ভয়াবহ তাপদাহে কদর বেড়েছে হাতপাখার

ভয়াবহ তাপদাহে কদর বেড়েছে হাতপাখার

এক সপ্তাহ ধরে ভয়াবহ তাপদাহে সিরাজগঞ্জের জনজীবন বিপর্যস্ত। চলতি তাপদগ্ধ জীবনে খেটে খাওয়া মানুষের হাঁস-ফাঁস অবস্থা। রাত-দিনের প্রচণ্ড গরমে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে মানুষের পাশাপাশি-পশু-পাখিও। গরমের মধ্যে বিদ্যুৎ চলে গেলে সাধারণ মানুষের কাছে এই হাত পাখাই ভরসা।

এদিকে, একটু স্বস্তির আশায় ডাব, ঠান্ডা শরবত বা পানি দিয়ে তৃষ্ণা নিবারণের চেষ্টা করছে সাধারণ মানুষজন। গরম থেকে কিছুটা রেহাই পেতে কদর বেড়েছে, ডাব ও শরবতের পাশাপাশি, তালপাতা ও সুতার তৈরি হাতপাখার।

রোববার (১৬ এপ্রিল) সকালে শহরের ব্যস্ততম বাজার স্টেশন এলাকায় মৌসুমী ব্যবসায়ীর কাছ থেকে হাতপাখা কেনার ভিড়ের দৃশ্য দেখা যায়। আগে যে হাতপাখা ২৫ থেকে ৩০ টাকা বিক্রি হতো বর্তমানে তা ৫০ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। জেলার বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে পাখা তৈরিতে ব্যস্ত সময় কাটছে গৃহবধূসহ কারিগরদের।

জানা যায়, গরম থেকে স্বস্তি পেতে হাতপাখা ছিল সবার ভরসা। বর্তমানে প্রতি বাসা-বাড়িতে রয়েছে বৈদ্যুতিক পাখা। কেউ কেউ ব্যবহার করছেন এসিও। প্রচণ্ড গরমে লোডশেডিং বেড়েছে।

দিন-রাত মিলিয়ে সাত-আট ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না। নিয়ম করে সন্ধ্যা হলে বিদ্যুৎ থাকছে না জেলার বিভিন্ন উপজেলার বেশির ভাগ এলাকায়।

একদিকে, প্রচণ্ড গরম অন্যদিকে, লোডশেডিংয়ের কারণে অনেকেই ফেরি করে হাতপাখা বিক্রি করছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শীত শেষ হতেই জেলার বিভিন্ন গ্রামের নিম্ন-আয়ের মানুষদের বাড়ির গৃহবধূরা পাখা তৈরি করে থাকেন। গ্রামাঞ্চলে এই পাখার কদর বেশি থাকলেও শহরের অনেকেই এখনও কেনেন এই পাখা। গত ১ সপ্তাহের তীব্র গরমে চাহিদা বেড়েছে হাতপাখার। হাতপাখা তৈরির মানুষগুলো ৪/৫ প্রকারের পাখা তৈরি হয়ে থাকেন। তবে শহর অঞ্চলে সুঁই সুতার সাথে নকশা করা পাখা বেশি বিক্রি হয়। সাধারণত এই পাখাগুলো অর্ডার নিয়ে ২০০ থেকে ৫০০ টাকাতে বিক্রি হয়। পাখাগুলোতে ফুল, ফল, দৃশ্যসহ বিভিন্ন প্রকৃতির অবয়ব ফুটিয়ে তোলা হয় সুতা দিয়ে।

পাখা তৈরিকারক গৃহবধূ মোছা. সোনেকা বেগম জানান, সংসারের কাজের ফাঁকে যে সময়টা পাওয়া যায়। বসে না থেকে সেই সময়ে পাখা তৈরি করি। একটা পাখা তৈরীতে ১৫/২০ টাকা মজুরী পাই। আর সুতার তৈরি পাখার মজুরী দেয়া হয় ২০/২৫ টাকা, আর বিক্রি হয় ৫০ থেকে ৬০ টাকা।

