বিরুদ্ধ মতের উপাত্ত মুছে দেওয়ার ঘটনা ঘটবে: উপাত্ত সুরক্ষা আইনের নতুন খসড়া প্রসঙ্গে টিআইবি

বিরুদ্ধ মতের উপাত্ত মুছে দেওয়ার ঘটনা ঘটবে: উপাত্ত সুরক্ষা আইনের নতুন খসড়া প্রসঙ্গে টিআইবি

উপাত্ত সুরক্ষা আইনের নতুন খসড়ায়ও মূল উদ্বেগের দিকগুলো রয়ে গেছে বলে মনে করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সংস্থাটির বক্তব্য হলো, খসড়াটি যেভাবে আছে, সেভাবে আইন তৈরি হলে অপব্যবহারের সুযোগ থাকবে। পাশাপাশি সরকারি মদদে ব্যক্তির তথ্যের গোপনীয়তাও লঙ্ঘিত হবে। বিরুদ্ধ মতের উপাত্ত মুছে দেওয়ার ঘটনা ঘটবে।

উপাত্ত সুরক্ষা আইনের চতুর্থ খসড়া নিয়ে আজ সোমবার নিজেদের পর্যালোচনা তুলে ধরতে টিআইবি আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলা হয়। রাজধানীর ধানমন্ডিতে নিজেদের কার্যালয়ে টিআইবি এই সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করে।

অনুষ্ঠানে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এখন পর্যন্ত আইনটির বিভিন্ন খসড়ার ওপর তিনবার তাঁরা সুপারিশ ও মন্তব্য জানিয়েছেন। সরকার কিছু ক্ষেত্রে পরামর্শ গ্রহণ করেছে। তবে এখনো অনেক উদ্বেগের জায়গা রয়ে গেছে। উদ্বেগের জায়গাগুলোতে সরকার অনড় অবস্থানে আছে।

সংবাদ সম্মেলনে উপাত্ত সুরক্ষা আইনের খসড়া নিয়ে টিআইবির পর্যালোচনা তুলে ধরেন সংস্থাটির পরিচালক (আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন) শেখ মনজুর-ই-আলম। তিনি আইনের নামকরণ, উপাত্তের সংজ্ঞা, ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা, নজরদারির আশঙ্কা, উপাত্ত মজুত ও স্থানান্তর–সংক্রান্ত বিধান, প্রতিষ্ঠানের অপরাধে কর্মীর দায় ইত্যাদি নিয়ে টিআইবির উদ্বেগের দিকগুলো তুলে ধরেন। তিনি বলেন, নতুন খসড়ায়ও উদ্বেগের দিকগুলো থেকে যাওয়া কতটা অনিচ্ছাকৃত বা অনিজ্ঞতার কারণে, কতটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, সেই প্রশ্ন করাটা এখন অবান্তর হবে না।

খসড়া আইনের নামকরণ নিয়ে টিআইবি তাদের পর্যবেক্ষণে বলেছে, আইনটির নামকরণে ‘উপাত্ত’ শব্দটি ব্যবহার করলে বিভ্রান্তি তৈরির আশঙ্কা রয়েছে। কারণ হলো, উপাত্ত শব্দটি দিয়ে প্রচলিত অর্থে বাংলায় যা বোঝায়, তার সঙ্গে বিভিন্ন দেশের একই উদ্দেশ্যে প্রণীত আইনের মিল নেই। বিশ্বে এ ধরনের আইন করা হয় একজন মানুষের নানান ধরনের ব্যক্তিগত তথ্য (নাম, ঠিকানা, জন্মতারিখ, জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর ইত্যাদি) সুরক্ষার জন্য, যা দিয়ে তাঁকে শনাক্ত করা যায়। টিআইবি বলছে, বাংলাদেশে আইনের নামকরণে উপাত্ত শব্দটি ব্যবহার করলে আইন তৈরির মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে। বিষয়টি ইচ্ছেমতো ব্যাখ্যা করার সুযোগ থাকায় আইনটির ব্যাপক অপপ্রয়োগের ঝুঁকি থাকবে।

আইনটির খসড়ায় ব্যক্তি বলতে একক ব্যক্তির পাশাপাশি আইনগত ব্যক্তিসত্তা, সংস্থা, অংশীদারী কারবার, কোম্পানি, সমিতি, করপোরেশন, প্রতিষ্ঠান ইত্যাদিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। টিআইবি বলছে, ব্যক্তি কে সেই সংজ্ঞার ব্যাপকতা আইনটিকে অবাস্তব অবস্থানে নিয়ে গেছে। এটি আইনের প্রায়োগিক ক্ষেত্রে অস্পষ্টতা ও জটিলতা তৈরি করবে এবং ইচ্ছেমতো ব্যাখ্যা করা ও অপব্যবহারের সুযোগ তৈরি হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অভিজ্ঞতায় এ আশঙ্কা অমূলক বলে বাতিল করে দেওয়ার সুযোগ নেই।

ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষার বিষয়টি নজরদারির জন্য সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে একটি স্বাধীন কমিশন গঠনের দাবির কথা উল্লেখ করে টিআইবি বলেছে, নতুন খসড়ায় উপাত্ত সুরক্ষা এজেন্সি গঠনের প্রস্তাব রাখা হয়েছে, যেখানে নিয়োগ দেবে সরকার। এই এজেন্সিকে যেকোনো নিয়ন্ত্রক বা প্রক্রিয়াকারীর কাছে থাকা ব্যক্তির উপাত্তে প্রবেশাধিকার, প্রক্রিয়াকরণে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া এবং মুছে ফেলার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। টিআইবি মনে করে, এমন বিধানের মাধ্যমে আইনটির যথাযথ প্রয়োগ ও বাস্তবায়নের বিষয়টি সরকার নিযুক্ত ও আবশ্যিকভাবে নিয়ন্ত্রিত এক ব্যক্তির ইচ্ছাধীন করা হয়েছে।

সরকার নিজেই উপাত্ত ব্যবহার ও প্রক্রিয়াকারী এবং নিয়ন্ত্রক আবার একটি সরকারি সংস্থা—এখানে স্বার্থের দ্বন্দ্ব রয়েছে বলে উল্লেখ করেছে টিআইবি। তাদের আশঙ্কা, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো এই আইনেরও যথেচ্ছ অপপ্রয়োগ হবে। ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা লঙ্ঘিত হবে সরকারি মদদে। সরকারের মত বা অবস্থানের বিরুদ্ধে গেলে যেকোনো সংস্থার তথ্যভান্ডারে (সার্ভারে) প্রবেশ করে উপাত্ত মুছে ফেলা এবং উপাত্ত প্রক্রিয়া করার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটবে।

সব মিলিয়ে ব্যক্তির ওপর সরকারের নজরদারির ক্ষমতা, এর অপপ্রয়োগ এবং মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ আরও জোরদার হবে বলে আশঙ্কা টিআইবির।

নতুন খসড়ায়ও দেশের ভেতরে উপাত্ত মজুত করার বিধান রেখে উপাত্তের ওপর নজরদারি এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা সরকারের হাতে রাখা হয়েছে বলে মনে করে টিআইবি। তাদের পক্ষ থেকে আরও বলা হয়, খসড়াটি সংবিধানে দেওয়া মানুষের বাক্‌স্বাধীনতা ও গোপনীয়তার অধিকার ক্ষুণ্ন করবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং জনগণের ব্যক্তিগত যোগাযোগের ওপর সরকারের বিভিন্ন সংস্থার নজরদারি জোরদার হবে।

উপাত্ত স্থানীয়করণ বাধ্যতামূলক করা হলে ছোট ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানের ব্যয় বাড়বে বলেও মনে করে টিআইবি। তারা আরেকটি ‘উদ্বেগে’র দিক তুলে ধরেছে। সেটি হলো, কোনো কোম্পানি এ আইনের অধীনে কোনো অপরাধ করলে প্রতিষ্ঠানের প্রত্যেক মালিক, প্রধান নির্বাহী, পরিচালক, ব্যবস্থাপক, সচিব, অংশীদার অথবা অন্য কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীকে দায়ী করা যাবে। টিআইবি বলছে, এই ধারার মাধ্যমে ফৌজদারি আইনে অপরাধ প্রমাণের দায়সংক্রান্ত নীতির সরাসরি বিপরীত ব্যবস্থার প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে নাগরিক অধিকার নিয়ে কাজ করা সব প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যমসহ দেশি-বিদেশি সব প্রতিষ্ঠানের জন্য আইনগত ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে। এই ঝুঁকি শুধু আর্থিক দণ্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না।

টিআইবি বলেছে, বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় সাংবাদিক ও নাগরিক সমাজের হয়রানির যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, উপাত্ত সুরক্ষা আইন দিয়েও তেমন কিছু করা হবে না, সেই নিশ্চয়তা নেই।

ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষার জন্য আইনের প্রয়োজন আছে। তবে বাংলাদেশে ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা থেকে সরে গিয়ে নিয়ন্ত্রণমূলক একটি আইন হতে যাচ্ছে, যা উদ্বেগজনক। আইনের খসড়ায় যদি পরিবর্তন না আনা হয়, যেসব বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হচ্ছে সেগুলো যদি সংশোধিত না হয়, তাহলে দেশে একটি নজরদারিভিত্তিক সমাজ তৈরি হবে।

সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির উপদেষ্টা সুমাইয়া খায়ের ও উপাত্ত সুরক্ষা কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন।