পুরো গ্রীষ্মকালেই থাকবে তীব্র তাপ ও খরা

পুরো গ্রীষ্মকালেই থাকবে তীব্র তাপ ও খরা

চলতি বছর কাটতে পারে অতিরিক্ত তাপমাত্রা ও অনাবৃষ্টিতে। এর একটি লক্ষণ ইতোমধ্যে স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। গত মার্চ মাসে বাংলাদেশে কিছু বৃষ্টিপাত হলেও এপ্রিল আসার সাথে সাথেই শুরু হয়ে গেছে খরা ও তাপপ্রবাহ। গত এক সপ্তাহ থেকে দেশের কোনো কোনো স্থানে চলছে ‘এক্সট্রিম হিটেড কনডিশন’ বা মারাত্মক তাপীয় অবস্থা। দেশের কোনো কোনো স্থানে উচ্চ তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করেছে। চলতি মৌসুমে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা পাবনার ঈশ্বরদীতে ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস পৌঁছেছে।

জলবায়ু বিজ্ঞানীরা বলছেন, এ বছরের শেষ দিকে প্রশান্ত মহাসাগরে একটি সুপার এল নিনো সংঘটিত হতে পারে। জলবায়ু বিজ্ঞানীদের পূর্বাভাস বাস্তবে পরিণত হলে সামনের বছর আরো উষ্ণতা ও খরা মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। চলতি তাপপ্রবাহটি হয়তো চার থেকে পাঁচ দিনের মধ্যে স্বাভাবিক হয়ে যেতে পারে। কিন্তু সামনের দিনগুলোতে এ ধরনের খরা ও তীব্র তাপপ্রবাহ আরো বাড়তে পারে। বাংলাদেশের পুরো গ্রীষ্মকাল স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি শুষ্ক থাকতে পারে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির স্কুল অব সাসটেইনেবল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড দ্য বিল্ট এনভায়রনমেন্টের খণ্ডকালীন প্রফেসর ড. রাশেদ চৌধুরী বলেন, ‘একটি সুপার এল নিনো তৈরি হচ্ছে। এল নিনো কয়েক বছর পর ঘটে থাকে; কিন্তু সুপার এল নিনো সংঘটিত হওয়ার ঘটনা খুবই বিরল। তিনি বলেন, ‘অতীতে কয়েকটি সুপার এল নিনো বছরে বাংলাদেশে দীর্ঘ অনাবৃষ্টি বা খরায় কেটেছে। ১৯৮২-৮৩, ১৯৯৭-৯৮ এবং ২০১৫-১৬ সালে বাংলাদেশ প্রচণ্ড গরম ও অনাবৃষ্টির সম্মুখীন হয়েছে।’ ড. রাশেদ চৌধুরী বলেন, চলতি এপ্রিল মাসে বাংলাদেশসহ এশিয়াজুড়েই মারাত্মক তাপপ্রবাহ চলার আশঙ্কা রয়েছে। এই তাপপ্রবাহের জন্য আকাশের অনেক উপর দিয়ে বয়ে চলা সঙ্কীর্ণ বা সরু বায়ু স্রোত বা জেট স্ট্রিমের ভূমিকা আছে। বিষুবরেখা থেকে উত্তর মেরু পর্যন্ত বিস্তৃত তাপমাত্রার বিভিন্নতার জন্য এই জেট স্ট্রিমকে দায়ী করা হয়। গ্রীষ্মকালে তাপের তারতম্যও করে থাকে এই জেট স্ট্রিম। ড. রাশেদ চৌধুরী বলেন, ভবিষ্যতে এই ধরনের তাপপ্রবাহ মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। মানবসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তন জেট স্ট্রিমকে প্রভাবিত করছে।

উল্লেøখ্য, ভূপৃষ্ঠ থেকে আকাশের প্রায় ছয় হতে সাত মাইলের (১০ থেকে ১১ কিলোমিটার) মধ্যবর্তী জায়গায় এই জেট স্ট্রিম সবচেয়ে শক্তিশালী অবস্থায় প্রবাহিত হয়। ঘণ্টায় প্রায় ৪৫০ থেকে ৫০০ কিলোমিটার বেগে বয়ে চলা এই জেট স্ট্রিমের বড় প্রভাব রয়েছে আবহাওয়া এবং জলবায়ুর ওপর। বিজ্ঞানীরা বলছেন, জেট স্ট্রিম আবহাওয়াকে পরিচালিত করে। এটি উষ্ণ বায়ুমণ্ডল ও শীতল বায়ু মণ্ডলের মাঝখানে বাধা হিসেবে কাজ করে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঠাণ্ডা ও গরমের যে ভারসাম্য এতদিন ছিল তা পরিবর্তন হতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভবিষ্যতে এটি বিষুবরেখা থেকে মেরু অঞ্চলের দিকে সরে যেতে পারে। এটা থেকে সহজেই অনুমান করা যায় যে, বিষুবরেখা থেকে জেট স্ট্রিম সরে গেলে বিষুব অঞ্চলে আরো বেশি গরম ও খরা পড়বে।

ক্লাইমেট মডেলকে উদ্ধৃত করে ব্রিটেনের বিখ্যাত সংবাদপত্র গার্ডিয়ান বলেছে, ‘চলতি বছর শেষের আগেই একটি সুপার এল নিনো সংঘটিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এল নিনো প্রশান্ত মহাসাগরের উপরিভাগের উষ্ণতাকে বোঝায়। এই উষ্ণতাই পুরো পৃথিবীতে ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে। জলবায়ু মডেল অনুসারে চলতি বছরের শেষে প্রশান্ত মহাসাগরে সুপার এল নিনো সৃষ্টি হলে প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্যবর্তী স্থানে এবং বিষুবীয় অঞ্চলে খুবই উষ্ণ আবহাওয়ার সৃষ্টি করতে পারে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ২০১৬ সালে সুপার এল নিনো সৃষ্টির কারণে বিশ্বব্যাপী উচ্চ তাপমাত্রার নতুন রেকর্ড গড়ে ওঠে।

