পরিকল্পনাহীন উন্নয়ন বছরজুড়েই ঢাকা যেন দুর্ভোগের নগরী

পরিকল্পনাহীন উন্নয়ন বছরজুড়েই ঢাকা যেন দুর্ভোগের নগরী

বছরজুড়েই রাজধানীতে চলছে উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ। গড়ে উঠছে নানা অবকাঠামো। নেয়া হয়েছে একাধিক মেগা প্রকল্প। এর মধ্যে মেট্রোরেল, বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি), এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মতো মেগা প্রকল্পের কাজ চলছে দীর্ঘদিন ধরেই। এসবের কোনোটিরই কাজ নির্ধারিত সময়ে শুরু কিংবা নির্ধারিত সময়ে শেষ হয়নি। বরং একই প্রকল্পের কাজ চলছে বছরের পর বছর। এসব প্রকল্পের ব্যয় ও সময় বাড়িয়ে নগরবাসীর ভোগান্তিও করছে দীর্ঘ। প্রাথমিক সম্ভাব্যতা যাচাই- বাছাই করে প্রকল্প নির্মাণের উদ্যোগ নিলেও বিভিন্ন সময়ে পরিবর্তন হয়েছে নকশা। এতেই থমকে যাচ্ছে উন্নয়ন। অন্যদিকে সঠিক পরিকল্পনা ও সমন্বয়ের অভাবে গত কয়েক বছরেও শুরু হয়নি বেশকিছু প্রকল্পের কাজ।

ইউটার্ন, ইউলুপ, সিগন্যাল বাতি, ফুটপাথ, ফুটওভারব্রিজ, ড্রেনেজ ব্যবস্থার কাজ চলমান থাকলেও নেই কোনো সমন্বয়। সেবাদাতা সংস্থাগুলোর একক কর্তৃত্বে রাজধানীর সমস্যা হচ্ছে প্রকট। মেট্রোরেল, বিআরটি ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন, ঢাকা ওয়াসা, তিতাস গ্যাস, ডিপিডিসি, ডেসকো নিজের মতো করছে খোঁড়াখুঁড়ি। এতে দুর্ভোগের মাত্রা বাড়লেও সমাধানে উদ্যোগী হচ্ছে না কোনো পক্ষই।
এদিকে চলতি বছরের ডিসেম্বরে মেট্রোরেলের উত্তরা থেকে আগারগাঁও অংশ চালু হওয়ার কথা রয়েছে। যদিও এই অংশের কাজ পুরোপুরি শেষ হয়নি এখনো। রাজধানীর মতিঝিল পর্যন্ত কাজ চলছে পুরোদমে। ২০ দশমিক ১ কিলোমিটার মেট্রোরেল নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদন পায় ২০১২ সালে। এরপর ২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রী এমআরটি-৬ প্রকল্পের নির্মাণকাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। ২০১৭ সালের ২রা আগস্ট এমআরটি-৬ এর স্টেশন ও উড়ালপথ নির্মাণের আনুষ্ঠানিক সূচনা হয়। তখন থেকেই ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন মিরপুর থেকে মতিঝিল রুটের যাতায়াতকারীরা। বর্তমানে মেট্রোরেল নির্মাণকাজ শেষ পর্যায়ে হলেও ভোগান্তি কমেনি। এরই মধ্যে খোঁড়াখুঁড়ি চালাচ্ছে ঢাকা পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ (ওয়াসা) ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন, তিতাস গ্যাস, ডিপিডিসি, ডেসকো। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার সড়কে সারা বছরই চলে এই কর্মযজ্ঞ। গত কয়েক বছর ধরে চলছে রাজধানীর রোকেয়া সরণির একটি অংশের খননকাজ।

এতে এই রুটে প্রতিদিনই বাড়ছে যানজট। বাড়ছে দুর্ঘটনার ঝুঁকি। খোঁড়াখুঁড়ির কারণে গত ৯ মাস ধরে এ রাস্তার একপাশ দিয়েই চলাচল করছে হালকা ও ভারী যানবাহন। সূত্র জানায়, প্রকল্পের আওতায় রোকেয়া সরণিতে পয়ঃনিষ্কাশন নালা নির্মাণে কাজ করেছিল ঢাকা ওয়াসা। তবে ২০২০ এর ডিসেম্বরে চলমান প্রকল্পের উন্নয়ন কাজ বন্ধ করে দেয় ঢাকা ওয়াসা। এরপরে পয়ঃনিষ্কাশনের দায়িত্ব পায় সিটি করপোরেশন। তখন সড়কে নালার বাকি কাজ করতে ঠিকাদার নিয়োগ করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। সে সময় কাজ শুরু করে পাইপ বসাতে খোঁড়া হয় রাস্তা। খোঁড়াখুঁড়ি চলাকালে আদালতে মামলা করেন ওয়াসার আওতায় কার্যাদেশ পাওয়া ঠিকাদাররা। এতেই আটকে যায় উন্নয়নকাজ। পরবর্তীতে সিটি করপোরেশনের মেয়র বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করেও একাধিক বার ব্যর্থ হন। পরে আদালতের আশ্রয় নিলে গত জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে আদালত এ স্থগিতাদেশ তুলে নেয়। এর পরেও কাজ শেষ করতে পারেনি সিটি করপোরেশন। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলছেন, কাজ শুরুর পর আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকায় দীর্ঘদিন ধরে কাজ করতে পারেনি সিটি করপোরেশন। এতে মিরপুরসহ আশেপাশের মানুষ নানাভাবে ভোগান্তির শিকার হয়েছেন। তবে এখন আর কোনো বাধা নেই। দ্রুত কাজ শেষ করতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আশা করি কয়েক মাসের মধ্যেই কাজ শেষ করতে পারবো। এদিকে মেয়রের নির্দেশনার পরেও কাজে কোনো পরিবর্তন হয়নি। উল্টো আগের মতোই প্রতিনিয়ত ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন কয়েক লাখ মানুষ।

