গ্রামাঞ্চলে লোডশেডিং তীব্র

গ্রামাঞ্চলে লোডশেডিং তীব্র

গরমের সঙ্গে সঙ্গে সারা দেশেই বাড়ছে বিদ্যুৎ সংকট। গত সপ্তাহ থেকে দেশের কিছু গ্রামীণ এলাকায় দীর্ঘ সময় ধরে লোডশেডিং চলছে।

বিভিন্ন বিভাগীয় শহরের বাসিন্দাদের প্রতিদিন অন্তত এক ঘণ্টা বিদ্যুৎ বিভ্রাটের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। কিছু জেলায় ছয় থেকে সাত ঘণ্টাও বিদ্যুৎ বিভ্রাট থাকছে, যেখানে তাপমাত্রা থাকছে ৩৬-৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

বিদ্যুতের ঘাটতির প্রভাব পড়তে শুরু করেছে ব্যবসা-বাণিজ্য ও সেচের ওপর।

গতকাল বিকেল ৩টা পর্যন্ত বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) ১৪ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে ১২ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছে, যা চাহিদার তুলনায় প্রায় এক হাজার ৬০০ মেগাওয়াট কম।

পিডিবির তথ্য অনুযায়ী, গত সপ্তাহেও একই অবস্থা ছিল। মঙ্গলবার সর্বোচ্চ এক হাজার ৮২৬ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়েছে।

পিডিবির কর্মকর্তারা বলছেন, তারা বিদ্যুৎ সরবরাহে ঢাকাসহ অন্যান্য বিভাগীয় শহরকে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পিডিবির এক শীর্ষ কর্মকর্তা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ঢাকার দুটি বিতরণ কোম্পানি (ডিপিডিসি ও ডেসকো) ছাড়া বাকি পাঁচটিই চাহিদার তুলনায় কম বিদ্যুৎ পাচ্ছে।'

চাহিদার তুলনায় প্রায় ২৫ শতাংশ বিদ্যুৎ কম পাচ্ছে গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ বিতরণের কোম্পানি বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি)।

দেশের অর্ধেকের বেশি গ্রাহক আরইবি কাভারেজের আওতাধীন।

আরইবির একাধিক কর্মকর্তার ভাষ্য, চাহিদার তুলনায় সরবরাহে ২৫ শতাংশ ঘাটতির কারণে গ্রামীণ এলাকাগুলোতে প্রতিদিন পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে।

সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ময়মনসিংহ জোনের বাসিন্দাদের কোনো কোনো দিন সাত ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিংয়ের মুখোমুখি হতে হয়। এই জোনে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎকেন্দ্র নেই।

ময়মনসিংহ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ (মুক্তাগাছা) এর মহাব্যবস্থাপক শহিদ উদ্দিন জানান, প্রতিদিনের চাহিদার তুলনায় প্রায় ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ কম পাচ্ছেন তারা।

'গত সপ্তাহ থেকে পরিস্থিতি তীব্র আকার ধারণ করেছে', বলেন তিনি।

মুক্তাগাছায় নিজ গ্রামে বেড়াতে আসা সিঙ্গাপুরের অভিবাসী শ্রমিক রাশিদুল হাসান বলেন, মার্চে দেশে আসার পর থেকে দিনে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে ছয় থেকে আটবার বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে।

'এখন অসহ্য লাগছে। গরমকাল আসতে এখনো বাকি। তখন পরিস্থিতি কী হবে জানি না', বলেন তিনি।

ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলার রূপসী গ্রামের স্কুলশিক্ষক মো. আজিজুল ইসলাম জানান, বিদ্যুৎ সংকটের কারণে বোরো ধানের সেচও ব্যাহত হচ্ছে।

ময়মনসিংহ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২ এর মহাব্যবস্থাপক আকমল হোসেন জানান, ৩২৫ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে দৈনিক ২৫০ থেকে ২৭৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাচ্ছেন তারা।

