খরচের খাতায় আরেক ঘা

খরচের খাতায় আরেক ঘা

মহামারী করোনার প্রভাব কাটিয়ে যখন দেশ অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়ায় রয়েছে, যখন ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে অস্থিরতা ঠিক ওই সময়ে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি করা হয়। এরপর থেকে দেশে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে নাভিশ্বাসে জনজীবন। এ পরিস্থিতিতে এবার গ্রাহক পর্যায়ে দাম বাড়ানোর তোড়জোড় চলছে বিদ্যুৎ বিতরণ কোস্পানিগুলোতে। গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়লে সব কিছুতে এর প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষ করে মধ্যবিত্তরা আরেক দফা খরচের খাতা টেনে ধরতে বাধ্য হবে।

বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) কারিগরি কমিটি প্রতি কিলোওয়াট বিদ্যুতের খুচরা মূল্য ১ টাকা ১০ পয়সা বৃদ্ধির সুপারিশ করেছে। সেই হিসাবে খুচরা বিদ্যুতের মূল্য গড়ে ৭ টাকা ১৩ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৮ টাকা ২৩ পয়সা করার সুপারিশ করা হলো। এতে গড়ে বিদ্যুতের দাম বাড়তে পারে ১৫ দশমিক ৪৩ ভাগ। গতকাল রবিবার রাজধানীর বিয়াম ফাউন্ডেশনের শহীদ এ কে এম শামসুল হক খান অডিটরিয়ামে বিদ্যুতের দামবৃদ্ধি সংক্রান্ত গণশুনানিতে এ প্রস্তাবনা দেওয়া হয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পরিণতিতে আবারও দেশে সব জিনিসপত্রের দাম আরেক দফা বাড়বে। এ সময়ে গ্রাহক পর্যায়ে না বাড়ানোই উচিত হবে। বাজারের যে সার্বিক অবস্থা, গ্রাহক পর্যায়ে এখন বাড়ালে ভোক্তাদের ওপর দ্বিগুণ চাপ পড়বে।

গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর বিষয়ে শুনানিতে পিডিবির পক্ষ থেকে বলা হয়, প্রতি টন কয়লার দাম ২৩০ ডলার এবং প্রতি লিটার ফার্নেস অয়েলের দাম ৭০ টাকা হলে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দেওয়ার ক্ষেত্রে ৪০ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি প্রয়োজন হবে। কিন্তু বিইআরসি পাইকারি মূল্যবৃদ্ধিতে ১৭ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি নির্ধারণ করে দিয়েছে। কাজেই এই মূল্য কাঠামো ধরে দাম বাড়ানো হলে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দেওয়া সম্ভব হবে না।

শুনানিতে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) তাদের প্রস্তাবে জানায়, দাম না বাড়লে তাদের ক্ষতি হবে ১ হাজার ১২৭ কোটি টাকা। একইভাবে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) ২৩৪ কোটি, ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) ১ হাজার ৫৫১ কোটি, ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানির (ডেসকো) ১ হাজার ৪০২ কোটি টাকা, নর্দান ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানির (নেসকো) ৫৩৫ কোটি টাকা লোকসান হবে বলে দাবি করা হয়েছে। ওয়েস্টজোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ওজোপাডিকো) কোনো আর্থিক অঙ্ক দাঁড় না করালেও বলেছে, দাম না বাড়লে তাদের ক্ষতি হবে।

রাজধানীর নিউ মার্কেট এলাকার বাসিন্দা অর্ণব সরকার দেশ রূপান্তরকে বলেন, চার-পাঁচ বছর আগেও আমার দুই রুমের বাসায় বিদ্যুৎ বিল আসত ৪০০-৫০০ টাকা। গত দুই বছরে সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা। এখন যদি আবার গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয় তাহলে ২ হাজার টাকা বেশি গুনতে হবে। তিনি বলেন, কিছুদিন আগে জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে। ফলে পরিবহন ভাড়াসহ বাজারের সব জিনিসের মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছে। এই মুহূর্তে আবার বিদ্যুতের দাম বাড়লে আমাদের মতো মধ্যবিত্ত পরিবারে সংসার চালানো দায় হয়ে যাবে।

