রেকর্ড বিদ্যুৎ উৎপাদনেও গ্রামে ঘণ্টায় ঘণ্টায় লোডশেডিং

রেকর্ড বিদ্যুৎ উৎপাদনেও গ্রামে ঘণ্টায় ঘণ্টায় লোডশেডিং

দেশে রেকর্ড পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। তবুও সামাল দিয়ে উঠতে পারছে না বিদ্যুৎ বিভাগ। গত তিন দিন ধরে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘন ঘন লোডশেডিং হচ্ছে। তীব্র তাপদাহের মধ্যে এ লোডশেডিং জনজীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। বিশেষ করে শহরের তুলনায় গ্রামে লোডশেডিং বেশি হচ্ছে।

বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র বলছে, আগামী মে মাসে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ চাহিদা ধরে ১৬ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছিল। টানা প্রচণ্ড গরমের কারণে এপ্রিলেই চাহিদা ১৬ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে গেছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছে গত রাতে ১৫ হাজার ৬০৪ মেগাওয়াট। দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সময়ে গরম থাকছে বেশি। এ সময় সর্বোচ্চ উৎপাদন করা হচ্ছে ১৪ হাজার মেগাওয়াট। এতে কখনো কখনো ঘাটতি থাকছে দুই হাজার মেগাওয়াটের বেশি।

এর মধ্যেই ‘যান্ত্রিক ত্রুটির’ কারণে দুদিন ধরে উৎপাদন বন্ধ রয়েছে রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে। এর প্রভাবে বাগেরহাটসহ দেশের দক্ষিণাঞ্চলে লোডশেডিংয়ের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃর্তপক্ষ জানিয়েছে, মেরামতের কাজ চলছে। দ্রুতই উৎপাদনে ফিরে যাবে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র।

গ্যাস ও কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রগুলো পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছে না জানিয়ে বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, প্রচণ্ড তাপের কারণে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে উৎপাদন বন্ধও রাখতে হচ্ছে সাময়িক সময়ের জন্য।

বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, তাপমাত্রা রেকর্ড পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে গেছে। এতে হিমশিম খেতে হচ্ছে বিদ্যুৎ সরবরাহে।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) তথ্য বলছে, বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা আছে ২২ হাজার ৫৬৬ মেগাওয়াট। এর মধ্যে জ্বালানির (গ্যাস, তেল, কয়লা, পানি) অভাবে উৎপাদন করা যাচ্ছে না দুই হাজার মেগাওয়াট। আর যান্ত্রিক ত্রুটি ও রক্ষণাবেক্ষণে থাকার কারণে উৎপাদন করা যাচ্ছে না ৩ হাজার ২৪১ মেগাওয়াট।

সব বিতরণ সংস্থাকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে পিডিবি। এরপর তা গ্রাহকদের কাছে সরবরাহ করে ছয়টি বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা। ঢাকার বাইরে চারটি সংস্থার দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চাহিদামতো বিদ্যুৎ সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে না। তাই বাধ্য হয়ে লোডশেডিং করতে হচ্ছে ঢাকার বাইরে। গতকাল সোমবার দিনের বেলায় সর্বোচ্চ উৎপাদনের সময়েও সারা দেশে লোডশেডিং হয়েছে এক হাজার মেগাওয়াটের বেশি। এর আগে রাত একটা থেকে তিনটা পর্যন্ত দেশে লোডশেডিং হয়েছে দুই হাজার মেগাওয়াটের বেশি।

গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবে সম্প্রীতি বাংলাদেশের এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে প্রধানমন্ত্রীর বিদুৎ ও জ্বালানিসম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী লোডশেডিংরোধে সবাইকে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। অতিরিক্ত গরমের কারণে লোডশেডিং হচ্ছে বলেও জানান তিনি।

এদিকে তীব্র দাবদাহের মাঝে লোডশেডিং-এ ভুগছে মানুষ। পিডিবির ময়মনসিংহের প্রধান প্রকৌশলী মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ময়মনসিংহের ছয় জেলায় চাহিদার তুলনায় সরবরাহের ঘাটতি ৩০০ থেকে ৪০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত।

সিলেট পিডিবি ও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তারা বলছেন, ১৩ এপ্রিল থেকে চাহিদার তুলনায় বিদ্যুতের সরবরাহ কমে আসে। এতে বাধ্য হয়ে এলাকাভেদে লোডশেডিং করতে হচ্ছে। সিলেট পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১-এর মহাব্যবস্থাপক মো. আক্তারুজ্জামান লস্কর বলেন, সোমবার ঘাটতি ছিল ২০ মেগাওয়াট। বেলা বাড়ার সঙ্গে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়তে থাকে। এক ঘণ্টা বা দেড় ঘণ্টা পরপর লোডশেডিং করতে হচ্ছে।

সিলেটে লোডশেডিং বন্ধ করার দাবি জানিয়েছেন গ্যাস-বিদ্যুৎ গ্রাহক কল্যাণ পরিষদ।

নোয়াখালী পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মহাব্যবস্থাপক মো. জাকির হোসেন বলেন, চাহিদার তিন ভাগের এক ভাগ বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে না। তাই লোডশেডিংয়ের কোনো রুটিন মানা যাচ্ছে না।

গ্রামে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে দেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি)। বিদ্যুৎ গ্রাহকদের ৫৫ শতাংশ তাদের অধীনে। গরমে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়েছে গ্রাম এলাকাতেও। কিন্তু বিদ্যুৎ সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে না। দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘাটতি বেশি হচ্ছে। রাতেও হচ্ছে কিছু কিছু। সংস্থাটির সদস্য (বিতরণ ও পরিচালন) দেবাশীষ চক্রবর্তী প্রথম আলোকে বলেন, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিদ্যুৎ সরবরাহের চেষ্টা করা হচ্ছে। লোড ভাগাভাগি করে লোডশেডিং করা হচ্ছে।

তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেন, ‘বিদ্যুতের অবস্থার উন্নতি হয়েছে। কিছু দিন আগেও পরিস্থিতি ভালো ছিল। গরম বেশি পড়লে তার গরম হয়, তখন ঝুঁকিও বাড়ে।’

তিনি বিদ্যুৎ পরিস্থিতি নিয়ে রাজনীতি না করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘রাজনৈতিক বিরোধ যদি ক্রান্তিকালেও থাকে, তাহলে বুঝতে হবে উদ্দেশ্য ভালো না। চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সবাইকে এক হয়ে কাজ করতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘উন্নয়নশীল দেশে যত সঙ্কট, তা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলাফল। যে পরিমাণ এলএনজি আমদানি হচ্ছে তাতে বিদ্যুতের ঘাটতি হবার কথা না।’