আইএমএফের শর্ত

চলতি বছরেই জ্বালানি পণ্যে সব ধরনের ভর্তুকি প্রত্যাহার করতে হবে

চলতি বছরেই জ্বালানি পণ্যে সব ধরনের ভর্তুকি প্রত্যাহার করতে হবে

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে পাওয়া ঋণের বিপরীতে বিভিন্ন ধরনের শর্ত পরিপালন ও সংস্কার করতে হবে বাংলাদেশকে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির পরিমাণ কমিয়ে আনার মাধ্যমে সরকারের ব্যয় সক্ষমতা বাড়ানো। আইএমএফের শর্তানুসারে এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে জ্বালানি পণ্যের দাম সমন্বয়ে একটি সময়ভিত্তিক মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি চালু করতে হবে সরকারকে। এতে ঋণ কর্মসূচি চলাকালীন দেশে জ্বালানি পণ্যে কাঠামোগত ভর্তুকির পরিমাণ শূন্যে নামবে।

আইএমএফের অনুমোদিত ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার এ মাসের শুরুতেই বুঝে পেয়েছে বাংলাদেশ। প্রথম কিস্তির অর্থ দেয়ার পরই বহুজাতিক সংস্থাটি বাংলাদেশের ওপর বিশদ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে ঋণ পেতে কী ধরনের শর্ত পরিপালন ও সংস্কার করতে হবে সেগুলো বলা হয়েছে। আইএমএফ সরকারের ব্যয় সক্ষমতা বাড়াতে ভর্তুকির পরিমাণ যৌক্তিকীকরণ করতে বলেছে। এর আওতায় জ্বালানি পণ্যের দাম সমন্বয়ে একটি সময়ভিত্তিক মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি এ বছরের ডিসেম্বর শেষে চালু করতে হবে। বাংলাদেশকে ঋণসহায়তা দেয়ার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের সময় এটি পর্যালোচনা করে দেখবে আইএমএফ। এটিকে অতি জরুরি হিসেবে উল্লেখ করেছে সংস্থাটি। বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ক্লাইমেট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট রিপোর্টেও (সিসিডিআর) জ্বালানির মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতির মতো সংস্কারমূলক পদক্ষেপকে মধ্যম পর্যায়ের সম্ভাব্যতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

জ্বালানি পণ্যের দামের বিষয়ে আইএমএফ বলছে, আন্তর্জাতিক বাজারদরের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সাম্প্রতিক সময়ে জ্বালানি পণ্যের দাম বাড়ানো হয়েছে। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে গ্যাস ও বিদ্যুতে দেয়া ভর্তুকির পরিমাণ মোট দেশজ উৎপাদনের শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। ঋণ কর্মসূচি চলাকালে সময়ভিত্তিক জ্বালানির দাম সমন্বয় পদ্ধতি সরকারকে জ্বালানি পণ্যে কোনো ধরনের কাঠামোগত ভর্তুকি প্রদান না করার বিষয়ে সাহায্য করবে। সামাজিক সুরক্ষা জাল শক্তিশালী করার সময় সরকার ধাপে ধাপে গ্যাস ও বিদ্যুতের ভর্তুকি কমানোর উপায় খুঁজে বের করবে। সাম্প্রতিক সময়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোকে স্বাগত জানিয়েছে আইএমএফ।