এদিকে চলাচলে দুর্ভোগ লেগেই আছে রাজধানীবাসীর। কখনো পানির লাইন, কখনো গ্যাস লাইন, ড্রেন সংস্কারের কাজ। বছরজুড়ে খোঁড়াখুঁড়ির কারণে নগরবাসীর মুক্তি মিলছেই না। রাজধানীর বাংলামোটর থেকে মগবাজার মোড় সড়কে চলছে ড্রেন সংস্কারের কাজ। কাজটি চলতি বছরের জুলাই মাসে শেষ হওয়ার কথা। তবে আগস্টের শেষেও কাজ শেষ করতে পারেনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। জানা যায়, ৬ মাসের বেশি সময় ধরে চলছে ড্রেন সংস্কারের কাজ। সিটি করপোরেশন ঠিকাদারদের সময় বেঁধে দিলেও তা মানা হচ্ছে না। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে মাইসা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজটি শুরু করে। যা এখনো চলামান রয়েছে। ফলে প্রতিদিনই লাখ লাখ মানুষের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। নির্মাণকাজের জন্য রাস্তা সরু হয়ে তীব্র যানজট দেখা দিচ্ছে। দুর্ভোগ শুধু এখানেই সীমাবদ্ধ নয়। রাজধানীর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এলাকা আগারগাঁও, শিশুমেলা মোড়। সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ সড়কে অন্তত ৩০টির মতো সরকারি অফিস, বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ১২টি সরকারি হাসপাতাল।

সেখানেও ২০২১ সাল থেকে চলছে উন্নয়ন প্রকল্প। সড়কটি যাতায়াতের জন্য প্রশস্ত করা দরকার। ১৪০০ মিটারের ছয় লেনের সড়কটি ২০২১ সালের জুলাই মাসে কাজ শুরু হয়। চলতি বছরের মার্চে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখনো শেষ হয়নি। এতে প্রতিদিন লাখ মানুষ অসুস্থ রোগী নিয়ে এই পথে যাতায়াত করেন। ধুলোবালিতে অতিষ্ঠ তারা। এদিকে ফার্মগেট, কাওরান বাজার, গুলশান, মহাখালী, বাড্ডা, রামপুরা, মালিবাগ, মতিঝিল, লালবাগ, পুরাতন ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় খোঁড়াখুঁড়িতে মেতেছেন সরকারের সেবা খাতের উন্নয়ন সংস্থাগুলো। রাজধানীর বিমানবন্দর থেকে গাজীপুরের সড়কে নির্মিত বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট ‘বিআরটি’ প্রকল্পের কাজও চলছে অপরিকল্পিতভাবে। এতে প্রতিদিনই এই পথে লেগে থাকে তীব্র যানজট। কখনো সড়কে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকছে যানবাহন। রয়েছে নিরাপত্তার ঘাটতি। প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। ঘটেছে প্রাণহানিও। এদিকে বিআরটি’র ৪ বছরের প্রকল্প শেষ হয়নি ১০ বছরেও। এখন পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি হয়েছে ৮০ শতাংশের। প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়া নিয়ে রয়েছে অনিশ্চয়তা। বিআরটি চালু হলে এর সুফল মিলবে কিনা তা নিয়েও রয়েছে ধোঁয়াশা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সঠিক পরিকল্পনার অভাবেই উন্নয়ন প্রকল্পগুলো যথাসময়ে শেষ হচ্ছে না। প্রতিটি প্রকল্পে সময়ক্ষেপণ করে বাজেট বাড়ানো হচ্ছে। ব্যস্ততম সড়কে যেকোনো উন্নয়ন কাজ শুরু হলে মানুষের যাতায়াতে ভোগান্তি বাড়ে।

তবে বিআরটি’র এ প্রকল্পটি গত ৫/৬ বছর ধরে মানুষকে বেশি ভোগান্তিতে ফেলেছে। অপরিকল্পিতভাবে কাজ চলায় প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। এছাড়া ব্যস্ততম এই সড়কটি বিআরটি’র জন্য উপযুক্ত নয়। ফলে বিআরটি চালু হলে ভোগান্তি আরও বাড়বে। তেমন সুফলও মিলবে না। জানা যায়, ঢাকা ও গাজীপুর এলাকার যানজট নিরসনে ‘গ্রেটার ঢাকা সাসটেইনেবল আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট (বিআরটি, গাজীপুর-এয়ারপোর্ট) অনুমোদন পায় ২০১২ সালের ২০শে নভেম্বর। তখন এ প্রজেক্টের ব্যয় ধরা হয়েছিল ২ হাজার ৪০ কোটি টাকা। ২০১৬ সালের শেষদিকে কাজ শেষ হওয়ার কথা। তবে ২০২২ সালেও এই কাজ সমাপ্ত হয়নি। গত ১০ বছরে প্রকল্প এগিয়েছে মাত্র ৮০ শতাংশ। এতে ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ২৬৮ কোটি টাকায়। চলতি বছরের জুনে এ প্রকল্পের কাজ শেষ করার সংশোধিত সময়কাল নির্ধারণ করা হলেও সেই সময় অতিবাহিত হয়েছে। এখানো প্রায় ২০ শতাংশ কাজ বাকি রয়েছে। আগামী আরও এক বছরে কাজ শেষ হবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞ ও প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। তবে গত ২৬শে আগস্ট প্রকল্পের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শফিকুল ইসলাম বলেছেন, ২০ দশমিক ৫ কিলোমিটার উড়াল সেতু ও রাস্তার ফিজিক্যাল নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে ৭৯ দশমিক ২৪ শতাংশ। প্রকল্পের ফিজিক্যাল নির্মাণকাজ আরএসবি অংশের ১৬ কিলোমিটারের ৮২ দশমিক ৯ শতাংশ ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। অন্যদিকে বিএ অংশের সাড়ে ৪ কিলোমিটারের কাজ সম্পন্ন হয়েছে ৭২ দশমিক ৩৫ শতাংশ। সবমিলিয়ে মোট নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে ৭৯ দশমিক ৯ শতাংশ।

শতভাগ সক্ষমতা ব্যবহার করতে পারলে যথাসময়ে কাজ শেষ করা যাবে। আগামী জুনের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা রয়েছে। এদিকে সঠিক পরিকল্পনার অভাব ও সমন্বয়হীনতার কারণে বার বার সময় বাড়ছে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের প্রকল্পটি নির্মাণের প্রথম ট্রাঞ্চের কাজ অনেকটা দৃশ্যমান হলেও বাকি দুইটি নিয়ে রয়েছে নানা জটিলতা। বিমানবন্দর থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত দীর্ঘদিন ধরে কাজ চললেও নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতে পারেনি। এই অংশ চলতি বছরের ডিসেম্বরে চালু করার কথা থাকলেও তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। স্বয়ং প্রকল্প সংশ্লিষ্টরাই বলছেন রাজধানীর বিমানবন্দর থেকে তেজগাঁও অংশে এখনো অনেক কাজ বাকি। যা চলতি বছরে শেষ করা সম্ভব না। আগামী জুনের আগে এই অংশ খুলে দেয়া যাচ্ছে না। এদিকে দ্বিতীয় ট্রাঞ্চে রয়েছে বেশকিছু জটিলতা। নকশা অনুযায়ী কাজ শেষ করতে প্রয়োজন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ রেলওয়ে ও মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের সমন্বিত অনুমতি। জমি অধিগ্রহণ নিয়েও আছে জটিলতা। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি)’র সভাপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ মোহাম্মদ ফজলে রেজা সুমন মানবজমিনকে বলেন, রাজধানীতে অপরিকল্পিত উন্নয়ন হচ্ছে। এক একটি প্রকল্পের সঙ্গে অন্য প্রকল্পের কোনো সমন্বয় নেই। প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার কারণে নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতে পারছে না ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এছাড়া সারা বছর সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন এলাকায় খোঁড়াখুঁড়ি চলে। যা সিটি করপোরেশনের সঙ্গে সমন্বয় ছাড়াই। এতে প্রকল্প বাস্তবায়নে বাড়ছে সময় ও অর্থ। অন্যদিকে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। এখান থেকে উত্তোলনের জন্য সকল সেবাদাতা সংস্থাগুলোকে একটি নিয়মের মধ্যে আসতে হবে। নগরের উন্নয়নের জন্য সিটি করপোরেশন কিংবা সিটি মেয়রের সঙ্গে সমন্বয় অত্যন্ত জরুরি।