পুলিশ ফাঁড়ি থেকে ছেলেকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেলেন এমপি

পুলিশ ফাঁড়ি থেকে ছেলেকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেলেন এমপি

ঘড়ির কাঁটা তখন রাত ১২টা ছুঁইছুঁই করলেও ঈদের কেনাকাটা ঘিরে জেগে ছিল বগুড়া। মানুষে গমগম শহরের ব্যস্ততম এলাকা নবাববাড়ি মোড়। আচকা বিকট শব্দে সাইরেন বাজিয়ে সংসদ সদস্যের (এমপি) স্টিকার লাগানো গাড়িটি বেপরোয়া গতিতে ঢুকে পড়ল সদর পুলিশ ফাঁড়িতে। পেছনে মোটরসাইকেলের বিশাল বহর, সেখানে অর্ধশত দলীয় কর্মী। গাড়ি থেকে নামলেন বগুড়া-৬ (সদর) আসনের এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রাগেবুল আহসান রিপু। তামিল ছবির মতো ‘গুরু’র চোখের ইশারা পেয়েই পুলিশ ফাঁড়ির ভেতরে যুবলীগের দুই নেতার ওপর হামলে পড়ে এমপি বাহিনীর সদস্যরা।

এমপি বাহিনীর এ দাঙ্গাবাজি দেখে উপস্থিত পুলিশ সদস্যরাও বোকা বনে যান। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ফাঁড়ির মধ্যে পিটিয়ে আহত করা হয় জেলা যুবলীগের উপপ্রচার সম্পাদক জিহাদুল শরিফ পরাগ ও সদস্য মোহাম্মদ আদনানকে। তারা মাটিতে লুটিয়ে পড়লে ফাঁড়িতে আটক থাকা ছেলে প্রতিত আহসানকে নিয়ে বীরদর্পে সাইরেন বাজাতে বাজাতে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যান এমপি ও তাঁর দলবল।

জানা যায়, তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ঘটনার শুরু। রোববার রাত ১১টার দিকে শহরের সাতমাথায় জিলা স্কুলের সামনে রাস্তা পার হচ্ছিলেন শাজাহানপুর উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রঞ্জু। এ সময় শিবগঞ্জের পিরব ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আসিফ মাহামুদের ছেলে আবিরের মোটরসাইকেলের সঙ্গে তার ধাক্কা লাগে। এ নিয়ে ছাত্রলীগ নেতা রঞ্জু ও চেয়ারম্যানপুত্র আবির বাগ্‌বিতণ্ডতায় জড়ান। একপর্যায়ে রঞ্জুর পক্ষ নিয়ে যুবলীগ নেতা পরাগ ও আদনান এগিয়ে আসেন। তারা আবির ও তার সঙ্গে থাকা এক বন্ধুকে মারধর করেন। এ খবর মোবাইল ফোনে আবির তার বন্ধু এমপিপুত্র প্রতিতকে জানায়। তখন বন্ধুর ওপর হামলার শোধ নিতে আরও পাঁচটি মোটরসাইকেলে ১০ জন নিয়ে ঘটনাস্থলে যায় প্রতিত। তারা সেখানে ছাত্রলীগ নেতা রঞ্জুসহ যুবলীগের ওই দুই নেতার ওপর হামলা ও মারধরের চেষ্টা করে। ঘটনাস্থলে উপস্থিত পুলিশ সদস্যরা হট্টগোল দেখতে পেয়ে এমপিপুত্র প্রতিত, ছাত্রলীগ নেতা রঞ্জুসহ দু’পক্ষের ১০ থেকে ১২ জনকে আটক করে সদর পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে আসেন। সেখানে উভয়ের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি মিটমাটের চেষ্টা চালান সদর পুলিশ ফাঁড়ির ইন্সপেক্টর সুজন মিয়া।

এদিকে ছেলেকে আটক করার খবর পেয়ে এমপি রিপু তাঁর অর্ধশত অনুসারী নিয়ে ছুটে যান। এরপর কিছু বুঝে ওঠার আগেই পুলিশ কর্মকর্তাদের সামনে ওই দুই যুবলীগ নেতাকে পেটাতে থাকে এমপির কর্মীরা। এ সময় পুলিশ সদস্যরা বাধা দিতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে দর্শক বনে যান। সেখানে উপস্থিত গাবতলী উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা আমিনুর রহমান মুক্তাও এমপি অনুসারীদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা জেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, ‘এমপি সাহেবের কর্মকাণ্ড দেখে আমি হতবাক। তাকে মনে হচ্ছিল ভিলেন।’ ঘটনার বর্ণনা দিয়ে ওই নেতা আরও বলেন, ‘মারধর শেষ হলে এমপি রিপু ফাঁড়ির ইনচার্জ পুলিশ পরিদর্শক সুজন মিয়াকে ধমক দিয়ে বলেন, ‘অফিসার, আমার ছেলে কোন অপরাধ করেছে? তার বিরুদ্ধে কি কোনো আইনি ব্যবস্থা নেবেন? আদালতে পাঠাবেন?’ এ সময় তাঁর চোখ রাঙানি দেখে ভয়ে চুপসে যান পুলিশের ওই কর্মকর্তা। তিনি উত্তরে বলেন, ‘আপনার ছেলে কোনো অপরাধ করেনি, স্যার। তাকে বাসায় নিয়ে যেতে পারেন।’

