ওয়েবিনারে বক্তারা

আগের দুটির মতো প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন হলে অর্থনৈতিক সংকট আরও ঘনীভূত হবে

আগের দুটির মতো প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন হলে অর্থনৈতিক সংকট আরও ঘনীভূত হবে

দেশে চলমান অর্থনৈতিক সংকটটি রাজনৈতিক সংকটের সঙ্গে জড়িত। আগের দুটির মতো প্রশ্নবিদ্ধ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হলে দেশের চলমান অর্থনৈতিক সংকট আরও ঘনীভূত হবে। এই সংকট থেকে বের হওয়ার একটাই পথ—জনগণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা।

বৃহস্পতিবার ‘দমন, আন্দোলন ও অর্থনীতি: বাংলাদেশের পথরেখা’ শীর্ষক ওয়েবিনারে আলোচকেরা এসব কথা বলেন। ওয়েবিনারটির আয়োজন করে ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজ।

ওয়েবিনারে সমাপনী বক্তব্য দেন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগ ডিস্টিংগুইশড অধ্যাপক আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, ‘অর্থনৈতিক এই সংকট অকস্মাৎ তৈরি হয়নি। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যে ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছে, তার অনিবার্য পরিণতি এই অবস্থা। শাসনের যে অবস্থা, কারও জবাবদিহি নেই। ক্ষমতাসীনেরা ধরেই নিয়েছে, দমনের মধ্য দিয়েই অব্যাহত শাসন বজায় রাখবেন। এর মাশুল দিচ্ছে দেশের মানুষ।’

অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ‘বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট থেকে বের হওয়ার একটাই পথ। সবাইকে ভোট দিতে দিন। বাংলাদেশের পথরেখা কী হবে, তা জনগণকে সিদ্ধান্ত নিতে দিন। অংশগ্রহণমূলক শাসনব্যবস্থা ছাড়া অংশগ্রহণমূলক অর্থনীতি হবে না। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ছাড়া অংশগ্রহণমূলক রাজনীতি হবে না। অর্থনৈতিক সংকটকে বিচ্ছিন্নভাবে ভাবতে পারবেন না। ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠাই সংকট থেকে বের হওয়ার পথ।’  

২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো নির্বাচন দেখতে চান না জানিয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, সরকারের সময় শেষ হয়ে আসছে। কীভাবে সমঝোতায় আসতে পারে, সেটি চিন্তা করতে হবে। সরকার ও বিরোধী দুই পক্ষকেই ছাড় দিতে হবে। সুন্দর একটি নির্বাচন হোক। গণতান্ত্রিক চর্চা যেন আবার ফিরে আসে।
দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের পেছনে সরকার দায়ী বলে মন্তব্য করেন অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, আর্থিক খাতে ভয়ানক দুরবস্থা চলছে। গত ৩০ বছরে এমন দীর্ঘ সংকটের মধ্য দিয়ে অর্থনীতি যায়নি। সরকার জ্বালানি খাত, সার, বিমানের টাকা পরিশোধ করতে পারছে না। এই অবস্থা একদিনে হয়নি। বাজার বুঝে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অর্থনৈতিক খাতে নেতৃত্বের উপস্থিতি ও জ্ঞানের অভাব আছে। দক্ষ ও কর্মক্ষম একজন মন্ত্রী দরকার। সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। এসব সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক কারণে নেওয়া হয়েছে।

নির্বাচন পর্যন্ত সরকার ঠেকা দিয়ে অর্থনীতিকে চালাবে বলে মনে করেন আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার সংকট সহজে যাবে না। কোনোভাবে নির্বাচন করে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেও যারা অপকর্ম করেছে, তাদের ঝেঁটিয়ে বের করতে পারবে না। কারণ, তাদের দিয়েই নির্বাচনে জিতে আসবে। যে দুর্নীতি দেখা যাচ্ছে, তা রাজনৈতিক অবক্ষয়ের প্রতিফলন। সরকার শুধু বললে হবে না, নির্বাচনের পরে সব ঠিক করে ফেলব। এই জায়গায় সরকারকে চিন্তা করতে হবে।