জীবাশ্ম জ্বালানিতে ভর্তুকির বিষয়ে আইএমএফ বলছে, জলবায়ু প্রশমন বিস্তৃত করতে বাংলাদেশ জীবাশ্ম জ্বালানির স্বচ্ছ বাজারভিত্তিক দর নির্ধারণের দিকে হাঁটতে শুরু করেছে। বৈশ্বিক কমোডিটি মূল্যবৃদ্ধির প্রতিফলন হিসেবে গ্যাস ও বিদ্যুতে ভর্তুকির পরিমাণ ২০২০-২১ অর্থবছরে জিডিপির শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরে শূন্য দশমিক ৯ শতাংশে উন্নীত হবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে ভর্তুকির পরিমাণ বিদ্যুতে জিডিপির শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ এবং প্রাকৃতিক গ্যাসে জিডিপির শূন্য দশমিক ৩ শতাংশে দাঁড়াবে। যদিও চলতি অর্থবছরের বাজেটে বিদ্যুতে জিডিপির শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ এবং প্রাকৃতিক গ্যাসে জিডিপির শূন্য দশমিক ২ শতাংশ ভর্তুকি দেয়ার কথা বলা হয়েছিল। বাজেটের ওপর চাপ কমাতে সরকার গত বছরের আগস্টে পেট্রল ও অকটেনের দাম ৫০ শতাংশের মতো বাড়িয়েছে। ২০২১ সালের নভেম্বরে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ২৩ শতাংশ বাড়ানোর পর গত বছরের নভেম্বরে এর দাম ৩৬ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এ উদ্যোগ দেশে জীবাশ্ম জ্বালানির দাম আন্তর্জাতিক বাজারদরের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে সাহায্য করেছে। ২০২২ সালের জুনে প্রাকৃতিক গ্যাসের ট্যারিফ গড়ে ২৩ শতাংশ এবং বিদ্যুতের বাল্ক ট্যারিফ গত বছরের নভেম্বরে ২০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। সরকার একটি সূত্রভিত্তিক দর নির্ধারণ পদ্ধতির মাধ্যমে ধারাবাহিকভাবে জ্বালানি পণ্যের দাম সমন্বয়ের পরিকল্পনা নিয়েছে। এর মাধ্যমে জ্বালানি পণ্যে কাঠামোগত ভর্তুকির পরিমাণ শূন্যে নেমে আসবে। এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে জ্বালানি খাতে সরকারের ভর্তুকির জন্য বাজেটের ওপর চাপ কমবে এবং জ্বালানির আরো বেশি সাশ্রয়ী ব্যবহার উৎসাহিত করবে। এছাড়া বৈশ্বিক পর্যায়ে পরবর্তী মূল্যবৃদ্ধি ব্যতীত আইএমএফের ঋণ কর্মসূচি চলাকালে সরকার এসব ভর্তুকির পরিমাণ আর বাড়াবে না বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এবং সামাজিক সুরক্ষা স্কিম বিস্তৃত করার সময় ভর্তুকির পরিমাণ ধাপে ধাপে কমিয়ে আনার সুযোগ খুঁজবে।

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) চেয়ারম্যান এবিএম আজাদ বণিক বার্তাকে বলেন, জ্বালানির দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে আইএমএফ যে শর্ত দিয়েছে, বিপিসির দিক থেকে এটি নিয়ে বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। দর সমন্বয়ের বিষয়টি একটি জটিল প্রক্রিয়া। সরকার এটি নিয়ে কাজ করছে। আমাদের দিক থেকে এ বিষয়ে সরকারকে প্রয়োজনীয় সহায়তা করা হচ্ছে। তবে এটি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। বৈশ্বিক জ্বালানির বিদ্যমান বাজারদরের প্রেক্ষাপটে এটি এখন যুক্তিসংগত হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে জানান তিনি।

আইএমএফের সঙ্গে করা ঋণ চুক্তি স্মারকে সাম্প্রতিক সময়ে জ্বালানি পণ্য, প্রাকৃতিক গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর বিষয়টি উল্লেখ করে বাংলাদেশ সরকার জানিয়েছে, এতে করে বিপিসিকে বাজেট সহায়তা দেয়ার বিষয়টি আমরা প্রত্যাশা করছি না। প্রাকৃতিক গ্যাস ও বিদ্যুতে দেয়া ভর্তুকির পরিমাণ চলতি অর্থবছরে বাড়লেও তা জিডিপির শূন্য দশমিক ৯ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। জ্বালানি পণ্যে সব ধরনের কাঠামোগত ভর্তুকি বন্ধে সরকারের পরিকল্পনা রয়েছে এবং এজন্য একটি সময়ভিত্তিক দর সমন্বয় পদ্ধতি চালু করা হবে। অধিকন্তু ভর্তুকির পরিমাণ আরো কমাতে বিদ্যুতের দাম সমন্বয়ে নজর দেয়া হবে।

