তামাকে ক্ষতি বছরে অন্তত ৩০ হাজার কোটি টাকা

তামাকে ক্ষতি বছরে অন্তত ৩০ হাজার কোটি টাকা

অপর্যাপ্ত সচিত্র সতর্কবার্তার কারণে তামাকদ্রব্যে ঝুঁকছে তরুণরা। দেশে বছরে এক লাখ ৬১ হাজারের অধিক মানুষ মারা যায় শুধু তামাকের ক্ষতির শিকার হয়ে। এর মধ্যে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তামাক ব্যবহারের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা।

গবেষণায় বলা হয়েছে, তামাকে থাকে প্রায় সাত হাজার রাসায়নিক পদার্থ। এর অন্যতম হলো নিকোটিন ও আলকাতরা (টার)। এসব রাসায়নিক পদার্থ রক্তনালীকে সঙ্কুচিত করে দেয় এবং ক্ষতিগ্রস্ত করে। নিকোটিন নামক যে রাসায়নিকটি তামাকে পাওয়া যায়, তা বিপজ্জনক মাত্রায় এডিক্টিভ (নেশাগ্রস্ত করে) এবং বিষাক্ত পদার্থ (টক্সিক) হিসেবে পরিচিত। তামাকে একবার আসক্ত হলে ব্রেন বারবার এই নিকোটিন চায়। নিকোটিন না হলে ব্রেন কোনো কাজ করতে চায় না। ফলে ব্যবহারকারীকে তামাক ব্যবহার বাড়াতেই হয়।

ক্যান্সার নিয়ে কাজ করেন জাতীয় ক্যান্সার হাসপাতাল ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ডা: হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন। তিনি বলেন, তামাক ব্যবহারের ফলে ব্যবহারকারীর হার্টবিট বেড়ে যায়, বাড়ে উচ্চ রক্তচাপ (হাই ব্লাড প্রেশার)। তামাক ব্যবহারে যে ধোঁয়া বের হয়, তাতে থাকে উচ্চ বিষাক্ত পদার্থ কার্বন মনোক্সাইড। এই পদার্থটি রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা কমিয়ে দেয়। তাতে করে হার্ট (হৃৎপিণ্ড) কম মাত্রায় অক্সিজেন পায়। ধূমপানের কারণে হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোক হচ্ছে; কিন্তু অনেকে বুঝতেই পারে না। তামাকের কারণে প্রতি ১০ জনের একজনের হার্ট অ্যাটাক হচ্ছে।

বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর ৩৫.৩ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক তামাক ব্যবহার করে। ফলে তামাকজনিত রোগে বছরে দেশে এক লাখ ৬১ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। ২০১৯-এর গ্লোবাল বার্ডেন অব ডিজিজ স্টাডির তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে মৃত্যু ও পঙ্গুত্ববরণের প্রধান চারটি কারণের একটি তামাক ব্যবহার। তামাক কোম্পানিগুলো বিশ্বব্যাপী বছরে আট কোটি ৪০ লাখ টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গমন করে এবং ৬০ কোটি বৃক্ষনিধনের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তন, প্রাকৃতিক সম্পদ বিনষ্ট এবং ইকোসিস্টেমে ক্ষতি করে যাচ্ছে।

তামাকের ক্ষতি উপলব্ধি করে প্রধানমন্ত্রী ২০৪০ সালের মধ্যে দেশকে তামাকমুক্ত করার অঙ্গীকার করেছেন। এফসিটিসির সাথে সামঞ্জস্য রেখে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনেরও অঙ্গীকার করেছেন তিনি।

বাংলাদেশের তামাকবিরোধী সংগঠনগুলো তামাকের ব্যবহার কমানো এবং এর ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরে তামাক নিরুৎসাহিত করতে প্যাকেটের ৯০ শতাংশ সচিত্র সতর্কবার্তা প্রকাশের লক্ষ্যে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে ছয়টি সংশোধনী আনার প্রস্তাব দিয়েছে। জানা গেছে, এই ছয়টি প্রস্তাব নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে কয়েকটি বৈঠকও হয়েছে। তারা একটি খসড়াও তৈরি করেছেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আইন সংশোধনে অন্য মন্ত্রণালয়গুলোর মতামত চাইবে।

জিএসএইচএস ২০১৪ অনুসারে, বাংলাদেশে ১৩ থেকে ১৫ বছর বয়সী ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে তামাক ব্যবহারের হার ৯.২ শতাংশ। ২০১৯ সালে প্রকাশিত ‘ইকোনমিক কস্ট অব টোব্যাকো ইউজ ইন বাংলাদেশ : এ হেলথ কস্ট অ্যাপ্রোচ’ শীর্ষক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তামাক ব্যবহারের অর্থনৈতিক ক্ষতির (চিকিৎসা ব্যয় এবং উৎপাদনশীলতা হারানো) পরিমাণ ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা।

অধ্যাপক ডা: হাবিবুল্লাহ তালুকদার বলেন, ‘বাংলাদেশে আশঙ্কাজনক হারে তামাক ব্যবহার বাড়ছে। এটা ঠিক, তামাক কোম্পানি থেকে সরকার প্রচুর রাজস্ব সংগ্রহ করে; কিন্তু তামাকজনিত রোগে সরকারি ও ব্যক্তিগতভাবে যে অর্থ ব্যয় হয় তা যে টাকা রাজস্ব আসে তার চেয়ে বেশি। অর্থাৎ তামাক কোম্পানিকে পুষে সরকারের লাভ হয় না; বরং লোকসান হয়ে থাকে।’ তিনি বলেন, ‘সে কারণে তামাক নিরুৎসাহিত করার জন্য সব ধরনের আইন প্রণয়ন করতে হবে। তিনি বলেন, একটা গবেষণায় দেখা গেছে, তামাকজাতীয় পণ্যের প্যাকেটে বড় করে স্বাস্থ্য সতর্কতা ছাপানো হলে তা কম বয়সীদের মধ্যে প্রভাব ফেলে। তারা তামাকে নিরুৎসাহিত হয়ে থাকে।’

ভারতে সিগারেটের অথবা এ জাতীয় অন্যান্য পণ্যের প্যাকেটে ৮৫ শতাংশ জায়গাজুড়ে সচিত্র সতর্কবার্তা ছাপাতে হয়। নেপালে এই সচিত্র সতর্কবার্তা প্রকাশ করতে হয় প্যাকেটের ৯০ শতাংশ জুড়ে। বাংলাদেশের অবস্থা এখনো হাতাশাজনক, এখনো তামাক দ্রব্যের পণ্যের গায়ে মাত্র ৫০ শতাংশ জায়গাজুড়ে সতর্কবার্তা থাকে। বাংলাদেশে আবার তামাক কোম্পানিগুলো চাতুর্যের আশ্রয় নিচ্ছে। প্যাকেটের উপরের দিকে ৫০ শতাংশ জায়গাজুড়ে মুদ্রণে বাধ্যবাধকতা কোম্পানিগুলো তামাক দ্র্যব্যের প্যাকেটের নিচের অংশে সতর্কবার্তা ছাপিয়ে থাকে। সরকারি সংশ্লিষ্ট বিভাগের নজরদারির অভাবে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ তামাক সতর্ক বার্তায় সবার চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে।

বিশ্বের কয়েকটি দেশে তামাক পণ্যের গায়ে বড় করে সতর্কবাণী প্রকাশ করে। এর মধ্যে নেপাল ও মালদ্বীপ ৯০ শতাংশ, ভারত, থাইল্যান্ড ৮৫ শতাংশ, শ্রীলঙ্কা ৮০ শতাংশ, অস্ট্রেলিয়া ৮২.৫ শতাংশ, উরুগুয়ে ৮০ শতাংশ ও তুরস্ক ৯২.৫ শতাংশ। বাংলাদেশ এসব দেশকে অনুসরণ করতে পারে।