পুলিশ আইনবহির্ভূতভাবে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে, জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, পুলিশ শক্তি প্রয়োগের ক্ষেত্রে সমানুপাতিক শক্তি প্রয়োগ করছে না। ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশকে ঘিরে সৃষ্ট ঘটনা তদন্ত না করেই পুলিশ বিএনপির ওপর দোষ চাপাচ্ছে। ঘটনা না ঘটলেও বানিয়ে বানিয়ে গায়েবি মামলা করছে। পুলিশের বিশ্বাসযোগ্যতা একেবারে ক্ষুণ্ন হয়েছে।

রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের রাষ্ট্রীয় চরিত্র হারাচ্ছে বলে মন্তব্য করেন অধ্যাপক আসিফ নজরুল। তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারি দলের ইচ্ছাপূরণের যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠান ও বাহিনী দিয়ে কীভাবে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে? এটা স্পষ্ট সরকার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবহার করে সম্পূর্ণ ইচ্ছামাফিক নির্বাচন করতে চাচ্ছে। একতরফা, সাজানো ও প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন হলে রাষ্ট্রে জবাবদিহি থাকে না, লুটপাট বেশি হয়। আরেকটি সাজানো নির্বাচনের দিতে অগ্রসর হচ্ছি। রাষ্ট্রের জবাবহিদিমূলক প্রতিষ্ঠান, নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম যদি ভূমিকা রাখতে না পারি, তাহলে সবাই মিলে গণ–আত্মহত্যার জন্য প্রস্তুত হচ্ছি। এই আত্মহত্যা গণতন্ত্রের, রাষ্ট্রের সক্ষমতা ও অর্থনৈতিক বিকাশের আত্মহত্যা।  

ওয়েবিনারে প্যানেল আলোচক হিসেবে বক্তব্য দেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট সাবেক রেজিস্ট্রার জেনারেল ইকতেদার আহমেদ। তিনি বলেন, বাংলাদেশে যেভাবে সংবিধান লঙ্ঘন করা হয়, তা বিশ্বের অন্য কোনো দেশে এভাবে হয় না। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দলীয় রূপ ধারণ করেছেন। তারা দলীয় সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সচেষ্ট থাকেন। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাজে আইনের সমতা থাকছে না। গ্রেপ্তার করা ব্যক্তিকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতের সামনে উপস্থাপন করার বিধান। কিন্তু ৩, ৫ বা ১০ দিন পর উপস্থাপন করলেও প্রশ্ন করার কেউ নেই।

ইকতেদার আহমেদ বলেন, বর্তমান সংকট একটা সরকারের মেয়াদ অবসানে কোন ধরনের সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, তা নিয়ে। এটি মীমাংসিত বিষয়। ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা হয়েছিল রাজনৈতিক সমঝোতার ভিত্তিতে। পরে এটি একতরফাভাবে প্রত্যাহার করা হয়েছে।

মুক্ত আলোচনায় অংশ নিয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটটি রাজনৈতিক সংকটের সঙ্গে জড়িত। রাজনৈতিক অবস্থা ত্রুটিপূর্ণ হলে তার বহিঃপ্রকাশ নানাভাবে ঘটে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও তা দেখা যাচ্ছে। রাজনীতিকরণ নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে, ফলে তারা স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। আর্থিক খাতে বিভিন্ন সমস্যা জগদ্দল পাথরের মতো পুঞ্জীভূত হয়ে বসেছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে উপযুক্ত রাজনৈতিক পরিবেশ দরকার।

ওয়েবিনার সঞ্চালনা করেন সাংবাদিক মনির হায়দার। সূচনা বক্তব্য দেন মালয়েশিয়ার ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক মাহমুদুল হাসান।