ওয়েবিনারে বক্তারা

শুধু নির্বাচন ব্যবস্থা নয়, ক্ষমতায় থাকার জন্য সরকার বিচার বিভাগের স্বাধীনতাও ক্ষুণ্ন করছে

শুধু নির্বাচন ব্যবস্থা নয়, ক্ষমতায় থাকার জন্য সরকার বিচার বিভাগের স্বাধীনতাও ক্ষুণ্ন করছে

আদালত মানুষের সর্বশেষ আশ্রয়স্থল। একটা আদালতকে যখন নিপীড়ন তথা মানবাধিকার লঙ্ঘন করার জন্য ব্যবহার করা হয়, তখন একটা দেশের আইনের শাসনে ভরসা করার মতো আর কিছু থাকে না। এবারের ব্যবহার করাটা হচ্ছে অনেক ব্যাপক, সুদূরপ্রসারী ও সর্বনাশা। ক্ষমতায় থাকার জন্য সরকার শুধু নির্বাচন ব্যবস্থা বা পুলিশ প্রশাসনকে নয়, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, মর্যাদা এবং সম্মান ক্ষুণ্ন করার পথে নেমেছে। শুক্রবার ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজের এক ওয়েবিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন।

বক্তারা বলেন, এর খেসারত সরকারকে দিতে হবে। কোনো সমাজে বিচার বিভাগের প্রতি আস্থা যদি ক্রমান্বয়ে হ্রাস পায়, তখন ওই সমাজের অনেক অনিষ্ট হয়। তখন আস্তে আস্তে সমাজ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। সাজানো নির্বাচন, বিচার বিভাগ ও আইনের শাসন শীর্ষক এই ওয়েবিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন প্রফেসর ড. আসিফ নজরুল। আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক, হিউম্যান রাইটস এন্ড পিস ফর বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট মনজিল মোরসেদ। সমাপনী বক্তব্য দেন প্রফেসর ড. রিদওয়ানুল হক। সঞ্চালনা করেন কলামিস্ট জাহেদ উর রহমান।

প্রফেসর আসিফ নজরুল বলেন, ৭ই জানুয়ারি আওয়ামী লীগের সঙ্গে তার ডামি প্রার্থী ও অনুগত দলগুলোর নির্বাচন হচ্ছে। এটা আসলে কোনো নির্বাচন নয়। এটা বাকশাল-২ বা একদলীয় একটা নির্বাচন। এই সাজানো নির্বাচনটা করা হচ্ছে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি নেতাকর্মীদের নির্বাচনী মাঠ থেকে সরিয়ে দিয়ে, সোজাসুজি জেলে ঢুকিয়ে দিয়ে ও ভয় দেখিয়ে।

তিনি বলেন, আজকে নির্বাচনের আগ মুহূর্তে মামলা, হামলা ও নির্যাতনের যে পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হচ্ছে, সেখানে একটা রাজনৈতিক দলের নির্বাচনে অংশগ্রহণ তো দূরের কথা, স্বাভাবিক যে মানবাধিকার সেটা পর্যন্ত ভোগ করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। আমরা এই পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন। বেশি উদ্বিগ্ন এ কারণে যে, এই কাজটা করতে গিয়ে অর্থাৎ বিরোধী দল তথা বিএনপিকে রাজনীতির মাঠছাড়া, ঘর ছাড়া করা, জেলে ঢুকানো, নির্যাতন, আতঙ্কে রাখার প্রক্রিয়ায় শুধু পুলিশ বা দলের নেতাকর্মীদের ব্যবহার করা হচ্ছে না। এখানে আদালত, ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেমকেও ব্যবহার করা হচ্ছে। এটা খুবই উদ্বেগজনক বিষয়।

তিনি আরও বলেন, আদালত মানুষের সর্বশেষ আশ্রয়স্থল। একটা আদালতকে যখন নিপীড়ন তথা মানবাধিকার লঙ্ঘন করার জন্য ব্যবহার করা হয়, তখন একটা দেশের আইনের শাসনে ভরসা করার মতো আর কিছু থাকে না। এবারের ব্যবহার করাটা হচ্ছে অনেক ব্যাপক, সুদূরপ্রসারী ও সর্বনাশা। ক্ষমতা থাকার জন্য সরকার শুধু নির্বাচন ব্যবস্থা বা পুলিশ প্রশাসনকে নয়, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, মর্যাদা এবং সম্মান ক্ষুণ্ন করার পথে নেমেছে।

মনজিল মোরসেদ বলেন, সাজানো নির্বাচনের দুটি অংশ-একটি হলো নির্বাচনের সঙ্গে সম্পৃক্ত আরেকটি হলো ক্ষমতা। কারণ, ক্ষমতা না থাকলে সাজানো যায় না। এখন গণতন্ত্র ও ক্ষমতা দুটোই বিবেচনা করলে দেখতে হবে এখন যে গণতন্ত্র সেটি আমাদের সংবিধানের সঙ্গে কতটুকু যায়, সেটা বিবেচনা করতে হবে। কারণ আমাদের সংবিধানের আর্টিকেল ৭ এ বলা হয়েছে-'সকল ক্ষমতার উৎস জনগণ'। জনসাধারণের ক্ষমতাটা জনগণের প্রতিনিধির মাধ্যমে প্রয়োগ করতে হবে। আর্টিকেল ৭২-এ বলা হয়েছে সংবিধান হলো সর্বোচ্চ আইন। এর আরেকটি সংশোধনীতে বলা হয়েছে, যদি এই সংবিধান স্থগিত করা হয় তাহলে তাদের সর্বোচ্চ সাজা হবে। তিনি বলেন, আর্টিকেল ৭-এ গণতন্ত্রের নিশ্চয়তা এবং জনগণের ক্ষমতার যে কথাটা বলা হয়েছে, তা বর্তমান নির্বাচনের সঙ্গে ট্যাগ করলে দেখা যাবে জনগণের ক্ষমতার অনুপস্থিতি। সেক্ষেত্রে দেখবেন আর্টিকেল ৭'র অনুপস্থিত রয়েছে। এমনকি সংবিধানের চারটি মূলনীতির মধ্যে যে গণতন্ত্র রয়েছে সেটিরও অনুপস্থিত রয়েছে।

এ সময় চলমান বিভিন্ন রাজনৈতিক মামলার রায়ের প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে ড. শাহদীন মালিক বলেন, এসব মামলার কারণে জনগণের কাছে বিচার বিভাগের প্রতি আস্থাহীনতা বেড়ে যাচ্ছে। এতে বিএনপিকে মাঠের বাইরে বের করে দিয়ে সরকারের বিশেষ উদ্দেশ্য সফল হচ্ছে কিন্তু এর খেসারত দিতে হবে। কোনো সমাজে বিচার বিভাগের প্রতি আস্থা যদি ক্রমান্বয়ে হ্রাস পায়, তখন ওই সমাজের অনেক অনিষ্ট হয়। তখন আস্তে আস্তে সমাজ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে।