মালয়েশিয়া রুটে বিমান টিকিট সিন্ডিকেট

মালয়েশিয়া রুটে বিমান টিকিট সিন্ডিকেট

ঢাকা-মালয়েশিয়া রুটে বিমান টিকিটের দাম আকাশচুম্বী হচ্ছে। কী কারণে এই রুটের বিমান ভাড়া নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে, তা নিয়ে টেনশনে সময় পার করছেন জনশক্তি ব্যবসার সাথে সম্পৃক্তরা। গত সপ্তাহেও ঢাকা-কুয়ালালামপুর রুটে চলাচলকারী একটি এয়ারলাইন্সের ওয়ানওয়ের টিকিটের ভাড়া অনলাইনে দেখাচ্ছিল লাখ টাকার ওপরে।

অভিযোগ রয়েছে, অভিনব কৌশল অবলম্বন করে এবার বিমান টিকিট সিন্ডিকেটের সদস্যরা এয়ারলাইন্সগুলোর সাথে যোগসাজশ করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। এর আগে এই চক্রের অপতৎপরতা ঠেকাতে ট্র্যাভেল এজেন্টদের সংগঠন আটাবের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিমান ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রীসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোতে লিখিত অভিযোগ দেয়া হয়। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি।

সম্প্রতি দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা মালয়েশিয়ার সম্ভাবনাময় শ্রমবাজারটি আবারো খোলা হয়। কিন্তু অভিবাসন ব্যয়ের একটি বড় অংশ টিকিট কিনতে ব্যয় হচ্ছে। শ্রমবাজারটি সচল রাখতে আকাশপথের যাত্রীদের জন্য টিকিট সিন্ডিকেটের অনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ হওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। নতুবা উচ্চ অভিবাসন ব্যয়ের কারণে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন হাজারো অভিবাসন ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টরা।

গত সপ্তাহের একদিনের ঢাকা-কুয়ালালামপুর রুটে চলাচলকারী শ্রীলঙ্কা এয়ারলাইন্স, মালিন্দ্য এয়ার, সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সগামী ফ্লাইটের পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখা যায়, ঢাকা থেকে ১৩ ঘটিকায় ছেড়ে শ্রীলঙ্কায় ৯ ঘণ্টার ট্রানজিটের শেষে কুয়ালালামপুর পৌঁছতে একজন যাত্রীর (২৫ কেজি মালামালসহ) ওয়ানওয়ে টিকিটের দাম দেখাচ্ছিল তিন হাজার ৫.১৪.৪৭ আরএম (মালয়েশিয়ান রিংগিট। যা বাংলা টাকায় ৯৪ হাজার ৮৭৮ টাকা। মালিন্দ্য এয়ারের যে ফ্লাইটটি ঢাকা থেকে রাত ১টা ১০ মিনিটে ছেড়ে ৩ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট উড়ে সরাসরি মালয়েশিয়ার স্থানীয় সময় সকাল ৬টা ৫৫ মিনিটে পৌঁছবে সেই ওয়ানওয়ে টিকিটের মূল্য দেখাচ্ছিল ৩ হাজার ৮’শ ৩২ রিংগিট। এক রিংগিট ২৭ টাকা হিসাবে ধরলে বাংলাদেশী টাকায় মূল্য হয় এক লাখ ৩ হাজার ৪৬৪ টাকা। একইভাবে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের পৃথক দুটি ফ্লাইট ঢাকা থেকে ছাড়ার সময়ের হিসাবে টিকিটের মূল্য দেখাচ্ছে (৭ এবং ১৭ ঘণ্টার ট্রানজিটসহ) ৬ হাজার ১’শ ৯৫ রিংগিট। যা একজন যাত্রীর ক্ষেত্রে বাংলাদেশী টাকায় বিমান টিকিটের দাম পড়ছে এক লাখ ৬৭ হাজার ২৬৫ টাকা। এই মুহূর্তে ঢাকা কুয়ালালামপুরে যাতায়াতকারী যেকোনো পেশার যাত্রীদের জন্যই টিকিটের দাম এরকমই অনলাইনে শো করছে বলে জানিয়েছেন টিকিট ব্যবসার সাথে সম্পৃক্তরা।

গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে ফকিরাপুলের শতাব্দী সেন্টারের দ্য মাগুরা অ্যাসোসিয়েটের স্বত্বাধিকারী এবং মালয়েশিয়া আওয়ামী লীগের আহবায়ক রেজাউল করিম রেজার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, করোনা শেষে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খোলার পর আমরা যারা এখন ব্যবসা করছি তারা বিমানের টিকিটের আকাশচুম্বী দামের কারণে মহাটেনশনে সময় পার করছি। যদি তাৎক্ষণিক কোনো শ্রমিকের জন্য কারো টিকিটের প্রয়োজন পড়ে তাহলে কমপক্ষে ৭০ হাজার টাকা থেকে এক লাখেরও বেশি টাকা খরচ করেই টিকিট কিনতে হচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে সরাসরি গরিব শ্রমিকদের ওপরে। এসব আমাদের সরকারের সংশ্লিষ্টরা তো দেখছেন। আমি তাদের কাছে অনুরোধ করবো, দ্রুত এই সিন্ডিকেট চক্রে কারা রয়েছে তাদের খতিয়ে চিহ্নিত করার জন্য। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদেরও অনুরোধ জানাবো কেন এই রুটে বিমানের টিকিটের দাম এত বাড়ছে? এই চক্রকে দ্রুত উৎখাত করার জন্য তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী ছাড়াও বিমান ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মহোদয়কে অনুরোধ করবো দ্রুত আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক করে হলেও বিমান টিকিট সিন্ডিকেটকে নির্মূল করার পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য। এক প্রশ্নের জবাবে রেজাউল করিম আরো বলেন, সিন্ডিকেটের সদস্যরা বাল্ক টিকিট ক্রয় করে সেগুলো পরবর্তীতে রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকদের কাছে বেশি দামে বিক্রি করছে। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, আমাদের যাত্রীর ফ্লাইট ডেট ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ অথবা মার্চের প্রথমে। সেই টিকিট আমাদেরকে যাত্রার দেড় থেকে দুই মাস আগেই বাড়তি দামে কিনতে হচ্ছে। অথচ ঢাকা-কুয়ালালামপুর রুটের বিমানের টিকিটের দাম সর্বোচ্চ ২৫ থেকে ২৬ হাজার টাকার বেশি ছিল না আগে।

গতকাল বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের মার্কেটিং অ্যান্ড সেলসের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নয়া দিগন্তকে বলেন, মালয়েশিয়া রুটে বিমানের ফ্রিকোয়েন্সি না পাওয়ায় ফ্লাইট বাড়ানো যাচ্ছে না। এর ফলে প্রতিদিন এই রুটে চলাচলকারী বিমানের একটি এয়ারক্রাফট দিয়েই (কখনো বোয়িং ৭৩৭ আবার কখনো ৭৮৭ ড্রিমলাইনার) ফ্লাইট চালাচ্ছি আমরা। তিনি বলেন, আমাদের বিমানের ওয়ানওয়ে টিকিটর দাম শুরু হয় ২৬ হাজার ২০০ টাকা দিয়ে। সময় বাড়ার সাথে সাথে সেটির দামও অটোমেটিকেলি বাড়তে থাকে। আমাদের বিমানের একটি টিকিট এখন সর্বোচ্চ ৫৩ অথবা ৫৪ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমাদের টিকিট বিক্রি হচ্ছে ওপেন ফর অল পদ্ধতিতে। বাল্ক সিস্টেমে টিকিট বিক্রি হওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলতে পারি বিমান কোনো বাল্ক (লট) টিকিট বিক্রি করে না। তবে আমরাও বাজারে শুনতে পাচ্ছি বাল্ক টিকিট বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু এমন ডকুমেন্ট যদি কেউ আমাদের দিতে পারতো আমরা এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারতাম।

উল্লেখ্য মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খোলার পর এখন পর্যন্ত ৭৫ হাজারের মতো শ্রমিক দেশটিতে কর্মসংস্থানের উদ্দেশে পাড়ি জমিয়েছেন। বিমান টিকিটের ক্রাইসিস না থাকলে এই সময়ের মধ্যে এক লাখেরও বেশি শ্রমিক দেশটিতে চলে যেত বলে মনে করছেন বায়রার নেতৃবৃন্দ। গতকাল মালয়েশিয়া থেকে একজন ব্যবসায়ী নাম না প্রকাশের শর্তে নয়া দিগন্তকে বলেন, আসলে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার ঘিরে কী যে হচ্ছে, তা বোঝা যাচ্ছে না। মাত্র তো মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি বাংলাদেশ সফর করে এসেছে। দুই দেশের মধ্যে সম্পাদিত এমওইউ চুক্তি নিয়ে চলতি মাসে আবারো জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকের পর চূড়ান্ত কী সিদ্ধান্ত আসছে সেটি না দেখা পর্যন্ত ভবিষ্যৎ কিছু বলা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানান তিনি।