বিজয় দিবস উদযাপিত

বিজয় দিবস উদযাপিত

৫৩তম মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে বীর শহীদদের প্রতি লাখো মানুষ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানিয়েছে। গতকাল শনিবার সকাল থেকেই হাতে লাল সবুজের পতাকা নিয়ে রঙ-বেরঙের ফুল আর ব্যানারসহ স্মৃতিসৌধে আসেন লাখো জনতা। সাধারণ মানুষ তাদের ভালোবাসা দিয়ে স্মরণ করেন স্বাধীনতাযুদ্ধে শহীদ জাতির সূর্য-সন্তানদের। দিনের শুরুতেই জাতীয় স্মৃতিসৌধে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে শহীদদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী। এসময় বিউগলে করুণ সুর বেজে ওঠে। তখন তিন বাহিনীর একটি সুসজ্জিত  চৌকস দল তাদের সালাম জানায়। এরপর আবারো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগ সভাপতি হিসেবে দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে নিয়ে জাতীয় স্মৃতিসৌধের বেদিতে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এসময় উপস্থিত ছিলেন- জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, প্রধান বিচারপতি ও তিন বাহিনীর প্রধানসহ দেশি-বিদেশি কূটনৈতিকরা। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী স্মৃতিসৌধ ত্যাগ করার পর সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয় স্মৃতিসৌধ। 

সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন  শেষে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, ‘আজকে আমাদের এত সমৃদ্ধি, এত অর্জন, এত উন্নয়ন। এর মধ্যেও আমাদের অগ্রগতির পথে, সমৃদ্ধির পথে এখনো অন্তরায় হয়ে আছে সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদ। এরা শুধু সাম্প্রদায়িকতা কায়েম করতে চায় না, দেশের রাজনীতি ধ্বংস করাই এদের মূল লক্ষ্য। বিএনপি’র নেতৃত্বে আজকে সাম্প্রদায়িকতা ডালপালা বিস্তার করছে এবং আমাদের উন্নয়ন অর্জনের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করছে। গতকাল সকালে মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে তিনি এসব কথা বলেন।

বাংলাদেশে রাজনীতির সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ কামনা করে ওবায়দুল কাদের বলেন, মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের লক্ষ্য ছিল যেটা, সেই রাজনীতিকে এরা ধ্বংস করতে চায়। এ অপশক্তিকে রুখতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়-মূল্যবোধে যারা বলীয়ান, আসুন আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাজনীতিবিরোধী, অসাম্প্রদায়িক এ অপশক্তিকে প্রতিহত করবো, পরাজিত করবো। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ে তুলবো। ওবায়দুল কাদের আরও বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ২১ বছর দেশের গণতন্ত্র ছিল শৃঙ্খলে বন্দি। ২১ বছর মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ ছিল পদদলিত। স্বাধীনতার আদর্শ ছিল ভূলুণ্ঠিত। বঙ্গবন্ধু হত্যার ছয় বছর পর বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা স্বদেশে ফিরে আসেন। হতাশ বাঙালি জাতিকে আশাবাদী করে তোলেন। জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে গণতন্ত্রের শৃঙ্খল মুক্তির সংগ্রাম শুরু করেন। এরপর দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এ দেশের উন্নয়নের ফল আজকের বাংলাদেশ, ডিজিটাল বাংলাদেশ।

আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, আজকের বাংলাদেশ উন্নয়নশীল বাংলাদেশ। ১৫ বছর আগের বাংলাদেশ আর আজকের বাংলাদেশ উন্নয়নে, অর্জনে, সমৃদ্ধিতে নতুন উচ্চতা পেয়েছে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৩৫তম অর্থনীতির দেশ। আজকে বাংলাদেশের প্রভার্টি লাইনের যে উচ্চসীমা আজকে ১৮ দশমিক ৭ শতাংশে নেমে এসেছে, হতদরিদ্র ৫ শতাংশে নেমে এসেছে; এটা একটা বিরাট অর্জন, বিরাট সমৃদ্ধি। 