বছরের শুরুতে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি আত্মঘাতী বলে মনে করেন কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা শামসুল আলম। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়লে ২০২৩ সালের মূল্যস্ফীতিকে উসকে দেওয়া হবে। বিতরণ প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ইচ্ছামতো মুনাফা করার জন্য বিদ্যুতের দাম বাড়াতে চাচ্ছে। বিদ্যুৎ খাতের দুর্নীতি, সিস্টেম লস, অনিয়ম বন্ধে কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না সরকার। অন্যদিকে বিদ্যুতের দামবৃদ্ধির ফলে জনগণের কষ্ট বাড়ছে।

তিনি বলেন, সরকার বিদ্যুতের দামবৃদ্ধি করে যে টাকা আয় করবে তার কয়েকগুণ প্রভাব পড়বে। সরকারের ইন্টারনাল অনেক ধরনের ব্যয় আছে, সেটা অ্যাডজাস্ট করলেই মূল্যবৃদ্ধির বাইরে মোকাবিলা করা যায়। তিনি বলেন, করপোরেট ট্যাক্স সব সময় মুনাফা থেকে হয়। দাম বৃদ্ধি করে সেই টাকা সরকারকে দেওয়া হয়। আমরা বলেছি যে পরিমাণ করপোরেট ট্যাক্স সরকারকে দেবেন সেটা কমিয়ে দেন। তাহলে গ্রাহক পর্যায়ে একটা সমন্বয় হয়।

তবে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের চেয়ারম্যান আবদুল জলিল বলেন, বিতরণকারী সংস্থার প্রস্তাবের যৌক্তিকতা যাচাই-বাছাইয়ের পাশাপাশি অংশীজনদের মতামতের ভিত্তিতেই বিষয়টি চূড়ান্ত করা হবে। বিইআরসি আইন-২০০৩ এর ৫৪ ধারায় আমাদের ভোক্তার যে সব অভিযোগ, তা নিষ্পত্তির সুযোগ রয়েছে।

এদিকে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য নয় বলে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। বামজোটের সমন্বয়ক ও বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশিদ ফিরোজ দেশ রূপান্তরকে বলেন, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন নিয়ম রক্ষার্থে গণশুনানি করে। কার্যত তারা সরকারের প্রেসক্রিপশন বাস্তবায়ন করার প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। যদিও এটা একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। যখন পাইকারি পর্যায়ে বাড়িয়েছে তখন যদি ভোক্তা পর্যায়ে বাড়াত তাহলে ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে পড়বে বলে দাম বাড়ায়নি। এখন ঠিকই গ্রাহক পর্যায়ে দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা চলছে। বর্তমান যে সংকট সেখান থেকে বের হয়ে আসতে হলে নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে যেতে হবে। আমাদের যে গ্যাসক্ষেত্রগুলো আছে সেগুলোও সরকারের অদূরদর্শিতার কারণে কাজে আসেনি। তিনি বলেন, বর্তমান আর্থিক সংকটে সরকার দায়িত্বশীল হলে জনগণের ঘাড়ের বোঝা কমানোর চেষ্টা করত। মানুষের সুবিধা-অসুবিধার দিকে তাদের কোনো নজর নেই। বিদ্যুতের বর্ধিত মূল্য প্রত্যাহারের দাবি জানান তিনি।

সিপিবির সভাপতি মোহাম্মদ শাহ আলম ও সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স এক বিবৃতিতে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া বন্ধের দাবি জানিয়ে বলেন, ‘বিশেষজ্ঞরা প্রমাণ করেছেন, দুর্নীতি, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা রোধ করে বিদ্যুৎ খাতে ৩০ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব। অথচ এটি না করে জনগণের কাঁধে এই বোঝা চাপানো হচ্ছে।

বর্তমান চড়া মূল্যস্ফীতির সময়ে সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। এর মধ্যে বিদ্যুতের দাম বাড়লে উৎপাদন খরচসহ সব জায়গায় এর প্রভাব পড়বে, যা বিভিন্নভাবে সাধারণ মানুষের ওপর চাপানো হবে। তাই বিদ্যুতের দাম বাড়ানো কোনোভাবেই যৌক্তিক হবে না।’-দেশ রুপান্তর