সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জবাবটি পাওয়া যেতে পারে ঢাকার রাজপথে: জন এফ ড্যানিলোয়িচ

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জবাবটি পাওয়া যেতে পারে ঢাকার রাজপথে: জন এফ ড্যানিলোয়িচ

দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কূটনীতিকদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর একটি হলো- সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে মনোনিবেশ করা। এমনকি সর্বোত্তম পরিকল্পিত কৌশল থাকা সত্ত্বেও, অনিবার্যভাবে ঘন ঘন বিক্ষেপের ঘটনা ঘটবে যা (সেগুলোর) বাস্তবায়ন পরিকল্পনাকে জটিল করে তোলে। প্রশস্ততা এবং সময়কাল ভেদে এই বিক্ষেপ পরিবর্তিত হতে পারে এবং কূটনীতিকদের স্বদেশে, বিশ্বের অন্য কোথাও বা তাদের যে দেশে নিয়োগ করা হয়েছে সে দেশে এমনটা ঘটতে পারে। এ বিষয়ে কূটনীতিকরা নিশ্চিত থাকতে পারেন যে, যারা তাদের প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ দেখতে চায়, তারা এই বিক্ষেপ থেকে সুবিধা নিতে চাইবে। এটা মেনে নিয়েই সেরা কূটনীতিকরা দ্রুত নতুন পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নেবেন এবং তাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের লক্ষ্য অর্জনের দিকে নিজ দেশের প্রচেষ্টায় পুনরায় মনোনিবেশ করবেন।

বাংলাদেশের পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনের তারিখ যতোই ঘনিয়ে আসছে, বৈশ্বিক পরিবেশে ততোই উল্লেখযোগ্য ব্যাঘাত ঘটেছে যা গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রচারে মনোযোগী আমেরিকান কূটনীতিকদের কাজকে জটিল করে তুলেছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ইউক্রেনে চলমান যুদ্ধ এবং মধ্যপ্রাচ্যে সাম্প্রতিক সহিংসতার প্রাদুর্ভাব। পরেরটি, বিশেষ করে, বাংলাদেশ ও এ অঞ্চলসহ সারা বিশ্বে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। ইতিমধ্যে, নিজ দেশের (যুক্তরাষ্ট্রের) ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতাও উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিরুদ্ধে বিচার চলছে। প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যেও অন্তর্দ্বন্দ্ব চলছে।

একই সময়ে, সমমনা দেশগুলোর সেইসব গোষ্ঠী যারা ঐতিহাসিকভাবে গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার সম্পর্কিত মার্কিন নীতি 'শেয়ার' করতো তারাও আগের চেয়ে আরও বেশি বিভক্ত এবং বিভ্রান্ত বলে মনে হচ্ছে।

ভারতের সাথে কানাডার চলমান দ্বন্দ্ব দক্ষিণ এশিয়ার প্রতি আরও আগ্রাসী নীতির কারণ হয়নি। অস্ট্রেলিয়া, জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়া প্রাথমিকভাবে পূর্ব এশিয়ায় চীনা আগ্রাসনের মোকাবিলায় মনোনিবেশ করেছে বলে মনে হচ্ছে৷ তারা বাংলাদেশ সরকারকে মানবাধিকার রেকর্ড নিয়ে চাপ দেয়নি। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ফ্রান্সের নেতৃত্বে) দৃশ্যত সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, মূল্যবোধের এজেন্ডা অনুসরণ করার চেয়ে বিমান বিক্রি করা এবং বাণিজ্য সম্পর্ক সম্প্রসারণ করাটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের মধ্যেকার বিশেষ সম্পর্কও বাংলাদেশে মানবাধিকার এবং গণতন্ত্রের জন্য চাপ সৃষ্টিকারী ঐক্যফ্রন্টে রূপান্তরিত হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না।

পরিবর্তিত বৈশ্বিক পরিবেশে এবং ঐতিহ্যগত অংশীদাররা অন্যান্য এজেন্ডা অনুসরণ করায় বাংলাদেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের কেন্দ্রে মানবাধিকার ও গণতন্ত্রকে রাখার প্রজ্ঞা নিয়ে প্রশ্ন তোলাটা স্বাভাবিক। এর পরিবর্তে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই এবং রোহিঙ্গা শরণার্থীদের চাহিদা মেটানোর মতো নীতিনির্ধারকদের কাছ থেকে সম্পদ এবং মনোযোগ আকর্ষণ করতে থাকা সম্পর্কের অন্যান্য উপাদানগুলোতে ফোকাস রাখাটা সহজ হবে। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে দেশ-বিদেশের গুরুত্বপূর্ণ অভিন্ন গোষ্ঠীগুলো ওয়াশিংটনের এমন পরিবর্তনকে স্বাগত জানাবে।

অতএব, বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং মানবাধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের একটি পদক্ষেপ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের কি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রচারে মনোনিবেশ করা উচিত? এই প্রশ্ন করলে আমার উত্তর হলো 'স্পষ্ট হ্যাঁ'। আমার আগের লেখা যারা পড়েছেন তাদের কাছে এটা স্পষ্ট হওয়া উচিত। এই মুহূর্তে, আমি কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করতে চাই যেগুলো নীতি নির্ধারকদের বিবেচনা করতে হবে যখন তারা সামনের দিনগুলোতে এগিয়ে যাচ্ছেনঃ

এটা কতোটা গুরুত্বপূর্ণ যে, বাংলাদেশ ২০১৪ কিংবা ২০১৮ সালের পুনরাবৃত্তি এড়াবে এবং দেশটির নাগরিকরা তাদের নেতা বেছে নেওয়ার প্রকৃত সুযোগ পাবে? বাংলাদেশে কী হবে যদি যুক্তরাষ্ট্র তার নীতি পরিবর্তন করে এবং স্বৈরাচারী শক্তি আরো বড় হয়? (বাংলাদেশে) গণতন্ত্রপন্থী শক্তির সমর্থন কেমন? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কি এতোটাই শক্তিশালী, যতোটা তিনি বিশ্বকে বোঝাতে চান? বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিগত অবস্থান থেকে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে এই অঞ্চল এবং বিশ্ব কী শিক্ষা নেবে? যুক্তরাষ্ট্র ইতিহাসের সঠিক পথে আছে কি নেই, তা কতোটা গুরুত্বপূর্ণ?

যেহেতু তারা এই প্রশ্নগুলো নিয়ে ভাবছেন, (তাই) সকল পর্যবেক্ষকেরও উচিত বিরোধী দল এবং সরকারের আসন্ন সমাবেশগুলোর প্রতি গভীর মনোযোগ দেওয়া। যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য বিদেশিরা যাই করতে চায় না কেন, শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ তার নিজ নাগরিকদের দ্বারাই নির্ধারিত হবে। সবশেষে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জবাবটি পাওয়া যেতে পারে ঢাকার রাজপথে।

[ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের সাবেক ডেপুটি চিফ অফ মিশন তথা উপ-রাষ্ট্রদূত এবং দেশটি থেকে প্রকাশিত মাসিক প্রকাশনা ‘সাউথ এশিয়া পারসপেক্টিভস’-এর এডিটর এ্যাট লার্জ জন এফ ড্যানিলোভিজের লেখাটি চলতি সংখ্যায়- ২৬ অক্টোবর প্রকাশিত হয়েছে। অনুবাদ করেছেন তারিক চয়ন]