ওবায়দুল কাদের বলেন, বিএনপি-জামায়াত বাংলাদেশকে পেছনে ফিরিয়ে নিতে চায়। তারা দেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রাকে থমকে দিতে চায়। দেশের অগ্রযাত্রাকে যারা রুখে দিতে চায়, যেকোনো মূল্যেই চেষ্টা করে তাদের প্রতিরোধ করা হবে। আজকের দিনে আমাদের সেই অঙ্গীকার করতে হবে।

বিএনপি মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে গতকাল সকাল পৌনে দশটার দিকে সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান বলেন, বিজয়ের ৫২ বছর পর আজকে আমরা কোন বিজয় উদ্যাপন করতে এসেছি? সেটি আজকে বাংলাদেশের মানুষের সামনে তুলে ধরতে হবে। এটা কিসের বিজয়? এটা কি একনায়কতন্ত্র শাসনের বিজয়? নাকি এখানে এমন একটি সরকার চলছে, যারা মানুষকে কথা বলতে দেয় না, যারা মানুষকে ভোট দিতে দেয় না। যারা মানুষকে অর্থনৈতিক মুক্তি দিতে ব্যর্থ হয়েছে।

তিনি বলেন, আজকে আওয়ামী লীগ এদেশের কোটি কোটি মানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে গণতন্ত্রের অপমৃত্যু ঘটিয়েছে। তারা চরম দুর্বৃত্তায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিয়েছে। আজকে স্বাধীনতার ৫২ বছর পর এসে বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষকে এই প্রশ্ন করতে হবে যে, আওয়ামী লীগ যদি দাবি করে তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি তাহলে কেন তারা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে জলাঞ্জলি দিয়ে বাংলাদেশে একদলীয় স্বৈরাচারী সরকার কায়েম করেছে? এই প্রশ্নের জবাব আওয়ামী লীগকে দিতে হবে।

ড. মঈন খান আরও বলেন, আমরা স্পষ্ট ভাষায় বলে দিতে চাই, বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষ এই সরকারকে প্রত্যাখ্যান করেছে। এই সরকারের নৈতিক পরাজয় ইতিমধ্যেই হয়েছে। আরও একটি নির্বাচনের তফসিল দিয়েছে। কোন নির্বাচন? যে নির্বাচনে তারা প্রকাশ্যে সব লজ্জা ভুলে গিয়ে প্রকাশ্যে দর কষাকষি করে তারা সিট ভাগাভাগি করছে। এটার নাম গণতন্ত্র হতে পারে না। যদি সিট ভাগাভাগি করে এমপি নির্বাচিত হয়, তাহলে তো এই নির্বাচন ইতিমধ্যে ব্যর্থ হয়ে গেছে। তারা নির্বাচনী ফলাফল তাদের কাগজে কলমে রাজধানীতে সর্বোচ্চ অফিসে বসে লিখে ফেলেছে। আগামী ৭ তারিখ শুধু সেই ফলাফল তারা ঘোষণা দেবে। এটা কোনো নির্বাচন নয়, এই নির্বাচন দিয়ে বাংলাদেশের মানুষকে ধোঁকা দেয়া যাবে না। 