শহরের ব্যস্ততম বাজার স্টেশন এলাকায় এক মৌসুমী হাত পাখা ব্যবসায়ী আনোয়ার শেখ বলেন, জেলার শেষ প্রান্ত উপজেলা রায়গঞ্জে বাড়ি। তিনি ১০ বছর ধরে জেলার বিভিন্ন হাট-বাজারসহ শহরের অনেক প্রান্তে পায়ে হেঁটে হেঁটে এই হাতপাকা বিক্রি করে। সেই টাকায় চলে সংসার। আমার মতো অনেকেই পাখা বিক্রি করে চালাচ্ছেন সংসার। প্রচন্ড গরমে বসে নেই হাত পাখা তৈরীর কারিগররাও। গরম শুরুর প্রথম থেকেই বেড়েছে হাত পাখা কারিগরদের ব্যস্ততা।

পাখা ব্যবসায়ী আনোয়ার বলেন, গত ২ সপ্তাহ ধরে শহরে এসেছি। এই সময়টায় তিনি তালের ও বাঁশবেতের হাত পাখা বিক্রি করেন। অন্য সময় দিন-মজুরি করে সংসার চালান। নিজ এলাকা থেকে এই হাত পাখা সংগ্রহ করেন। বিক্রি করেন প্রতি পিস ৪৫/৫০ টাকা ও জোড়া ১০০ থেকে ১১০ টাকায়। অন্য সময়ের চেয়ে ১ সপ্তাহ ধরে পাখা বিক্রি হচ্ছে বেশি।

পাখা ক্রেতা রিকশা চালক শুকুর আলী (৫৬) বলেন, হাত পাখা সবসময় পাওয়া যায় না, তাই একটা কিনলাম। প্রচণ্ড গরমে রিক্স চালিয়ে হাঁপিয়ে যায়। কাজের পাশা-পাশি শরীর ঠান্ডা করতে পাখাটি কিনলাম। এখন গরমে এই পাখাই ভরসা।

শহরের বাসিন্দা লাইব্রেরী ব্যবসায়ী রুবেল হোসেন বলেন, দুইটি তাল পাতার পাখা কিনলাম ১১০ টাকায়। পাখাটি হালকা ও সুন্দর। বিদ্যুৎ না থাকলে বাতাসও করা যাবে। এই গরমে বিদ্যুৎ বিভ্রাট তো লেগেই আছে। তাই পাখার কোনো বিকল্প নাই। পাখার বাতাসও অনেক প্রশান্তি দেয়। কিন্তু আধুনিক ও তথ্যপ্রযুক্তির যুগে এসে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র, ইলেকট্রিক পাখার দাপটে এখন বাঁশবেতের তৈরি হরেক রকমের হাতপাখা বিলুপ্ত প্রায়।

পাখার পাইকারী ব্যবসায়ীরা জানান, গ্রামের বাড়ি বাড়ি ঘুরে পাখাগুলো পাইকারি দরে শতকরা হিসেবে কিনে নেওয়া হয়। এই পাখাগুলো জেলার বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি হয়ে থাকে। বর্তমানে যে গরম চলছে এতে পাখা বিক্রি বেড়েছে কয়েকগুণ। চাহিদা অনুযায়ী কারিগরেরা তৈরী করতে পাছে না। আধুনিক ইলেকট্রনিক্স পণ্যের পাশাপাশি দেশিও হস্ত শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকারের পৃষ্ট পোষকতার প্রয়োজন কারিগরদের।

তাড়াশ আবহাওয়া অফিসের পর্যবেক্ষক কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলাম বলেন, আজ সকাল ১০ টায় ৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। তবে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাপ মাত্রা আরও বাড়বে। আপাতত বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা নেই। এ তাপদাহ অব্যাহত থাকবে কিছুদিন। বৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত তাপদাহ চলবে।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) সিরাজগঞ্জ অঞ্চলের সহকারী মহাব্যবস্থাপক মো. রাশেদুল রহমান বলেন, গ্রাম বাংলার একটি ঐতিহ্যের অংশ। এই কাজের সঙ্গে বেশির ভাগ নারী শ্রমিক জড়িত। এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখার জন্য একটি তালিকা করে তাদের উন্নত প্রশিক্ষণসহ সল্প সুদে ব্যাংক লোনের ব্যবস্থা করা হবে। বাংলার ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে আমরা সবসময় পাশে আছি। উদ্যোক্তারা যদি আমাদের কাছে আবেদন করেন, অবশ্যই তাদেরকে সহযোগিতা করা হবে বলে তিনি জানান।