এ ব্যাপারে অস্ট্রেলিয়ান জলবায়ু বিজ্ঞানীরা অবশ্য ভিন্নমত মত প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, পূর্বাভাস সবসময় যেভাবে বলা হয়, সেভাবে করে বাস্তবে পরিণতি লাভ করে না। তারা বলছেন, চলতি বছরের শেষ নাগাদ সুপার এল নিনো সংঘটিত হওয়ার সুযোগ মাত্র ৫০ শতাংশ। বড় ধরনের এবং শক্তিশালী এল নিনো প্রতি ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে সংঘটিত হয়। গত ২০১৫-১৬ সালে একবার এল নিনো সংঘটিত হয়েছিল এবং চলতি ২০২৩ সালের মধ্যে আরেকটি এল নিনো সংগঠন হওয়ার সময় হয়নি।

চুয়াডাঙ্গা প্রতিনিধি জানান, চৈত্রের তাপদাহের মতো এই বৈশাখের গরমে অতিষ্ঠ জনজীবন। এখন বৈশাখী ঝড়-বৃষ্টির ছন্দে স্বস্তিতে ফেরার আশা সবার। দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে প্রকৃতি পুড়ছে গ্রীষ্মের তাপদাহে। মৃদু থেকে অতি তীব্র তাপপ্রবাহে হাঁপিয়ে উঠেছে খেটে খাওয়া মানুষ। অসহনীয় গরম আর তাপদাহে বিমর্ষ প্রাণ প্রকৃতি। গতকাল বিকেলে চুয়াডাঙ্গায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪২ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। এ সময় বাতাসের আর্দ্রতা ছিল ১২ শতাংশ। চুয়াডাঙ্গা প্রথম শ্রেণীর আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের সিনিয়র পর্যবেক্ষক রাকিবুল হাসান এ তথ্য নিশ্চিত করেন।

রাকিবুল হাসান বলেন, এ পরিস্থিতি থাকবে আরো কয়েকদিন। যদিও কোথাও কোথাও বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এ অঞ্চলে ২৩-২৪ এপ্রিলের আগে তেমন সম্ভাবনা নেই।

চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার মোমিনপুর বাজারের ভ্যানচালক লিপু মিয়া বলেন, ব্যাটারিচালিত চার্জার ভ্যান চালাতে কষ্ট নেই। কষ্ট এ রোদে যাত্রী নিয়ে যেতে। বেশি তাপের কারণে মানুষ বের হয় না, এ জন্য আয়রোজগার কমে গেছে।

চুয়াডাঙ্গা আলী হোসেন মার্কেটের ইলেকট্রনিক মিস্ত্রি শিলন আলী বলেন, গরমে নাভিশ্বাস অবস্থা। মার্কেটে প্রচুর গরম থাকায় দিনের বেলা অনেকটা ফাঁকা থাকছে। তবে ঈদের কারণে জুতা-কাপড়ের দোকানে ভিড় আছে।

তরমুজ ও ডাব বিক্রেতা শামীম হোসেন বলেন, এত গরম তারপরও দিনের বেলায় রোজার কারণে তেমন বিক্রি নেই। ইফতারির আগ মুহূর্তে বিক্রি বাড়ে; কিন্তু এই তাপদাহে দোকানে বসে থাকা কষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

চুয়াডাঙ্গা প্রথম শ্রেণীর আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগার সূত্রে জানা গেছে, ১৩ এপ্রিল ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ১৪ এপ্রিল ৪১ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস ও ১৫ এপ্রিল ৪২ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ১৬ এপ্রিল ৪১ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ১৭ এপ্রিল ৪২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস ও ১৮ এপ্রিল অর্থাৎ গত মঙ্গলবার ৪০ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং গত বুধবার ৪২ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। গতকাল দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪২ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা এ জেলায় রেকর্ড করা হয়েছে।

চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা: আওলিয়ার রহমান বলেন, অতি প্রয়োজনীয় কাজ ছাড়া বাইরে বের না হতে পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। রোজাদারদের সন্ধ্যার পর থেকে বেশি বেশি পানি পান ও ফলমূল খেতে বলা হচ্ছে। শিশু, কিশোর ও যারা রোজা থাকছেন না তাদেরকে ঘন ঘন পানি ও শরবত পান করার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। তীব্র তাপদাহে হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি থাকে। তাই যতটা সম্ভব ঠাণ্ডা স্থানে থাকতে হবে।

চুয়াডাঙ্গা সড়ক বিভাগের উপ বিভাগীয় প্রকৌশলী (অতিরিক্ত দায়িত্ব) প্রকাশ চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, শহরের কিছু স্থানে রাস্তার পিচ গলে যাওয়ার খবর পাচ্ছি। তবে এতে যান চলাচলে কোনো বিঘœ ঘটবে না। তবে পিচ বেশি গলে গেলে খোয়াগুলো নরম হয়ে চলাচলে বিঘœ ঘটবে।

চুয়াডাঙ্গার জেলা প্রশাসক আমিনুল ইসলাম খান বলেন, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জেলার সব স্থানে মাইকিং করে জনসাধারণকে সতর্ক করা হচ্ছে। তারা যেন অতি প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের না হয়। সন্ধ্যার পর শরবত, পানি ও ফলমূল বেশি বেশি খাওয়ার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।