আরেক দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর তৎপরতা শুরু

আরেক দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর তৎপরতা শুরু

বিদ্যুতের দাম আবারো বাড়ানোর তৎপরতা শুরু হয়েছে। গ্রাহক ও পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়তে পারে জুনের পরই। ইতিমধ্যে চলতি বছরে তিন ধাপে ভোক্তা পর্যায়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ১৫ শতাংশ আর পাইকারিতে ২৮ শতাংশ বাড়ানো হয়। যা সমন্বয়ের নামে সরকারের নির্বাহী আদেশে বৃদ্ধি করা হয় বিদ্যুতের দাম। এখন আবার গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ৫ থেকে ৭ শতাংশ বৃদ্ধির বিষয়েও ভাবছে বিদ্যুৎ বিভাগ। আবার বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডও (পিডিবি) পাইকারি পর্যায়ে আরেক দফা বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির জন্য মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে। পিজিসিবিও বিদ্যুতের হুইলিং (সঞ্চালন) চার্জ বাড়ানোর জন্য সরকারকে চাপ দিচ্ছে।

এদিকে, নির্বাহী আদেশে ভর্তুকি সমন্বয়ের লক্ষ্যে চলতি বছর গ্রাহকপর্যায়ে তিন দফা বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে সরকার। এতে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। অর্থনৈতিক চাপ সামাল দিতে গিয়ে মানুষের নাভিশ্বাস উঠে গেছে। বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলোও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর জন্য সরকারকে চাপ দিচ্ছে।

সম্প্রতি জুনের মধ্যে আরও এক দফা বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে বলে ঢাকায় সফররত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কনসালটেশন মিশনকে জানিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়।

এমনিতেই নিত্যপণ্যের দাম আকাশছোঁয়া। নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী চাহিদা অনুপাতে কিনতে পারছেন না ভোক্তারা। সরকার দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়লেও সংকট তো কাটছে না। বিদ্যৎ উন্নয়ন বোর্ড সমস্যা সামাল দিতে অগ্রিম টাকাও নিচ্ছে বিতরণ কোম্পানিগুলো থেকে। এমন পরিস্থিতি গ্রাহকের প্রশ্ন আর কতো বাড়বে বিদ্যুতের দাম। বিদ্যুৎ বিভাগ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সামনে বিদ্যুতের দাম আরও বাড়বে। আপাতত ৫ থেকে ৭ শতাংশ বাড়ানোর পর কোম্পানিগুলোর লোকসানও হবে না, লাভও থাকবে না, তাতে সমতা পরিস্থিতিতে আসতে পারে। তখন হয়তো মূল্যবৃদ্ধির বিরতি হবে।

ডেসকো’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. কাওসার আমীর আলী বলেন, গত জানুয়ারি থেকে মার্চ মাসে ১৪৭ কোটি টাকা লোকসান গুনতে হয়েছে। তাই ক্ষতি সামলাতে বিদ্যুতের আরও ৭ শতাংশ দাম বৃদ্ধি প্রয়োজন। তখন ডেসকো’র লোকসানও হবে না, লাভও থাকবে না। বিষয়টি বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ও জানে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

অন্যদিকে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম তিন দফা বাড়ানো হয়। গত ফেব্রুয়ারি মাসে দুই দফা এবং মার্চে এক দফা ৫ শতাংশ করে গ্রাহক পর্যায়ে দাম বাড়ানো হয়েছে। এর আগে গত নভেম্বরে পাইকারি পর্যায়ে ১৯ দশমিক ৯২ শতাংশ বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে সরকার। সর্বশেষ সরকার নির্বাহী আদেশে বিদ্যুতের দাম ভোক্তা পর্যায়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ৫ শতাংশ বাড়ানো হয়। যা মার্চ মাসের বিদ্যুতের বিলেই নতুন এ দাম কার্যকর হয়। এর আগে গত জানুয়ারিতে দুই দফায় বাড়ানো হয় বিদ্যুতের দাম। এটি জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে দুই ভাগে কার্যকর হয়েছে। এ নিয়ে গত ১৪ বছরে পাইকারি পর্যায়ে ১১ বার ও খুচরা পর্যায়ে ১৩ বার বাড়ানো হলো বিদ্যুতের দাম।