তিনি আরও বলেন, আজকে আমরা বাংলাদেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেছি ও বাংলাদেশের কোটি মানুষকে সম্পৃক্ত করেছি। আমরা শান্তিপূর্ণ, গণতান্ত্রিক, নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে বিশ্বাসী। আমরা লগি-বৈঠার রাজনীতি করি না। বিএনপি লগি-বৈঠার রাজনীতি করে না। শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়ায় এ দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনবো, সেই কারণে রাজপথে আছি। সরকারের সব ধরনের উস্কানি বর্জন করুন। মিথ্যা মামলা, হামলা এবং ভুয়া ও গায়েবি মামলা দিয়ে গত ছয় সপ্তাহে ২৩ হাজার নেতাকর্মীকে কারারুদ্ধ করেছে। এই সরকার ভুয়া মামলা দিয়ে আমাদের গণতন্ত্রকামীদের কারারুদ্ধ করে এই দেশে তারা থাকতে পারবে না। এই দেশের মানুষ তাদের বর্জন করেছে। আমাদের দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে তারা রাজনৈতিক মামলা দিয়ে কারারুদ্ধ করে রেখেছে। আমাদের মহাসচিবকে তারা গায়েবি মামলা দিয়ে কারারুদ্ধ করে রেখেছে। আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে ১/১১ এর ভুয়া মামলা দিয়ে তারা তাকে বিদেশে আটকে রেখেছে, তিনি দেশে ফিরতে পারছেন না। আজকে বাংলাদেশের মানুষ জেগে উঠেছে। তারা জানে এই দেশে কোনো ধোঁকাবাজি করে কেউ সরকারে থাকতে পারবে না। আগামীতে শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে এই সরকারকে অপসারিত করে বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও সুশাসন ফিরিয়ে আনবো। মানবাধিকার ফিরিয়ে আনবো।

শহীদ বেদিতে শ্রদ্ধা নিবেদনের সময় বিএনপি’র জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খানের সঙ্গে স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম, বেগম সেলিমা রহমান, জলবায়ু বিষয়ক সহ-সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান বাবুল, সহ-দপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু, ঢাকা জেলা বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক নিপুণ রায় চৌধুরী, কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য রফিক সিকদার, আমিনুল ইসলাম, বিএনপি চেয়ারপারসনের প্রেস উইং কর্মকর্তা শামসুদ্দিন দিদার প্রমুখ অংশ নেন।

সহযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আসা আশুলিয়ার বীর মুক্তিযোদ্ধা আলতাফ হোসেন মণ্ডল বলেন, বিজয়ের এই দিনে স্মৃতিসৌধে লাখো মানুষের ঢল নেমেছে। সবাই বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন তাই আমিও সহযোদ্ধাদের শ্রদ্ধা জানাতে এসেছি। এখানে এলেই গর্বে বুকটা ভরে যায়। 

অপর মুক্তিযোদ্ধা বজলুল রশিদ বলেন, আমিও সহযোদ্ধাদের শ্রদ্ধা জানিয়েছি। আমি স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হয়ে বেঁচে আছি। কিন্তু আমার সহযোদ্ধারা এই স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে জীবন দিয়েছেন। তারা দেখে যেতে পারেননি স্বাধীনতা। তবে আজ তারা সর্বস্তরের জনগণের শ্রদ্ধায় সিক্ত। এটাও আমার কাছে বড় পাওয়া।

শ্রদ্ধা জানাতে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এএসএম মাসুদ কামাল বলেন, “তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানাতে না পারলে শহীদদের আত্মত্যাগের আদর্শ প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। তরুণ প্রজন্মের কাছে ইতিহাসকে পৌঁছে দিতে হবে, তবেই তারা স্বদেশ প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশ গড়ার কাজে নিবেদিত হবে। আমরা যে অর্থনৈতিক মুক্তির কথা বলছি, সেটিও অর্জন করা যাবে।”

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সাদেকা হালিম বলেন, “মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগের প্রতিদান দেয়া সম্ভব নয়। কিন্তু তারা যে চিন্তা থেকে যুদ্ধ করেছেন তা আমাদের ধারণ করা উচিত। আমাদের প্রত্যয় হতে হবে, আমরা সেটাকে রক্ষা করবো, গ্রহণ করবো এবং বাস্তবায়ন করবো।”

প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি স্মৃতিসৌধ ত্যাগ করার পর থেকে পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক সংগঠন, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের শ্রদ্ধায় ফুলে ফুলে ভরে উঠে স্মৃতিসৌধের বেদি।