গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্মরণে আন্তর্জাতিক দিবস

‘সন্তানের মুখে মা ডাক শুনতে আর কত অপেক্ষা করব’

‘সন্তানের মুখে মা ডাক শুনতে আর কত অপেক্ষা করব’

আবদুল কাদের ভূঁইয়া যখন নিখোঁজ হন, তখন তিনি তিতুমীর কলেজের অনার্স তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। এরপর কেটে গেছে এক দশক। এখনো সন্ধান নেই তার। একমাত্র সন্তান ঘরে ফিরবে, এখনো সেই প্রতীক্ষায় আছেন মা আয়েশা আলী। তিনি যখন সন্তানের কথা বলছিলেন, তার কণ্ঠ বারবার জড়িয়ে যাচ্ছিল। নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার পরিচয়, আমি গুম হওয়া সন্তানের মা। আমার একমাত্র সন্তানকে গুম করা হয়েছে। ১০টি বছর কেটে গেল, সন্তান ফিরল না। একটি বার সন্তানের মুখে মা ডাক শোনার জন্য আর কত অপেক্ষা করব।’

বুধবার ‘গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্মরণে আন্তর্জাতিক দিবস’। দিবসটি উপলক্ষে রাজধানীর কাকরাইলের ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স (আইডিইবি) ভবনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে এসেছিলেন আয়েশা আলী। এই অনুষ্ঠানের আয়োজক গুমের শিকার পরিবারগুলোর সংগঠন ‘মায়ের ডাক’। অনুষ্ঠানে কথা বলার সময় আয়েশা আলী কান্নায় ভেঙে পড়েন। একপর্যায়ে মুখ দিয়ে রক্তও বের হয় তার। তিনি বলেন, ‘সন্তান যদি ঘর থেকে বের হয়ে ফিরে না আসে, এই যন্ত্রণা নিয়ে একজন মায়ের বেঁচে থাকা কতটা কষ্টের, কতটা যন্ত্রণার-সেটা বলে বোঝানো সম্ভব নয়।’

২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিচয়ে তেজগাঁও থানার ৩৮ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাজেদুল ইসলাম সুমনসহ আটজনকে তুলে নেওয়া হয়। এই আটজনের একজন ছিলেন আবদুল কাদের ভূঁইয়া। ‘মায়ের ডাক’ আয়োজিত অনুষ্ঠানে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় গুমের শিকার পরিবারের স্বজনেরা এসেছিলেন। সংহতি জানিয়ে অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিয়েছেন বিশিষ্টজনেরা।

অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, গুমের মতো অমানবিক কাজ যারা করেছেন, আজ পর্যন্ত তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। অনেক বাবা-মা প্রশ্ন করেছেন, কেন তাদের সন্তানেরা গুম হয়েছেন। অনেক সন্তানও প্রশ্ন করেছে, তাদের বাবা কেন গুম হয়েছেন। মূলত ভিন্নমতের মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিতে, তাদের স্তব্ধ করে দিতে এই গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চালানো হয়। অবৈধভঅবে ক্ষমতায় টিকে থাকতেই তারা এসব করছেন।

দেশে গুমের বিচার না হলে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে একদিন এসবের বিচার হবে উল্লেখ করে আসিফ নজরুল বলেন, ‘আপনারা যে গুমের বিচার করছেন না, এ দেশের আদালতে যখন গুমের বিচার হচ্ছে না, এই বিচার না হওয়ার পেছনে যারা আছেন, তাদের আন্তর্জাতিকভাবে হলেও একদিন অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি হতে হবে।’

গুমের ঘটনায় যারা জড়িত, তাদের বিচার দাবি করেন মানবাধিকারকর্মী নুর খান লিটন। তিনি বলেন, যারা গুমের ঘটনায় জড়িত, তাদের চিহ্নিত করতে হবে, বিচারের আওতায় আনতে হবে। জড়িত ব্যক্তি যদি সর্বোচ্চ ব্যক্তিও হন, তারও বিচার করতে হবে। কারণ, অপরাধী পার পাবেন, এই সুযোগ নেই।

তবে এই সরকার গুম-খুনের বিচার করবে না বলে মনে করেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না। তিনি বলেন, ‘এই সরকার যত দিন আছে, তত দিন গুম-খুনের বিচার হবে না। পাঁচ বছর আগেও এই কথা বলেছি, এখনো একই কথা বলছি। এই সরকার হৃদয়হীন সরকার। এই রাষ্ট্র এখন মানবিক নয়, এই রাষ্ট্র এখন গণতান্ত্রিক নয়। এই রাষ্ট্র এখন ফ্যাসিস্ট।’

