সরকারকে বিএনপি নেতৃবৃন্দের হুঁশিয়ারি

খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিন নতুবা আপনাদেরও রক্ষা নেই

খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিন নতুবা আপনাদেরও রক্ষা নেই

কাল বিলম্ব না করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তি এবং দ্রুত আরেকটি জাতীয় নির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন বিএনপি নেতৃবৃন্দ।

শুধু নেতৃবৃন্দ নয় বরিশাল নগরের হেমায়েত উদ্দিন ঈদগাহ মাঠে জড়ো হওয়া লাখো জনতার কন্ঠে ছিলো একই দাবি। সমাবেশে যোগদান থেকে শুরু করে পুরোটাই সময় জুড়েই খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে পুরো জনসভা ছিলো উত্তাল। সবার মুখে মুখে ছিলো  “দেশ নেত্রীর মুক্তি চাই, দিতে হবে” স্লোগান।

সমাবেশ তিনটায় শুরুর কথা থাকলেও সকাল থেকেই মানুষের ভীড় উপচে পড়ে সমাবেশস্থলে। সমাবেশ রুপ নেয় জনসমুদ্রে। স্লোগানের পাশাপাশি সমাবেশে উপস্থিত শ্রোতা, কর্মী, সমর্থক আর জনতার দাবি ছিলো খালেদা জিয়ার দ্রুত মুক্তি তরাণ্বিত করতে যেন কঠোর কর্মসূচির ডাক দেয়া হয়। তারি প্রতিফলন দেখা গেছে বিভাগীয় এবং জেলা নেতৃবৃন্দের বক্তব্যেও।

ডিসেম্বরের একতরফা আর প্রশ্নবিদ্ধ জাতীয় নির্বাচনের পর দলীয় চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে বৃহস্পতিবার দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির প্রথম বড় কর্মসূচি ছিলো এটি। ঈদগাহ মাঠের এই জনসভায় বরিশাল জেলাসহ ঝালকাঠি, পিরোজপুর, পটুয়াখালী, বরগুনা ও ভোলার বিভিন্ন স্থান থেকে আসা নেতা-কর্মীরা খালেদার মুক্তির দাবিতে স্লোগানে মুখর ছিল পুরোটি সময়।

সরকারকে উদ্দেশ্য করে সমাবেশে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “ব্যর্থ নির্বাচন কমিশন বাদ দিয়ে, খালেদা জিয়াকে নিঃশর্ত মুক্তি দিয়ে, সব রাজনৈতিক দলকে ডেকে দ্রুত নির্বাচন দিন। নয়তো জনরোষে আপনাদের পথ কঠিন হবে, ইতিহাস আপনাদের ক্ষমা করবে না।”

সরকারকে হুঁশিয়ার করে তিনি বলেন, “কাল বিলম্ব না করে দেশনেত্রীকে মুক্তি দিন। তাকে যদি মুক্তি না দেন, আপনাদেরও রক্ষা হবে না।”

বিএনপির নেতা-কর্মীদের আন্দোলনের সক্রিয় থাকার আহ্বান জানিয়ে মির্জা আলমগীর বলেন, “আমাদের অধিকার আমাদেরই প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আমাদের অধিকার অন্য কেউ কি রক্ষা করে দেবে? আমাদের দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলন কি অন্য কেউ করবে? আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেশের ফিরিয়ে আনার আন্দোলন কি অন্য কেউ করবে?”

এই আন্দোলনে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করার দায়িত্ব নিতে দলের নেতা-কর্মীদের আহ্বান জানান বিএনপি মহাসচিব। মির্জা আলমগীর বলেন, “আজকে বরিশালের জনগণকে ধন্যবাদ জানাতে চাই, এত প্রতিকূলতার মধ্যে আপনারা এখানে এসেছেন।”

প্রয়াত এইচ এম এরশাদকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেওয়ার সমালোচনা করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, “আমরা এরশাদ সাহেবের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছি, একটা রাজনৈতিক দলের সভাপতির মৃত্যুতে আমরা শোক প্রকাশ করেছি।”

“কিন্তু এটা সত্য যে, এরশাদ সরকারের আমলেই এদেশের গণতন্ত্রকে ধ্বংস করা হয়েছে, এটা সত্য যে, তার সরকারের আমলেই আমাদের বহু মানুষ, ছাত্র-জনতা নিহত হয়েছে। আজকে আওয়ামী লীগ তাদের সঙ্গে আপস করে, তাদের সঙ্গে জোট করে গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে জনগণের প্রতিপক্ষ হিসেবে অবস্থান নিয়েছে।

“আজকে তাকে(এরশাদ) রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেওয়া হয়। আর যিনি গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করলেন, ১৯৭১ সালে পাক সেনাবাহিনীর হাতে বন্দি থাকলেন, তাকে আজকে কারাগারের অন্ধকারে অন্তরীণ করে রাখা হয়।”

সরকার জনগণের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে মন্তব্য করে মির্জা আলমগীর বলেন, “একটা বাজেট দিয়েছে ট্যাক্স, বিদ্যুতের দাম বাড়ানো, গ্যাসের দাম বাড়ানো। পেঁয়াজের দাম বাড়ছে, কাঁচা মরিচের দাম ২০০ টাকা, প্রত্যেকটি নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বাড়ছে।”

“খবরের কাগজ খুললে ধর্ষণ আর ধর্ষণ ছাড়া কোনো খবর নাই, শুধু হত্যা আর হত্যা। আদালতও হত্যা থেকে বাদ যাচ্ছে না। মেগা প্রজেক্টের নামে, মেগা উন্নয়নের নামে তারা নিজেদের পকেট বোঝাই করছে। মানুষের কোনো উন্নয়ন হচ্ছে না।”

তিনি বলেন, “দেশ এখন ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। ধর্ষণ, খুন, গুম এখন প্রতিদিনের ঘটনা। সরকার মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে ক্ষমতা দখল করে রেখেছে।”

খালেদা জিয়ার মুক্তির মধ্য দিয়ে পুনরায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে উল্লেখ করে বিএনপির মহাসচিব বলেন, “আজ দেশের আদালতেই প্রকাশ্যে মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে। এভাবে চলতে দেওয়া যায় না। এভাবে চলতে থাকলে দেশ অন্ধকারে তলিয়ে যাবে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নেই বলে খালেদা জিয়ার জন্য ন্যায়বিচার আমরা আশা করতে পারি না। তাই মানববন্ধন আর সমাবেশ করে কোনো লাভ হবে না। খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে আন্দোলন করতে হবে। আর এবার অন্য ধরনের আন্দোলনের সূচনা হলো এই বরিশাল থেকে।”

বিএনপি নেতা-কর্মীদের উপর সরকারের নির্যাতনের চিত্র তোলে ধরে মির্জা আলমগীর বলেন, “বিএনপির তৃণমূল থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় নেতা-কর্মীদের নামে মামলা দেওয়া হচ্ছে। এখন পর্যন্ত প্রায় এক লাখ মামলা রয়েছে নেতা-কর্মীদের নামে। অনেকে মামলার ভয়ে পালাতক। আসামি রয়েছেন ২৬ লাখ নেতা-কর্মী। আর গুম ও নিখোঁজ রয়েছে প্রায় ১ হাজার নেতা-কর্মী। এসব নেতা-কর্মীদের পরিবারের ছেলে, সন্তানেরা মানবেতর জীবন যাপন করছে। তারা পিতার ফিরে আসার দিন গুনছে। আদৌ আসবে কি না, তা-ও তাদের জানা নেই।”

বরিশাল মহানগর বিএনপির সভাপতি ও কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মজিবুর রহমান সরোয়ার জনসভায় বলেন, “আমরা দেশনেত্রীর মুক্তি চাই। তার আন্দোলনে বরিশালবাসী এক।”

“আমরা আজকে মহাসচিবের কাছে দাবি করছি, অতি অল্প সময়ের মধ্যে দেশনেত্রীর মুক্তি যদি না হয়, তাহলে কঠিন কর্মসূচি দিন। আমরা প্রস্তুত আছি।”

বরগুনার নেতা নজরুল ইসলাম মোল্লা বলেন, “শুধু মানববন্ধন করে দেশনেত্রীকে মুক্ত করা যাবে না। তার মুক্তি ছাড়া কোনো আন্দোলন হবে না।”

পিরোজপুরের নেতা আলমগীর হোসেন বলেন, “মাননীয় মহাসচিব আপনি কর্মসূচি দিন, আমরা কথা দিচ্ছি কর্মসূচি সফল করব।”

কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান ও ভোলার সাবেক সংসদ সদস্য হাফিজউদ্দিন আহমেদ বলেন, “এসব মিছিল-মিটিংয়ে, মানববন্ধনে দেশনেত্রীকে মুক্ত করা যাবে না। দেশনেত্রীকে মুক্ত করতে হলে আমাদেরকে ঢাকা শহরে একদিন যেতে হবে।

“ঢাকা শহরের রাজপথে বেশি না, এক লাখ লোক আমরা বসি, শান্তিপূর্ণভাবে রাজপথে থাকি, আমাদের পক্ষে লক্ষ লক্ষ মানুষ যোগ দেবে। আসুন, এজন্য আমরা সকলে ঐক্যবদ্ধ হই।”

দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান বলেন, “বরিশাল একটি সংগ্রামমুখর বিভাগ, যারা হারতে জানে না। আজকে এখান থেকে বলতে চাই, অবিলম্বে দেশনেত্রীকে মুক্তি দিন। তা নাহলে বরিশালবাসীর পক্ষ থেকে যে আন্দোলনের ঘোষণা আসবে, বর্তমান সরকার আর পালাবার পথ পাবে না।”

সমাবেশে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও খালেদা জিয়ার আইনজীবী জয়নাল আবেদীন বলেন, “বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ৩৭টি মামলা দেওয়া হয়েছে। এর সবগুলোকে মামলা হচ্ছে রাজনৈতিক মামলা। আমরা ৩৫টি মামলায় জামিন নিয়েছি। এখন দুটি মামলায় জামিন বাকি, আমরা আইনি লড়াই করছি।”

বরিশাল নগর বিএনপির সভাপতি মজিবর রহমান সরোয়ারের সভাপতিত্বে এবং ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক জিয়াউদ্দিন সিকদার জিয়া ও জেলা সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম শাহীনের পরিচালনায় সমাবেশে বক্তব্য রাখেন ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, আলতাফ হোসেন চৌধুরী, শাহজাহান ওমর, বিলকিস জাহান শিরিন, এবিএম মোশাররফ হোসেন, আকন কুদ্দুছুর রহমান, মাহবুবুল হক নান্নু, হাফিজ ইব্রাহিম, মেজবাহউদ্দিন ফরহাদ, আবুল হোসেন খান, গাজী কামরুল ইসলাম সজল, হাসান মামুন, হায়দার আলী লেলিন, আবু নাসের মুহাম্মদ রহমাতুল্লাহ, নুরুল ইসলাম নয়ন, মোস্তাফিজুর রহমান, এলিজা জামান।

বরিশালের এবাদুর হক চাঁন, ভোলার গোলাম নবী আলমগীর, ঝালকাঠির মোস্তফা কামাল মন্টু, পটুয়াখালীর অহিদ সারোয়ার কালাম, পিরোজপুরের আলমগীর হোসেন, বরগুনার নুরুল ইসলাম মোল্লা সমাবেশে বক্তব্য রাখেন।

বরিশালের সাবেক মেয়র আহসান হাবিব কামাল, সাবেক সংসদ সদস্য ইলেন ভুট্টো, ফিরোজ উজ জামান, বাহাউদ্দিন বাহার, মেহেদি হাসান তালুকদার, রুহুল আমিন দুলাল, শায়রুল কবির খান সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন।

জিএস/