এদিকে এমপি রিপু তার ছেলে ও ছেলের বন্ধুদের নিয়ে চলে গেলে পুলিশ পড়ে বিপদে। ঘটনাটি কীভাবে সামাল দেওয়া যায়, সেটা ভেবে তারা হামলার শিকার আহত দু’জনসহ অপর পক্ষের চারজনকে ফাঁড়িতে আটকে রাখে। তারা হলেন ছাত্রলীগের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রঞ্জু, যুবলীগ নেতা জিয়াদুল শরিফ পরাগ, মোহাম্মদ আদনান ও মোহাম্মদ রঞ্জন। রাত ১টার দিকে পরাগ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে পুলিশের হেফাজতে সরকারি মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। এ ছাড়া নানা নাটকীয়তার পর আটক অন্য তিনজনকে ভোরে সদর পুলিশ ফাঁড়ি থেকে ছেড়ে দেয় পুলিশ। তবে পুলিশ ফাঁড়ির মধ্যে মারধরের স্থান ও গেটে চারটি সিসি ক্যামেরা থাকলেও অজানা কারণে সেগুলোতে কিছুই রেকর্ড হয়নি। পুলিশ বলছে, হার্ডডিস্ক নষ্ট হয়ে গেছে।

সদর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ (পরিদর্শক) সুজন মিয়া বলেন, ‘সাতমাথায় দুই পক্ষের হট্টগোলের মীমাংসা করিয়ে দিতে তাদের ফাঁড়িতে আনা হয়েছিল। সেখানে এমপি স্যারের ছেলেও ছিল। এমপি স্যার জানতে পেরে ছেলেকে নিতে আসেন। ওই সময়ে কিছু লোকজন যুবলীগের দুই নেতাকে কেন মারধর করল, বুঝতে পারিনি।’

মারধরের শিকার যুবলীগ নেতা জিহাদুল শরিফ পরাগ বলেন, ‘সাতমাথায় এমপিপুত্রের বন্ধুদের আমি মারিনি। ঝামেলা দেখতে পেয়ে পুলিশের সঙ্গে ফাঁড়িতে আসি। হঠাৎ ফাঁড়িতে এমপির অনুসারীরা হামলা করে। এমপির ইশারাতেই তারা মারধর করেছে। ফাঁড়িতে পুলিশের উপস্থিতিতে একজন এমপি এমন সন্ত্রাসী হামলা চালাতে পারে, এটা বিশ্বাস হয় না। আমিও তো তার দলের মানুষ। কিছু না শুনেই তারা আমাকে পেটাল।’

শাজাহানপুর ছাত্রলীগের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রঞ্জু বলেন, ‘আমার শরীরে মোটরসাইকেলের ধাক্কা দিয়ে এমপিপুত্র আর তার বন্ধুরা গন্ডগোল শুরু করে। ফাঁড়িতে গিয়ে মীমাংসার সময় এমপি এসে কোনো কথা না শুনেই তার অনুসারী দিয়ে মারধর করান। পরে উল্টো তার নির্দেশে পুলিশ ভোর পর্যন্ত আমাদের ফাঁড়িতে আটকে রাখে।’

ঘটনার বিষয়ে এমপি রিপুর মোবাইলে একাধিকবার ফোন করেও কথা বলতে পারেনি সমকাল। খুদে বার্তা পাঠিয়েও সাড়া পাওয়া যায়নি। তবে তিনি অন্য গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘আমি ছেলেকে নিতে পুলিশ ফাঁড়িতে গিয়েছিলাম। সেখানে কারা মারধর করেছে, আমি জানি না। ঘটনাটি দুঃখজনক।’

বগুড়া সদর থানার ওসি সাইহান ওলিউল্লাহ বলেন, ‘সাতমাথা থেকে কয়েকজনকে ফাঁড়িতে নিয়ে আসার পর অভিভাবকের জিম্মায় সবাইকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। পুলিশের উপস্থিতিতে ফাঁড়িতে কাউকে মারধরের বিষয়ে আমার জানা নেই। তখন সেখানে আমি ছিলাম না, পরে গিয়েছি।’