ময়মনসিংহের কয়েকটি এলাকায় পিডিবি নিজেই বিদ্যুৎ সরবরাহ করে।

ময়মনসিংহের বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগ-২ (দক্ষিণ) এর নির্বাহী প্রকৌশলী সুব্রত রায় জানান, তাদের দৈনিক সরবরাহ এখন এক হাজার ১০০ মেগাওয়াট, যা চাহিদার তুলনায় প্রায় ২০০ মেগাওয়াট কম।

পিডিবির সদস্য (জেনারেশন) খন্দকার মোকাম্মেল হোসেন বলেন, এই সমস্যার মূলে রয়েছে গ্যাস সংকট।

'আমাদের দৈনিক এক হাজার ২০০ এমএমসিএফডি (মিলিয়ন ঘনফুট) গ্যাসের চাহিদা আছে। কিন্তু আমরা প্রায় ৯৯০ এমএমসিএফডি পাই। একটি ফ্লোটিং স্টোরেজ অ্যান্ড রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিটে রক্ষণাবেক্ষণের কাজ চলছে। দুয়েকদিনের মধ্যে গ্যাস সরবরাহ চালু হলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে', বলেন তিনি।

পিডিবির তথ্য বলছে, দেশের গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রায় ৫০ শতাংশ এখন অলস বসে আছে। গত সপ্তাহে গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলো সর্বোচ্চ ১১ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট উৎপাদন সক্ষমতার বিপরীতে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছে।

কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র দ্বিতীয় সর্বোচ্চ চার হাজার ৩০০ মেগাওয়াট এবং তরল জ্বালানিভিত্তিক কেন্দ্র দুই হাজার ৯০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে।

খন্দকার মোকাম্মেল বলেন, 'তরল জ্বালানিভিত্তিক কেন্দ্রগুলো ২৪ ঘণ্টা উৎপাদন করার জন্য নয়। তবে কিছু কিছু আমরা ২৪ ঘণ্টা ব্যবহার করছি।'

গাজীপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ এর জেনারেল ম্যানেজার আবুল বাশার আজাদ জানান, চাহিদার বিপরীতে প্রায় ২৫ শতাংশ বিদ্যুৎ ঘাটতিতে ভুগছেন তারা।

রাজশাহী শহর ও এর আশপাশের বাসিন্দারা জানান, সেখানে প্রতিদিন প্রায় ছয় ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে।

রাজশাহী শহরের বাসিন্দা আদনান চন্দন বলেন, 'সকালে যখন বাসা থেকে অফিসের জন্য বের হই, তখন বিদ্যুৎ থাকে না। আবার বিকেলে যখন ফিরি, তখনো একই অবস্থা।'

নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেডের প্রধান প্রকৌশলী মো. জাকির হোসেন বলেন, রাজশাহী শহরে ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা থাকলেও তারা ৬৫ থেকে ৭০ মেগাওয়াট পাচ্ছেন।

খুলনা মহানগরীর তেঁতুলতলার বাসিন্দা আরাফাত হোসেন তিনজন কর্মচারী নিয়ে রাত পর্যন্ত তার অফিসে কাজ করেন। তিনি বলেন, আমাদের আউটসোর্সিংয়ের কাজ বিদেশের সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু গত এক সপ্তাহ ধরে লোডশেডিংয়ের কারণে আমাদের কাজে ব্যাপক ব্যাঘাত ঘটছে।

খুলনার বটিয়াঘাটার হোগল বুনিয়া গ্রামের গৌতম মণ্ডলের আছে চিংড়ি খামার। তাকে অ্যারো মেশিনের সাহায্যে চিংড়ির জন্য অক্সিজেন সরবরাহ করতে হয়।

'এর জন্য নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রয়োজন', বলেন তিনি।

'আমার খামারে চিংড়ির প্রায় ৪০ হাজার পোনা আছে। গরম আবহাওয়ায় অ্যারো মেশিনটি প্রতি ঘণ্টায় চালানো দরকার, অন্যথায় পোনাগুলো মারা যেতে পারে। কিন্তু বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে পরিস্থিতি দিনকে দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে।'

গৌতম জানান, গতকাল তাদের এলাকায় অন্তত ছয়বার লোডশেডিং হয়েছে এবং প্রতিবারই তা ৩০ মিনিটের বেশি সময় ধরে ছিল।