ঘূর্ণিঝড় মোখা

ঝুঁকিতে সাড়ে ৮ লাখ রোহিঙ্গা ও সেন্ট মার্টিনবাসী

ঝুঁকিতে সাড়ে ৮ লাখ রোহিঙ্গা ও সেন্ট মার্টিনবাসী

বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ বাংলাদেশ ও মিয়ানমার উপকূলের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরকে ৮ নম্বর মহাবিপৎসংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। এই ঘূর্ণিঝড়ে কক্সবাজারে আশ্রয়শিবিরে থাকা সাড়ে আট লাখ রোহিঙ্গা এবং সেন্ট মার্টিন দ্বীপের বাসিন্দারা ঝুঁকিতে রয়েছেন।

দ্য ইন্টারন্যাশনাল রেসকিউ কমিটি (আইআরসি) জানিয়েছে, কক্সবাজারের আশ্রয়শিবিরে থাকা সাড়ে আট লাখ রোহিঙ্গা ঘূর্ণিঝড় মোখার ঝুঁকিতে আছে। ঝড়টি বাংলাদেশ উপকূলে আঘাত হানার সময় ওই ক্ষতি হতে পারে। তীব্র বাতাস, অতিবৃষ্টি ও হঠাৎ বন্যায় সেখানে অনেক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করছে সংস্থাটি। তারা আশ্রয়কেন্দ্র এলাকায় পাহাড় ধসের আশঙ্কাও করছে।

আইআরসি বলছে, এর আগে গত মার্চে শিবিরে আগুন লেগে ২ হাজার ৬০০ ঘর বা শেল্টার এবং কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঝড়ে আশ্রয়শিবিরের ঘরবাড়ি, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, কমিউনিটি সেন্টারের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। এতে রোহিঙ্গাদের জরুরি স্বাস্থ্যসহ অন্যান্য সেবা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। রোহিঙ্গারা ছাড়াও টেকনাফ, কুতুপালং, সেন্ট মার্টিন দ্বীপ এবং পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলো বড় ধরনের ক্ষতির শিকার হতে পারে।

প্রস্তুতি হিসেবে রোহিঙ্গা শিবিরে তিন হাজার স্বেচ্ছাসেবককে বন্যা, পাহাড় ধস মোকাবিলার জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। আইআরসি থেকে সেখানকার দুর্গম এলাকাগুলোতে চিকিৎসাসেবা দিতে তিনটি ভ্রাম্যমাণ ক্লিনিক স্থাপন করা হয়েছে। সেখানকার নারী ও শিশুসহ বেশি বিপদাপন্ন জনগোষ্ঠীর জন্য জরুরি সেবা দিতে ভ্রাম্যমাণ ইউনিট স্থাপন করা হয়েছে।

আইআরসি বাংলাদেশের পরিচালক হাসিনা রহমান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকার মতো কক্সবাজারের রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরগুলো নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখে পড়ছে। সম্পদ ও জীবনের ক্ষতি হচ্ছে। ফলে এ জন্য বৈশ্বিক সহায়তা আরও বাড়ানো উচিত।

এদিকে গতকাল শুক্রবার জাতিসংঘের মানবিক সহায়তাবিষয়ক সংস্থা—ওসিএইচএ ঘূর্ণিঝড় মোখা সম্পর্কে একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের ৩০ লাখ ও বাংলাদেশের ৭ লাখ ৮৪ হাজার ৫৪০ জন ঘূর্ণিঝড়ের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। কক্সবাজারে রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরের ১০ লাখ মানুষের ঝুঁকির বিষয়টি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের দিকে ঘূর্ণিঝড়টির কেন্দ্র আঘাত হানতে পারে। বাংলাদেশের কক্সবাজারেও আংশিক প্রভাব পড়বে। আরাকান রাজ্যের সম্ভাব্য ঝুঁকিতে থাকা ৩০ লাখ মানুষের মধ্যে দুই লাখ মানুষ মারাত্মক ঝুঁকিতে আছে। তাদের বড় অংশ আরাকান রাজ্যে অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা।

