সরকার এবং জনগণের উপর বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে

সরকার এবং জনগণের উপর বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে

বাংলাদেশে নিযুক্ত দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রদূত লি জ্যাং-কিউন ২০২০ সালের ০৬ জুলাই ঢাকার মাটিতে পা রেখেছিলেন। তখন সারা পৃথিবীতে করোনাভাইরাসের প্রকোপ সর্বোচ্চ পর্যায়ে। বিদেশ থেকে বাংলাদেশে প্রবেশে বিধিনিষেধ জারি করা হয়েছিল। তাই অনেক ঘুরেফিরে কোরিয়া থেকে ঢাকায় আসতে তার দীর্ঘ ৩৫ ঘন্টা লেগেছিল! তারপর বুড়িগঙ্গায় অনেক জল গড়িয়েছে। দেখতে দেখতে কেটে গেছে তিনটি বছর। ঢাকা ত্যাগের আগে (১৭ মে) কফির আড্ডায়, একান্ত আলাপচারিতায় এদেশে কর্মজীবনের শুরুর দিকের স্মৃতিচারণ করে রাষ্ট্রদূত বললেন, প্রথম এক বছরতো কেটে গেলো করোনা মহামারীতেই। কিন্তু, এরপর বাংলাদেশের সাথে কোরিয়ার সম্পর্ক শুধু এগিয়েই গেছে। উদাহরণস্বরূপ তিনি বলেন, আমি যখন এসেছিলাম তখন কোরিয়া বাংলাদেশের জন্য পঞ্চম বৃহত্তম 'বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগকারী' (এফডিআই) দেশ ছিল। গত বছর এদিক থেকে আমরা প্রথম স্থানে উঠে আসি। মহামারীর আগে প্রায় এক দশক ধরে কোরিয়া এবং বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্য যেখানে ১.৫ থেকে ১.৮ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে উঠানামা করতো, সেখানে প্রথমবারের মতো দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ২০২১ সালে ২ বিলিয়ন ডলার এবং ২০২২ সালে ৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়।

আশা করি, এমন ধারা অব্যাহত থাকবে। ঢাকায় আমার অবস্থানকালে কোরিয়া-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে এমন অনেক মাইলফলক অর্জিত হওয়ায় আমি খুব খুশি।

বাণিজ্য এবং উন্নয়ন সহযোগিতা ছাড়াও কোরিয়া-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোরিয়ায় বাংলাদেশের প্রবাসী শ্রমিকরা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে বলেও মনে করেন পেশাদার কূটনীতিক লি জ্যাং-কিউন। বললেন, করোনার আগে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর কোরিয়ায় যাওয়া শ্রমিকের সংখ্যা ছিল গড়ে ১,৫০০ জন। করোনাকালে শ্রমিক নেওয়া বন্ধ থাকলেও ২০২১ সালের শেষদিকে সেটি ফের শুরু হয়। ২০২২ সালে যা ৬,০০০ জনে গিয়ে ঠেকে। চলতি বছর এ লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১০,০০০ জন। কোরিয়ায় শ্রম পরিস্থিতি বেশ ভালো উল্লেখ করে রাষ্ট্রদূত বলেন, শুনেছি মধ্যপ্রাচ্যে গড় মজুরি ৫০০ মার্কিন ডলারের মতো। অন্যদিকে কোরিয়ায় মজুরি ন্যুনতম হলেও ২,০০০ ডলার। তাছাড়া, শ্রমিকদের জন্য কোরিয়ার নাগরিকদের মতোই ইনস্যুরেন্স সুবিধা রয়েছে। সমস্যায় পড়লে তারা এ থেকে সুবিধা পান। দেশে ফেরার সময় তারা ইন্স্যুরেন্সের টাকা ফেরত পান। তাছাড়া, আমাদের দেশে অনেক এনজিও রয়েছে যারা বিদেশি শ্রমিকদের উন্নয়নের জন্য কাজ করছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে (১৬ মে) নিজের বিদায়ী সাক্ষাতে এ সমস্ত বিষয়গুলো উল্লেখ করেছেন জানিয়ে রাষ্ট্রদূত বলেন, বাংলাদেশের উন্নয়ন যাত্রায় কোরিয়ার ভূমিকা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী অনেককিছু জানলেও সবকিছু জানতেন না। আমি তাকে সব ব্যাখ্যা করেছি।

এসবকিছুর পরও কোরিয়া-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলেও জানালেন রাষ্ট্রদূত লি। সেগুলো কি কি জানতে চাইলে শুরুতেই বললেন, বাংলাদেশে যেসব কোরিয়ান নাগরিক ব্যবসা করেন তাদের অনেকেই দীর্ঘদিন এদেশে থাকছেন। ২/৩ বছর নয়, অনেকে ২/৩ দশক ধরে এখানে আছেন। কিন্তু, এতোদিন থাকার পরও তাদের প্রতি বছর ভিসা নবায়ন করতে হয়, যা অনেক জটিল প্রক্রিয়া এবং যাতে অনেক সময় লেগে যায়। তাছাড়া, রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আগাম অনুমান করতে পারা এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ব্যবসার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলেও তিনি মনে করেন।

নিজ দেশের উন্নয়নের রহস্য সম্পর্কে বলতে গিয়ে রাষ্ট্রদূত বলেন, গণতান্ত্রিক উন্নয়ন ছাড়া কোরিয়া এতোদূর আসতে পারতো না। গণতন্ত্র একটি চলমান প্রক্রিয়া। গণতন্ত্র মানে মানুষের ক্ষমতায়ন। স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, সমৃদ্ধি কোরিয়ার উন্নয়নের মূলনীতি উল্লেখ করে তিনি কোরিয়াকে সমর্থনের জন্য জাতিসংঘ এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। সামনেই বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ বিষয়ে রাষ্ট্রদূত বলেন, সরকার এবং জনগণের উপর বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। আশা করি, বাংলাদেশের ভালোর জন্য তারা সঠিক সিদ্ধান্তটিই গ্রহণ করবেন।

একসময় জাতিসংঘে স্থায়ী মিশনে কোরিয়ার উপ-স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন লি জ্যাং-কিউন। এছাড়া, অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি, মরক্কোতে অবস্থিত দক্ষিণ কোরিয়ার দূতাবাসে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদেও দায়িত্ব পালন করেছেন। ঢাকা ত্যাগের ঠিক আগমুহূর্তে অনেকটা আবেগতাড়িত রাষ্ট্রদূত বললেন, বাংলাতে বিদায় নেওয়ার সময় 'গুডবাই' জাতীয় কিছু বলা হয় না। বলা হয় 'দেখা হবে'। তোমাদের সাথে আবার দেখা হবে।