তবতা ভিন্ন

বিদ্যুতের সঙ্কট মোকাবেলায় মঙ্গলবার থেকে সারাদেশে এক ঘণ্টা করে লোডশেডিংয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। তবে সরকার ঘোষিত শিডিউল মেনে হচ্ছে না লোডশেডিং। প্রকাশিত সূচির ভিন্নতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে দেশের বেশির ভাগ স্থানেই।

শুক্রবার পাওয়া বিভিন্ন এলাকার তথ্য বলছে, রাজধানী ঢাকায় শিডিউলের বিষয়ে কিছুটা সতর্ক থাকলেও গ্রাম-অঞ্চলে নেই তার বিন্দুমাত্র নিদর্শন।

দেশের কোনো কোনো এলাকায় একবারের পরিবর্তে লোডশেডিং হচ্ছে একাধিকবার। এক ঘণ্টার জায়গায় বিদ্যুৎ থাকছে না চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা। আবার স্থানভেদে তা দাঁড়াচ্ছে ১০ থেকে ১১ ঘণ্টায়। এতে তীব্র ভোগান্তিতে রয়েছে সাধারণ মানুষ।

দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পাওয়া তথ্য :
যশোর পৌর এলাকার বাসিন্দা বায়জিদ হোসোইন বলেন, পল্লী বিদ্যুতের বিভিন্ন এলাকার তালিকায় সারাদিনে এক ঘণ্টা করে একবার কিংবা সর্বোচ্চ দু'বার লোডশেডিংয়ের কথা বলা হয়েছে। অথচ মানা হচ্ছে না কোনো নিয়ম। একবার লোডশেডিং হলে আসার কোনো খোঁজ থাকছে না। অনেকটা এমন যে সাধারণ হিসেবে ৬০ মিনিটে ঘণ্টা হলেও বিদ্যুতের ৯০ মিনিটে যেন ঘণ্টা পূর্ণ হচ্ছে।

তিনি জানান, একাধিকবার লোডশেডিংয়ের বাস্তবতায় প্রায় পাঁচ ঘণ্টা থাকছে না বিদ্যুৎ। এমন বিদ্যুৎ বিভ্রাটে নারী, বৃদ্ধ ও শিশুরা অসহনীয় দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। এছাড়া সন্ধ্যার সাথে সাথে লোডশেডিং হওয়ায় শিক্ষার্থীদের ওপর এর প্রভাব পড়ছে। বই থেকে মুখ ফিরিয়ে চায়ের দোকানের আড্ডায় জমছে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী।

ফেনী থেকে মাজহারুল ইসলাম জানান, 'ফেনী পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি' থেকে নির্ধারিত সূচি প্রকাশ করলেও মানা হয় না এতটুকু। সরকার নির্দেশিত সময়ের কয়েকগুণ বেশি সময় থাকে লোডশেডিং।

তিনি জানান, দৈনিক এক ঘণ্টা করে লোডশেডিংয়ের কথা উল্লেখ থাকলেও ফেনীর সোনাগাজীতে হচ্ছে প্রায় ছয় ঘণ্টা। কখনো কখনো তা দাঁড়ায় সাত থেকে আট ঘণ্টায়।

এছাড়াও দাগনভূঞয়া উপজেলায় প্রতিদিন গড়ে আট থেকে ১০ ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে বলেও জানান মাজহার।

নারায়ণগঞ্জ থেকে তামান্না জান্নাতি জানান, সোমবার যখন প্রথম শুনি বিদ্যুৎ নির্দিষ্ট সূচি অনুযায়ী থাকবে না। দিনে ও-ই নির্ধারিত একটা সময় লোডশেডিং থাকবে। তাতে কিছুটা স্বস্তি পেয়েছিলাম। আমার শিক্ষার্থীদের সময়ও পরিবর্তন করে দিয়েছিলাম। কিন্তু বাস্তবতা দেখি সম্পূর্ণ বিপরীত। সূচি অনুসরণ করা তো দূরে থাক, একবারের পরিবর্তে লোডশেডিং হচ্ছে কয়েকবার। প্রায় দেখা যাচ্ছে, দিনে তিন থেকে চারবার লোডশেডিং হচ্ছে। যেমন, সকালে ড়েছে, দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পর আলোকিত হলো রুম। কিন্তু তীব্র গরমের মাঝে দুপুরের দিকে ফের শুরু হলো লোডশেডিং। এরপর রাতে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার সময়। কিন্তু লোডশেডিংয়ের কারণে তারাও ভোগান্তিতে। রাত ৯টা থেকে শুরু হয় লোডশেডিং।

এ সময় তামান্না আরো বলেন, বিদ্যুতের ঘাটতি পূরণে দেশব্যাপী লোডশেডিং হচ্ছে আমরাও তা মেনে নিয়েছি। কিন্তু তাদের প্রকাশিত সূচি অনুসরণ করলে আমরা পরিকল্পনা সাজিয়ে কাজ করতে পারি। এতে আমাদের যেমন ভোগান্তি কম হবে। তেমনি, দেশের বৃহত্তর সমস্যা সমাধানও সহজ হবে।

ঢাকার সাভার থেকে সাইয়েদ তাজিম বলেন, দিনের কখন যে বিদ্যুৎ আসে আর কখন যে যায় তার কোনো হিসেব নেই। শুধুমাত্র নামের জন্য কিংবা দেখানোর জন্য একটা সূচি প্রকাশ করছে, বাস্তবতার সাথে যার কোনো মিল নেই।

রংপুর থেকে মাজহার জানান, চার দিনেও সামান্য উন্নতি হয়নি রংপুর মহানগরীসহ বিভাগের লোডশেডিংয়ের সিডিউল ও হার। এতে সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন। এক ঘণ্টা লোডশেডিং থাকার কথা থাকলেও সাত থেকে আট ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে।

এছাড়াও তিনি জানান, নেসকোর ৩৩/১১ কেভি সাবস্টেশনের অধীনে রংপুর মহানগরীতে ২৩টি ফিডার রয়েছে। তাতে প্রতিটি ফিডারে দিনে একবার করে লোডশেডিং দেয়ার নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু শুধু শুক্রবার সকাল থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত লোডশেডিং হয়েছে রংপুরে ছয়বার। এভাবেই পার করছে নিয়মিত। আর অতিষ্ট হয়ে পড়ছে জন-জীবন।

অন্যদিকে বিদ্যুৎ বিভাগের পাওয়া তথ্য অনুযায়ী নিয়মিত চাহিদার তুলনায় উৎপাদিত বিদ্যুতের পরিমাণ যথেষ্ট কম। যার ফলে প্রতিদিন প্রকাশিত সূচি অনুসরণ করতে পারছে না তারা।

বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে শুক্রবার বিদ্যুৎ চাহিদার পূর্বাভাস করা হয়েছিল ১১ হাজার ৩৫০ মেগাওয়াট। আর সন্ধ্যায় সর্বোচ্চ ১২ হাজার ৯০০ মেগাওয়াট।

বৃহস্পতিবার বিদ্যুৎ চাহিদার পূর্বাভাস করা হয়েছিল ১১ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট এবং সন্ধ্যায় সর্বোচ্চ ১৪ হাজার ২০০ মেগাওয়াট।

অথচ এ দিন বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে দিনের সর্বোচ্চ ১০ হাজার ৯০৩ এবং সন্ধ্যায় সর্বোচ্চ ১২ হাজার ২৩৯ মেগাওয়াট।

এর আগের দিন (বুধবার) উৎপাদিত বিদ্যুতের পরিমাণ ছিল দিনের ১১ হাজার ১৫৫ মেগাওয়াট। আর সন্ধ্যার সর্বোচ্চ ১২ হাজার ৪৯৪ মেগাওয়াট। যা চাহিদার পূর্বাভাসের তুলনায় ঘাটতি ছিল।

এমন অভিযোগের ভিত্তিতে যা বলছেন সংশ্লিষ্টরা
কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) উপদেষ্টা ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, বিদ্যুৎ ব্যবহারের তুলনায় উৎপাদন কম হওয়ায় এমনটা হচ্ছে। বিদ্যুতের চাহিদা যেখান থেকে নেয়া হয়েছে তারা অঞ্চলিক অর্থাৎ ঢাকার বাইরে চাহিদার বিষয়ে স্পষ্ট সমীকরণ করতে পারেনি।

শামসুল আলম বলেন, 'এখনি আমরা সরাসরি কর্তৃপক্ষকে ব্যর্থ কিংবা তাদের পরিকল্পনা যথার্থ নেই, এটা বলতে পারি না। কারন, এ বিষয়গুলো নিয়ে আরো স্টাডির বিষয় রয়েছে। তবে এটুকু বলা যায়, গ্রাম কিংবা শহর অথবা রাজধানী যেটাই হোক চাহিদার বিষয়ে নজর রেখে লোডশেডিং সমন্বয় করতে হবে।'

বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের সদস্য মো : আমজাদ হোসেন বলেন, ’আমরা ধীরে ধীরে উন্নতি করছি। আগের দিনের তুলনায় আজকের দিন ভালো ছিল। একটা পরিকল্পনা হাতে নিলে সাথে সাথে তা সুশৃঙ্খলভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না। এখানে তেমনটা হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘বিশেষ করে আমরা প্রথমে শহরে বিদ্যুৎ স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছি। এরপর ধীরে ধীরে অঞ্চলের দিকে নজর দিব। আশা করছি, খুব দ্রুত সমস্যা সমাধান হবে।’

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গ্রাহকদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, 'বর্তমান সঙ্কট সাময়িক সময়ের জন্য। এই সমস্যা খুব বেশি দিন থাকবে না। তবুও বর্তমান বিদ্যুৎ সমস্যার জন্য সম্মানিত গ্রাহকদের কাছে আমরা দুঃখপ্রকাশ করছি এবং সবার সহযোগিতাও কামনা করি।'

তিনি বলেন, সঙ্কট সমাধানে আমরা সারাদেশে শিডিউলভিত্তিক লোডশেডিং দিতে বাধ্য হচ্ছি। তবে এক সপ্তাহ পর্যবেক্ষণ করে লোডশেডিংয়ের বিষয়ে নতুন পরিকল্পনা নেয়া হবে।

তিনি আরো জানান, আগামী কয়েক মাসের মধ্যে পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের দ্বিতীয় ইউনিট ও রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হয়ে যাবে এবং একই সাথে ভারতের আদানি পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে এক হাজার ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি শুরু হলে চার হাজারের বেশি মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমাদের জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে।

এ সময় তিনি সবার প্রতি অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ‘ধৈর্য ধরুন। এই কঠিন সময়ে আপনাদের সকলের সহযোগিতা আমাদের একান্ত কাম্য।’