গত মাসে বিদ্যুৎ ভবনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানান, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২২-এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে প্রতি মাসে জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম সমন্বয়ে সরকার একটি কৌশল নির্ধারণ করেছে। গত মাসেই আরেক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, এখন থেকে প্রতি মাসে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম সমন্বয় করা হবে। শুরুতে অল্প অল্প করে সমন্বয়ের মাধ্যমে সরকার ভর্তুকি থেকে বেরিয়ে আসবে।

জ্বালানি পণ্য ও বিদ্যুতে ভর্তুকি কমাতে ধাপে ধাপে দাম সমন্বয় করা হবে উল্লেখ করে আইএমএফ বলছে, প্রকৃতপক্ষে এরই মধ্যে সরকার এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে। এ বছরের জানুয়ারিতে সরকার খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের গড় মূল্য ৫ শতাংশ এবং সব ধরনের গ্রাহকের ডিমান্ড চার্জ ৪২ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়েছে। এ বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে শিল্প, বিদ্যুৎ উৎপাদন, হোটেল ও রেস্টুরেন্টের জন্য গ্যাসের বর্ধিত দাম কার্যকর হবে। আইএমএফের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে বিভিন্ন ধরনের তথ্য, উপাত্ত ও পরিসংখ্যান কখন কীভাবে প্রকাশ করতে হবে সে বিষয়েও শর্ত দেয়া হয়েছে। এতে দেখা যায়, বিপিসি, মেঘনা পেট্রোলিয়াম, পদ্মা অয়েল কোম্পানি ও যমুনা অয়েল কোম্পানির ব্যাংক আমানতের তথ্য মাসিক ভিত্তিতে প্রকাশ করতে হবে। মাস শেষ হওয়ার ছয় সপ্তাহের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংককে এ তথ্য প্রকাশ করতে হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বণিক বার্তাকে বলেন, সম্প্রতি সরকার যে হারে জ্বালানির দাম সমন্বয় করেছে তাতে এটি বৈশ্বিক দামের প্রায় সমপর্যায়ে চলে এসেছে। ফলে আগামী অর্থবছরের বাজেটে সরকারকে ভর্তুকি কমাতে তেমন একটা বেগ পেতে হবে না। পাশাপাশি বিদ্যুৎ ও গ্যাসের ভর্তুকিও কমিয়ে আনতে হবে। এটা কমিয়ে আনা হলেই দেশের জন্য ভালো।

প্রসঙ্গত, এ বছরের ৩০ জানুয়ারি আইএমএফের নির্বাহী বোর্ডের সভায় বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ দেয়ার প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। সাত কিস্তিতে ৪২ মাসে এ ঋণ পাবে বাংলাদেশ। ঋণের গড় সুদের হার ২ দশমিক ২ শতাংশ। ৪৭০ কোটি ডলারের মধ্যে দুই ধরনের ঋণ রয়েছে। বর্ধিত ঋণ সহায়তা বা বর্ধিত তহবিল (ইসিএফ অ্যান্ড ইএফএফ) থেকে পাওয়া যাবে ৩৩০ কোটি ডলার। রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি ফ্যাসিলিটির (আরএসএফ) আওতায় পাওয়া যাবে ১৪০ কোটি ডলার। ২০২৬ সাল পর্যন্ত এ ঋণ কর্মসূচি চলাকালে বাংলাদেশ সরকারকে বিভিন্ন ধরনের শর্ত পরিপালন ও সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে হবে। ঋণ প্রস্তাব অনুমোদনের পর এক বিবৃতিতে আইএমএফ জানায়, বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা রক্ষা, সামাজিক ও উন্নয়নমূলক ব্যয়ে সক্ষমতা তৈরিতে প্রয়োজনীয় সংস্কার করা, আর্থিক খাত শক্তিশালী করা, নীতি কাঠামো আধুনিক করে তোলা এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার কাজে এ ঋণ সাহায্য করবে।-বণিক বার্তা