আগে গণশুনানির মাধ্যমে বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করতো এ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। আইন সংশোধন করে এ ক্ষমতা হাতে নিয়েছে সরকার। এরপর থেকে নির্বাহী আদেশে দাম বাড়াচ্ছে বিদ্যুৎ বিভাগ। দেশের সরকারি-বেসরকারি সব বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে চুক্তি অনুসারে নির্ধারিত দামে বিদ্যুৎ কিনে নেয় পিডিবি। এরপর তারা উৎপাদন খরচের চেয়ে কিছুটা কম দামে ছয়টি বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থার কাছে বিক্রি করে। ঘাটতি মেটাতে পিডিবি সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি নেয়। তবে বিতরণ সংস্থাগুলো কোনো ভর্তুকি পায় না। তারা নিয়মিত মুনাফা করছে।

গত অর্থবছরেও মুনাফা করেছে বিতরণ সংস্থাগুলো। বিদ্যুতের নতুন দাম অনুযায়ী, আবাসিকের লাইফ লাইন (৫০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী) গ্রাহকদের প্রতি ইউনিটের জন্য ৪ টাকা ১৪ পয়সার পরিবর্তে ৪ টাকা ৩৫ পয়সা দিতে হবে। আবাসিক গ্রাহকদের ক্ষেত্রে শূন্য থেকে ৭৫ ইউনিটের দাম ৪ টাকা ৬২ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৪ টাকা ৮৫ পয়সা, ৭৬ থেকে ২০০ ইউনিটের দাম ৬ টাকা ৩১ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৬ টাকা ৬৩ পয়সা, ২০১ থেকে ৩০০ ইউনিটের দাম ৬ টাকা ৬২ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৬ টাকা ৯৫ পয়সা, ৩০১ থেকে ৪০০ ইউনিটের দাম ৬ টাকা ৯৯ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৭ টাকা ৩৪ পয়সা, ৪০১ থেকে ৬০০ ইউনিটের দাম ১০ টাকা ৯৬ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১১ টাকা ৫১ পয়সা এবং ৬০০ ইউনিটের উপরে দাম ১২ টাকা ৬৩ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১৩ টাকা ২৬ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে।

ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর জ্বালানি উপদেষ্টা ড. এম শামসুল আলম বলেন, আমরা অনেক আগেই বলেছি যে, ভুল পরিকল্পনা এবং নানা অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত। ফলে বারবার দাম বাড়ানো হচ্ছে। মানুষের ওপর বোঝা চাপানো হচ্ছে। পিডিবি বারবার লোকসানের অজুহাতে দাম বাড়াচ্ছে। আর পিডিবি’র দাম বাড়ানোর অজুহাতে বিতরণ কোম্পানিগুলো দাম বাড়াচ্ছে। এই বিশেষজ্ঞ বলেন, এই দফাই শেষ নয়। এ দাম বৃদ্ধির প্রক্রিয়া চলতেই থাকবে। আমাদের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত এক অদূরদর্শী পরিকল্পনায় চলছে। যার দায়ভার পড়ছে সাধারণ জনগণের ওপর। গণশুনানি করে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্যের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতো। এখন নির্বাহী আদেশে সরকার সরাসরি সেটা করছে। সরকার কোনোরকম জবাবদিহিতা ছাড়া মূল্যবৃদ্ধি করে যাচ্ছে। যা মূল্যস্ফীতি আর জনগণের বোঝা দুটোই বাড়িয়ে চলেছে।

বিদ্যুতের দাম আর কতো বাড়তে পারে জানতে চাইলে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক (ডিজি) প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন সম্প্রতি বলেন, খুচরা পর্যায়ে ইতিমধ্যে দফায় দফায় ১৫ শতাংশ বেড়েছে। এটা হয়তো ২০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর পর আর বাড়ানোর প্রয়োজন হবে না।