যুবলীগের তৎপরতা

দুই নেতার ওপর হামলার প্রতিবাদ জানিয়েছে জেলা যুবলীগ। দপ্তর সম্পাদক জাকারিয়া আদিলের স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে হামলাকারীদের ‘কতিপয় চিহ্নিত সন্ত্রাসী’ উল্লেখ করে শাস্তি দাবি করা হয়। তবে এমপির উপস্থিতির বিষয়টি এড়িয়ে গেছে যুবলীগ। জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম ডাবলু বলেন, ‘এমপির উপস্থিতিতে এ ধরনের ঘটনা কেন ঘটল, সেটার খোঁজ নেওয়া হচ্ছে।’

এদিকে দুই নেতার ওপর হামলার প্রতিবাদ ও জড়িতদের গ্রেপ্তারের দাবিতে শহর যুবলীগ সোমবার বিকেলে সাতমাথায় মানববন্ধন করে। দলীয় সভাপতি মাহফুজুল আলম জয়ের সভাপতিত্বে কর্মসূচিতে হামলাকারীদের গ্রেপ্তারে পুলিশ প্রশাসনকে ৭২ ঘণ্টার সময় বেঁধে দেওয়া হয়। মানববন্ধনে প্রশ্ন তুলে বলা হয়, ফাঁড়িতে পুলিশের উপস্থিতিতে কীভাবে যুবলীগ নেতাদের ওপরে হামলা হয়? একজন সংসদ সদস্য, যিনি আওয়ামী লীগের অভিভাবক, তার উপস্থিতিতে তারই লোকজন কীভাবে হামলা চালায়? আগামী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে যদি অপরাধীদের গ্রেপ্তার না করা হয়, তাহলে কঠোর আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।

এমপিপুত্রের যত কাণ্ড

সম্প্রতি শহরের মধুবন সিনেমা হলের সামনে থেকে ২২ বছর বয়সী এক যুবককে তুলে নিয়ে যায় এমপিপুত্র ও তার সহযোগীরা। পূর্বশত্রুতার জের ধরে তারা ওই যুবককে এমপির বাড়ির ছাদে নিয়ে পিটিয়ে রক্তাক্ত করে। বিষয়টি ওই সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে এমপি ওই যুবককে বগুড়া শহর থেকে সরিয়ে দেন এবং পরিবারের সদস্যদের হুমকি দিয়ে মামলা থেকে বিরত রাখেন।

এ ব্যাপারে পৌর আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুল মান্নান আকন্দ বলেন, ‘এমপিপুত্র বগুড়ায় একটি কিশোর গ্যাং চালায়, যা শহরবাসীকে আতঙ্কিত করে তুলেছে। বাবা হিসেবে এমপির উচিত ছেলেকে শাসন করা। তবে তিনি তা কখনোই করেন না।’

অঢেল টাকায় বেপরোয়া চালচলন

২০১৯ সাল থেকে এখনও বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন রাগেবুল আহসান রিপু। ২০২৩ সালের উপনির্বাচনে বগুড়া-৬ (সদর) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে এমপি নির্বাচিত হন। সর্বশেষ দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনেও তিনি নৌকা নিয়ে জয়লাভ করেন। মূলত এ পদটি তাঁকে শূন্য থেকে টেনে তোলে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা বলেন, বগুড়া আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়ে শুরু থেকে বিতর্কে জড়ান রিপু। তার বিরুদ্ধে পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্যেরও অভিযোগ ওঠে। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন উপজেলা সম্মেলনে দলীয় পদ বাণিজ্যের অভিযোগও তার পিছু ছাড়েনি। এ ছাড়া মহাস্থানহাটে অতিরিক্ত টোল আদায় করা নিয়ে বিরোধে তার লোকজন প্রকাশ্যে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার ঘটনাটিও জেলাজুড়ে বেশ আলোচিত। এ ছাড়া সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নকাজের সঙ্গে দলীয় নেতাকর্মীকে সুযোগ না দিয়ে তার নিজের লোকদের সুযোগ করে দিচ্ছেন। আর এ কাজে তিনি ইচ্ছামতো টাকা হাতাচ্ছেন।

রিপুর বিরুদ্ধে হাট বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ রয়েছে। তিনি সিন্ডিকেট করে বেশ কয়েকবার মহাস্থানহাটের ইজারাদার ছিলেন। এবার সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে দুই কোটি টাকা বেশি দিয়ে রিপু হাটটি ইজারা নিয়ে দিয়েছেন শ্যালক শফিকুল ইসলামকে। একই কায়দায় শিবগঞ্জের আরেকটি বড় হাট মোকামতলা ১ কোটি ৬০ লাখ টাকায় ইজারা নেন শফিকুল ইসলাম।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক নেতা বলেন, রিপুর কারণে ক্ষমতাসীন দলে এখন নানা বিভক্তি। তিনি দলীয় নেতাকর্মীকে মূল্যায়ন না করে নিজের লোক নিয়ে বলয় তৈরি করেছেন।