এদিকে বিএনপির মানবাধিকারবিষয়ক সম্পাদক আসাদুজ্জামান অভিযোগ করে বলেন, ‘গত ১৪ বছরে দেশে যত গুম হয়েছে, সবই রাজনৈতির মতাদর্শের কারণেই করেছে সরকার।’  

অনুষ্ঠানে সংহতি জানিয়ে আরও বক্তব্য দেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক নারী জোটের আহ্বায়ক তানিয়া রব, অধ্যাপক সি আর আবরার, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য তাবিথ আউয়াল,  মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরী, গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক (নুর), পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অমল ত্রিপুরা প্রমুখ।

‘ছেলের লাশ দেখে যেন মরতে পারি’

২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিচয়ে তুলে নেওয়ার পর আর ফেরেননি বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলাম। ‘মায়ের ডাক’ আয়োজিত অনুষ্ঠানে সভাপতি ছিলেন সাজেদুলের মা হাজেরা খাতুন। অনুষ্ঠানে তিনি শুধু বললেন, ‘সবাই দোয়া কইরেন, মরার আগে যেন ছেলেকে একটিবার দেখে মরতে পারি।’
মায়ের ডাকের আহ্বানে অনুষ্ঠানে এসেছিলেন ২০১২ সালে নিখোঁজ বরিশালের ছাত্রদল নেতা ফিরোজ খানের স্ত্রী আমেনা আক্তার। তিনি বলেন, তিন মাসের ব্যবধানে ফিরোজ খান ও তার ভাই মিরাজ খান নিখোঁজ হন। তারপর থেকে আর কোনো খোঁজ নেই। তারা দুজনেই বিএনপির রাজনীতি করতেন। স্বামী নিখোঁজ হওয়ার পর নিরাপত্তার কারণে তিনি বরিশাল থেকে পিরোজপুরে চলে যান। একমাত্র সন্তানকে নিয়ে সেখানে তিনি সেলাইয়ের কাজ করে মানবেতর জীবন পার করছেন।  

মোটরসাইকেলের আওয়াজ পেলেই ভাবি, হয়তো ফিরেছে

ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৪৩ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদলের সভাপতি খালেদ হাসানকে ২০১৩ সালের ২৭ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়। ঘটনার ১০ বছর পরও তার কোনো খোঁজ নেই। আজকের অনুষ্ঠানে এসেছিলেন খালেদ হাসানের স্ত্রী শারমিন সুলতানা। তিনি বলেন, ‘সোহেলের একটি মোটরসাইকেল ছিল। রাতে হঠাৎ মোটরসাইকেলের আওয়াজ পেলেই ভাবি, সোহেল (খালেদ হাসান) হয়তো ফিরেছে। সোহেল আর ফিরে না। জানি না সে বেঁচে আছে, নাকি মরে গেছে। আমার পরিচয় এখন গুম সোহেলের স্ত্রী আর আমার সন্তানের পরিচয় গুম সোহেলের ছেলে। আমার একটাই দাবি, আমার স্বামীকে আমাদের কাছে ফিরিয়ে দিন।’

‘বিচার চাই না, ভাইয়ের লাশটি একবার ছুঁয়ে দেখতে চাই’

২০১০ সালের ২৫ জুন রাজধানীর ইন্দিরা রোড থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয় ঢাকার শাহবাগ এলাকার ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও বিএনপি নেতা চৌধুরী আলমকে। এরপর থেকে তার আর খোঁজ নেই। আজকের অনুষ্ঠানে এসেছিলেন চৌধুরী আলমের ভাই খোরশেদ আলম। তিনি সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে বলেন, ‘আমার ভাই কোন অপরাধে ১৩ বছর ধরে গুম হয়ে আছে জানি না। আমি বিচার চাইব না, কোনো মামলা করব না, কোনো প্রতিবাদও করব না। শুধু ভাইয়ের লাশটা ফেরত চাই। একটাই চাওয়া আমার, ভাইকে যেন নিজ হাতে কবর দিতে পারি, ভাইয়ের লাশ একবার ছুঁয়ে দেখতে পারি।’

স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি

গুমের ঘটনায় স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি জানিয়েছেন মায়ের ডাকের সমন্বয়কারী আফরোজা ইসলাম আঁখি। তিনি বলেন, ‘মায়ের ডাক গুম বন্ধ করাসহ গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের কাছে অবিলম্বে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানাচ্ছে। ভুক্তভোগী পরিবারগুলোকে হয়রানি বন্ধ করা এবং অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার আহ্বান জানাচ্ছে। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী গুমের সব অভিযোগের স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্তের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্তদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে। গুমসংক্রান্ত জাতিসংঘের ওয়ার্কিং কমিটিকে বাংলাদেশে আসার অনুমতি দেওয়ার দাবি জানাচ্ছে।’