কক্সবাজার থেকে ভাসানচরের আশ্রয়শিবিরে নেওয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে ২৮ হাজার মানুষকে এরই মধ্যে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হয়েছে বলে প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সরকারের বরাত দিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। তাদেরে ৫৩টি আশ্রয়কেন্দ্র রাখা হয়েছে।

ওসিএইচএ, বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তরসহ দুর্যোগবিষয়ক সংস্থাগুলো সমন্বিতভাবে ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস ও প্রস্তুতি নিয়ে গত দুই দিনে মোট তিনটি সভা করেছে। সেখানে ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও ভারতে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা এবং আবহাওয়া দপ্তরগুলোর পূর্বাভাসের মধ্যে সমন্বয় আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ঝড়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তর (বিএমডি), ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তর (আইএমডি), ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর মিডিয়াম রেঞ্জ ওয়েদার ফোরকাস্ট এবং গ্লোবাল ফোরকাস্ট সিস্টেম ঘূর্ণিঝড় মোখা নিয়ে পৃথক পূর্বাভাস দিয়েছে।

ঘূর্ণিঝড়ের সতর্কতা সংকেত জানিয়ে সেন্ট মার্টিন জেটি ঘাটে পতাকা তুলছেন স্বেচ্ছাসেবকেরা। শুক্রবার বিকেলে সেন্ট মার্টিন জেটিঘাট এলাকার থেকে তোলা

সব কটি সংস্থার পূর্বাভাসে ঘূর্ণিঝড়টি ঘণ্টায় ১৬০ থেকে ১৮০ কিলোমিটার গতি নিয়ে উপকূলে আঘাত হানতে পারে বলে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে ঝড়ের সময় জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা দুই থেকে চার মিটার পর্যন্ত হতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ কারণে ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বনের সুপারিশ করা হয়েছে।

আবহাওয়াবিদেরা অবশ্য ঘূর্ণিঝড়ের কারণে কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ার পাশাপাশি সেন্ট মার্টিন দ্বীপকেও সর্বোচ্চ ঝুঁকির তালিকায় রাখছেন। বিশেষ করে দ্বীপটির চারপাশে বাঁধ না থাকায় ১০ থেকে ১২ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে দ্বীপটির বড় অংশ ডুবে যেতে পারে বলে মনে করছেন তাঁরা। এ জন্য সেখানকার হোটেল-মোটেলগুলোর পাশাপাশি স্থানীয় বাসিন্দাদেরও সরিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন।

তবে আপাতত সরকারের পক্ষ থেকে স্থানীয় লোকজনকে সরিয়ে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে জানানো হয়েছে। কারণ হিসেবে সাগর এরই মধ্যে উত্তাল হয়ে ওঠা এবং স্থানীয় লোকজন ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র যেতে চাচ্ছেন না বলে জানিয়েছেন। অবশ্য তাদের দ্বীপটিতে থাকা হোটেল-মোটেলগুলোতে আশ্রয় নেওয়ার জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর থেকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

জানতে চাইলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত হানতে পারে এমন সম্ভাব্য এলাকাগুলোতে আমরা সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিয়েছি। সেন্ট মার্টিন থেকে সব পর্যটক এবং বাইরের মানুষেরা সরে গেছেন। স্থানীয় প্রায় আট হাজার মানুষকে সেখানে উঁচু ভবন ও শক্ত অবকাঠামোগুলোতে নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠানো হয়েছে।’

মিজানুর রহমান আরও বলেন, রোহিঙ্গাদের আশ্রয়শিবিরের মধ্যে নিরাপদ ও পাকা অবকাঠামোর মধ্যে রাখা হচ্ছে। আর ঝড়ে তাঁদের বাড়িঘরের ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা থাকায় পর্যাপ্ত ঘর বানানোর উপকরণ মজুত রাখা হয়েছে। চিকিৎসা ও উদ্ধার কর্মীরাও প্রস্তুত আছেন।