সর্বনিম্ন তাপমাত্রার রেকর্ড গড়ল তেঁতুলিয়া

সর্বনিম্ন তাপমাত্রার রেকর্ড গড়ল তেঁতুলিয়া

পৌষের প্রথম দিন আজ। পঞ্চগড়ের শীতের রাজ্যে পৌষ ও মাঘ- এই দু’মাস মহাদুর্ভোগের। মৃদু, মাঝারি এবং তীব্র শৈত্যপ্রবাহের আবর্তে এক অঙ্কের তাপমাত্রা নিয়ে শীত স্থায়ী আস্তানা তৈরি করে সীমান্তঘেঁষা এই জনপদে। ঘন কুয়াশা আর বৃষ্টির মতো তুষারপাতের সঙ্গে পাহাড় থেকে নেমে আসা হিম বাতাস পঞ্চগড়ের জনপদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে দুর্বিষহ করে তোলে।

শনিবার (১৬ ডিসেম্বর) তেঁতুলিয়ায় তাপমাত্রা ৯ ডিগ্রির ঘরে বিরাজ করছে। সকাল ৭টায় তেঁতুলিয়ার আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৯ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ফলে প্রথম পৌষেই মাঝারি শৈত্যপ্রবাহের প্রভাব জনজীবনে পড়েছে। ইতোমধ্যে হিমালয় থেকে ধেয়ে আসতে শুরু করেছে ঠান্ডা বাতাস। তবে সকাল ১১টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত সূর্যের হালকা উষ্ণতা থাকছে। তারপর হিমালয় থেকে বাতাস বইতে শুরু হলে সন্ধ্যা হতেই হাটবাজারসহ রাস্তাঘাট হয়ে পড়ছে জনশূন্য। মানুষজন ঘরমুখী হয়ে পড়ছে।

বিশেষ করে এই অঞ্চলের সমতলের চা বাগানের চা শ্রমিকসহ নদীকেন্দ্রিক পাথর শ্রমিকরা নদীর ঠান্ডা জলে নামতে না পারায় তাদের জীবন-জীবিকায় টান পড়েছে। জীবিকার তাগিদে নদীর পাড়ে বসে দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা করে অবশেষে ঠান্ডা পানিতে নেমে পাথর সংগ্রহ করছে তারা। সবমিলিয়ে জীবন-জীবিকার স্বার্থে শীতবস্ত্রের সঙ্গে শীতার্ত মানুষের মাঝে সরকারি খাদ্য সহায়তাও জরুরি হয়ে পড়েছে।

পঞ্চগড় স্টেডিয়ামের সামনে শীতের পিঠা বিক্রি করে অসুস্থ স্বামী এবং সন্তানদের ভরণপোষণ চালান কমলা বেগম। তিনি জানান, খোলা আকাশের নিচে মাথায় পলিথিনে ছাউনি দিয়ে তৈরি তার সেই পিঠার দোকানে প্রতিদিন বিক্রি হয় ১ থেকে দেড় হাজার টাকা। প্রথম প্রথম ভালো বিক্রি হলেও শীত বাড়তে থাকায় বেচা-কেনা বর্তমানে কমতে শুরু করেছে।

শহরতলীর হাফিজাবাদ ইউনিয়নের সহরত আলী, মজিবর রহমান, আহাম্মদ নগর গ্রামের আবু তাহের সুফিয়ান- এরা সবাই অটোরিকশা চালিয়ে সংসার চালায়। শহরের বিভিন্ন স্থানে তাদের সঙ্গে কথা হলে জানান, তীব্র শীতে যাত্রী কমে যাওয়ায় আয় কমে গেছে। কোনো কোনো দিন নিজের ঘর থেকে মালিকের জমা প্রদান করতে হয়। আগামী জানুয়ারি পর্যন্ত এমন অবস্থা থাকবে বলেও জানিয়েছেন তারা।

এদিকে, প্রথম পৌষেই পঞ্চগড়ে শীতের প্রকোপ বাড়তে শুরু করেছে। দিনদিন তাপমাত্রা আরও কমে আসছে। ডিসেম্বরের শুরু থেকে এই জেলায় তাপমাত্রা ১৪ ডিগ্রি থেকে ১১ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠানামা করছে। আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, সারা পৌষে এবং মাঘে তাপমাত্রা আরও কমতে শুরু করবে। ৬ ডিগ্রির নিচে গড়িয়ে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ সৃষ্টি করবে এবং টানা জানুয়ারি পর্যন্ত তীব্র শীতের প্রকোপ থাকবে।

গত দু’সপ্তাহ ধরে এ জেলায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা বিরাজ করছে। দিনের বেলা সূর্য উঠলেও রৌদ্রের তেজ তেমন থাকে না। বিকেল গড়াতেই গ্রাম-গঞ্জের হাটবাজারগুলো জনশূন্য হয়ে পড়ছে, মানুষ ঘরমুখী হয়ে পড়ছে। হিমালয়ের অবস্থান খুব কাছে হবার কারণে সন্ধ্যা হতেই পাহাড়ি হিমেল হাওয়া আছড়ে পড়ছে সীমান্তের এই জনপদে। ফলে জনজীবনে দুর্ভোগ বাড়ছেই। বিশেষ করে চা ও পাথর শ্রমিকরা পড়ছে বিপাকে। এই সময়টিতে নিম্নআয়ের মানুষদের শীত নিবারণে সীমাহীন কষ্ট করতে হয়। কর্মজীবী মানুষরাও হয়ে পড়ে কর্মহীন। অনেকেই খড়কুটো জ্বালিয়ে উষ্ণতা নেন।

এছাড়াও শীতের প্রকোপ বাড়তে শুরু করায় জেলার হাসপাতালগুলোতে দিনদিন শীতজনিত রোগে শিশু এবং বয়স্ক মানুষ আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হচ্ছেন। জেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগ জানিয়েছে, টানা তীব্র শীতে গবাদি পশুর নানা রোগ-বালাই দেখা দিয়েছে। গরু ছাগলের সর্দি, ডায়রিয়াসহ খুরা রোগ দেখা দিয়েছে।

অবশ্য, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দরিদ্র শীতার্তদের জন্য সামান্য পরিসরে শীতবস্ত্র পঞ্চগড়ের পাঁচটি উপজেলার বিতরণ করা হয়েছে। সেই সঙ্গে নতুন করে শীতবস্ত্র বরাদ্দের জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মন্ত্রণালয়ে বার্তা পাঠানো হয়েছে। পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক মো. জহুরুল ইসলাম জানিয়েছেন, ডিসেম্বর এবং জানুয়ারি- এই দুই মাস পঞ্চগড়ের মানুষের জীবনে নেমে আসে অবর্ননীয় দুর্ভোগ। তীব্র শীতে মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ে। সাধারণ মানুষদের সহায়তার বিষয়টি কঠিন হয়ে পড়ে। আগামী দু’মাস এসব শীতার্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে সরকারিভাবে ব্যবস্থা গ্রহণের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। পাশাপাশি অসহায়-দুস্থ মানুষদের খাদ্য সহায়তাসহ শীত মোকাবিলায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

এদিকে, তেঁতুলিয়া আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের কর্মকর্তা রোকন উদ্দিন জানিয়েছেন, তেঁতুলিয়ায় গত দু’সপ্তাহ ধরে ১১ থেকে ১৩ ডিগ্রিতে তাপমাত্রা উঠানামা করছে। বুধবার তাপমাত্রা নেমে গেছে ১১ ডিগ্রির ঘরে। পৌষ পড়লেই এটি আরও নিচে নেমে আসবে। জানুয়ারি মাসের পুরো সময়জুড়ে মাঝারি শৈতপ্রবাহের আশঙ্কা রয়েছে। সেই ক্ষেত্রে তাপমাত্রা ৮ ডিগ্রির নিচে নেমে আসতে পারে।

অন্যদিকে, পঞ্চগড় আধুনিক সদর হাসপাতালের মেডিসিন ও হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মো. মাহবুব আলম জানান, শীত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বয়স্ক এবং শিশুরা আক্রান্ত হচ্ছেন শীতজনিত নানা রোগে। প্রতিদিন হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে অনেক শিশু। হাসপাতালে জায়গার অভাবে মেঝেতে চিকিৎসা নিচ্ছে। তবে অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে শিশু এবং বয়স্কদের নিবিড় পরিচর্যার মধ্যে চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হচ্ছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।