জ্বালানি তেলের দাম ৫ টাকা হ্রাস : বাজার-গণপরিবহণে প্রভাব পড়েনি

জ্বালানি তেলের দাম ৫ টাকা হ্রাস : বাজার-গণপরিবহণে প্রভাব পড়েনি

জ্বালানি তেলের দাম কমার প্রভাব পড়ছে না কোথাও। রেকর্ড পরিমাণ দাম বাড়ার ২৩ দিন পর লিটারে ৫ টাকা কমানোয় হতাশ সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। তারা বলছেন, এতে কমছে না বাসের ভাড়া ও নিত্যপণ্যের দাম। দেখানো হচ্ছে নানা অজুহাত। কিন্তু তেলের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্তের কথা শুনলেই দ্রুত বেড়ে যায় সবকিছু। কার্যকর সংক্রান্ত আদেশের জন্য অপেক্ষা করে না। মঙ্গলবার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিন বাজার এবং গণপরিবহণে সাধারণ মানুষের সঙ্গে আলাপ করে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।

এদিন রাজধানীর গাবতলী এলাকায় একটি পেট্রোল পাম্পে তেল নিতে আসা মোটরসাইকেল আরোহী জীবন রহমান বলেন, বর্তমান দাম সমন্বয়ে তেমন একটা লাভ হচ্ছে না। হয়তো মোটরসাইকেলে লিটারপ্রতি ৫ টাকা সাশ্রয় হচ্ছে। কিন্তু বাজারে তো জিনিসপত্রের দাম আগের মতোই আছে। কমার তো কোনো লক্ষণ নেই। যেখানে লিটারপ্রতি ডিজেল ও কেরোসিনে ৩৪ টাকা, অকটেনে ৪৬ টাকা আর পেট্রোলে দাম বেড়েছিল ৪৪ টাকা পর্যন্ত। সেখানে মাত্র ৫ টাকা কমানো মোটেই ঠিক হয়নি।

মিরপুর কাঁচাবাজারে গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তেলের দাম কমানোর কারণে জিনিসপত্রের দামে কোনো প্রভাব পড়েনি। বাজারের ব্যবসায়ী তমিজ উদ্দিন বলেন, সত্যি কথা বলতে, একবার দাম বাড়লে তা আর কমে না। তেলের দাম ৫ টাকা কমিয়েছে সরকার। গাড়ি ভাড়া তো নিচ্ছে আগের মতোই। পরিবহণ খরচ কমানোর কোনো লক্ষণ নেই। আমরা তো আর লস দিয়ে পণ্য বিক্রি করতে পারব না। এখন যে পরিমাণ লাভ হয়, বরং দ্রব্যমূল্য বাড়ার আগে এর চেয়ে বেশি লাভ হতো। এখন যে পরিমাণ চালান খাটাতে হয়, সেই পরিমাণ লাভ হয় না বলে দাবি তার।

তার কথায় একমত পোষণ করেন ওই বাজারের একাধিক ব্যবসায়ী। তারা বলেন, চলতি মাসের ৫ তারিখ রাতে হঠাৎ ঘোষণায় বাড়ে জ্বালানি তেলের দাম। লিটারপ্রতি সর্বোচ্চ ৪৬ টাকা দাম বাড়ানোর প্রভাব পড়ে বাজারে। মুহূর্তেই হু-হু করে বাড়তে থাকে সব পণ্যের দাম। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি তথা জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ার চাপে সাধারণ মানুষের দিশেহারা অবস্থা। যে কারণে আগের চেয়ে বেচাবিক্রিও কমে গেছে বলে দাবি করেন বাজারের ব্যবসায়ী জামির আলি।

এদিকে মঙ্গলবার গণপরিবহণেও দেখা গেছে যাত্রীদের সঙ্গে পরিবহণ শ্রমিকদের ভাড়া নিয়ে বচসা। আগের রাতে ডিজেলের দাম কমেছে লিটারে ৫ টাকা। তাই বাস ভাড়া তো কমা উচিত-এই যুক্তি দিচ্ছিলেন কামাল হোসেন। তিনি মিরপুর ১ নম্বর থেকে উঠেছিলেন ডেমরাগামী অছিম পরিবহণের বাসে। কুড়িল বিশ্বরোড পর্যন্ত কামাল হোসেনের গন্তব্যের ভাড়া ৩০ টাকা। তিনি টাকাটা বের করে দিয়ে হেলপারের সঙ্গে ভাড়া কমানোর যুক্তি দিচ্ছিলেন। হেলপার জানান, এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। কমেছে মাত্র ৫ টাকা। আর সিদ্ধান্ত এলেই বা কয় টাকা কমাতে পারব। কামাল হোসেনসহ বাসের অন্য যাত্রীরা বলেন, তেলের দাম বাড়লেই কোনো ঘোষণার আগেই ভাড়া বাড়ে। আর দাম কমলেও তারা এখন সিদ্ধান্তের অপেক্ষা করছে। এ সময় হেলপার জলিল বলেন, ডিজেলে বেড়েছিল লিটারে ৩৪ টাকা। কমেছে মাত্র ৫ টাকা। এতে আর ভাড়া কতটুকু কমানো সম্ভব। যাত্রীরা বলছেন, লিটারে ৫ টাকা কমিয়েছে, এ অজুহাতে যদি ভাড়া কমানো হয়, তা কোনোভাবেই কার্যকর হবে না। আর পরিবহণ শ্রমিক ও চালকরা বলছেন, যদি অন্তত লিটারে ১৫ টাকা কমাত, তবে একটা কথা ছিল। এত বাড়িয়ে মাত্র ৫ টাকা কমানোতে তারা ভাড়া কমবে বলে মনে করছেন না। সরকার ও মালিক সমিতি যদি ভাড়া কমানোর সিদ্ধান্ত নেয়, তবে আপনারা কম ভাড়া নেবেন না কেন, এমন প্রশ্নের জবাবে প্রজাপতি পরিবহণের শ্রমিক রাজু বলেন, মালিকরা যে ঘোষণা দেয়, সেই ঘোষণা তো তারা নিজেরাই মানে না। তিনি বলেন, ওয়েবিল বন্ধের ঘোষণা দেওয়া হলো। ওয়েবিল তো বন্ধ হয়নি। যাও দুয়েকটি পরিবহণে কিছুদিন বন্ধ রাখা হয়েছিল, গত ২৩ আগস্ট থেকে তা কার্যকর করা হয়েছে। তিনি বলেন, সরকারের কোনো নির্দেশনা মানে মালিকপক্ষ। সব দোষ গাড়ির চালক-হেলপারের।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ মালিক সমিতির মহাসচিব খোন্দকার এনায়েত উল­াহ বলেন, আমরা আগেই বলেছি, তেলের দাম বাড়ায় ভাড়া বাড়িয়েছি। দাম কমলে ভাড়া কমাব। এখন এর প্রভাবে ভাড়া কতটা কমবে তা বিআরটিএ বলতে পারবে। ওয়েবিলের বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা এখনো চেষ্টা করছি ওয়েবিল বন্ধ করতে। বাংলাদেশ ট্রাক কাভার্ডভ্যান ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মোতালেব বলেন, এই দাম কমানোর বিন্দুমাত্র প্রভাব জনজীবনে পড়বে না। আগে বাড়ানো হয়েছে অনেক টাকা, এখন কমালো মাত্র ৫ টাকা। তাহলে এর কী প্রভাব পড়বে। যদি প্রতি লিটার ডিজেল ১০০ টাকার মধ্যেও আনা যেত তবে এর প্রভাব পড়ত। তিনি বলেন, পণ্য পরিবহণের নিয়মটা ভিন্ন। সরকার ওভাবে ভাড়া নির্ধারণ করে দেয় না। পণ্য পরিবহণের চাহিদা বেড়ে গেলে ট্রাক ভাড়া বেড়ে যায়। অর্ডার কমে গেলে ভাড়াও কমে যায়। ট্রাকচালক আমির হোসেন বলেন, তেলের দাম কমানোর ফলে ঢাকা থেকে ময়মনসিংহের দূরত্বে আসা-যাওয়ায় তেল খরচ বড়জোর ৫শ টাকা বাঁচবে। কিন্তু সময়ে সময়ে ট্রাক-কাভার্ড ভ্যানের ভাড়া ২-৩ হাজার টাকা ওঠানামা করে। আগে এ দূরত্বে জ্বালানি খরচ ৭০০০ টাকা লাগলে এখন লাগবে সাড়ে ৬ হাজার টাকা। এটা আমাদের কাছে কিছু না। এদিকে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, ‘তেলের দাম ৫ টাকা কমিয়ে সরকার জনগণের সঙ্গে মশকারা করল।’ এতে জনগণের কোনো লাভ হবে না। লাভ হবে পরিবহণ মালিকদের। তিনি বলেন, ‘ভাড়া হয়তো ২-৩ পয়সা কমিয়ে নির্ধারণ হবে। অতীত অভিজ্ঞতা বলে, তা কার্যকর হবে না। তাছাড়া এতে দ্রব্যমূল্য তো কমার কোনো সম্ভাবনাই নেই। এটি জনগণকে বুঝ দেওয়ার জন্য তামাশা মাত্র।’-যুগান্তর