‘লোভের কারণে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতকে সরকার অন্ধকার পথে নিয়ে গিয়েছে’

‘লোভের কারণে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতকে সরকার অন্ধকার পথে নিয়ে গিয়েছে’

শুধু লোভের কারণে সরকার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতকে অন্ধকারের পথে নিয়ে গিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

মঙ্গলবার বিকেলে গুলশানে দলীয় চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব এ মন্তব্য করেন।

উৎপাদন না করেও রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য সরকারকে অর্থ গুনতে হচ্ছে উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, 'সরকারের বিশেষ আইনে স্থাপিত রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের ১৯টি বিদ্যুৎকেন্দ্র ২-৩ বছর পর বন্ধ হওয়ার কথা থাকলেও, তা এখনো চলমান আছে। বেশ কিছু সংখ্যক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদন না করেও ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ বিপুল অর্থ নিয়ে যাচ্ছে। বিদ্যুৎ ছাড়াই ৩ বছর সরকারকে ৫৪ হাজার কোটি টাকা গচ্চা দিতে হচ্ছে।'

তিনি বলেন, 'সরকারের নিজস্ব ব্যবসায়ীদের পকেটে গেছে ৪২ হাজার কোটি টাকা। গত এক যুগে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ গচ্চা প্রায় ৮ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলার। বিদ্যুতের চাহিদা সঠিকভাবে নির্ধারণ না করেই চাহিদার অনেক বেশি পাওয়ার প্ল্যান্টের সঙ্গে চুক্তি করে দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ীদের লুট করার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে।'

'বিদ্যুৎ খাতে রাষ্ট্রীয় দেনা ২ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা' উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'বিদেশি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৯৭ হাজার ৬৭৭ কোটি টাকা। ২০২৪ সাল থেকে আগামী ৩০ বছরে সুদসহ এই ঋণ পরিশোধ করতে হবে যা জনগণের পকেট কেটে করা হবে,' যোগ করেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, 'সরকার লোডশেডিং শূন্যের কোটায় নিয়ে আসায় উৎসব করেছে আতশবাজি পুড়িয়ে। এখন শহরে ২-৩ ঘণ্টা আর গ্রামাঞ্চলে ৫-৬ ঘণ্টা লোডশেডিং জনজীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে।'

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, 'সরকারের নিজস্ব ব্যবসায়ীদের মুনাফার স্বার্থের জন্য পরিকল্পিতভাবে নিয়মনীতি বিসর্জন দিয়ে চাহিদার অতিরিক্ত বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন, কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্টের সুযোগ প্রদানের ভয়াবহ দুর্নীতির কারণে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ প্রচুর অর্থ ব্যয় করার ফলে বর্তমানে এই অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের ক্ষেত্রে ইনডেমনিটি আইন তৈরি করে নজিরবিহীন দুর্নীতি ও লুটপাট হয়েছে।'

'সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতির ওপর চরম বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত না করেই বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন সমস্যাকে জটিলতর করেছে। দেশে গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধির কোনো উদ্যোগ না নিয়ে বিদেশ থেকে গ্যাস আমদানির লক্ষ্যই হচ্ছে চুরি এবং নিজ দলের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে নিজেদের দুর্নীতি ও অনৈতিক সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলা। শুধু লোভের কারণে আজ বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতকে অন্ধকারের পথে নিয়ে গিয়েছে সরকার,' বলেন বিএনপি মহাসচিব।

বিদ্যুতের এই পরিস্থিতির জন্য ব্যর্থতার দায় নিয়ে সরকারকে পদত্যাগ করার আহ্বান জানান মির্জা ফখরুল।

এক প্রশ্নের জবাবে বিএনপি মহাসচিব বলেন, 'এই সরকারের নীতি একটাই, তা হচ্ছে জনগণের সম্পদ লুট করে নিজেদের সম্পদ বৃদ্ধি করা এবং বিদেশে সেই সম্পদ পাচার করা। এ ধরনের নীতি অনুসরণ করে দেশের সম্পদ লুট করার নজির অন্য দেশে আছে। অতি সম্প্রতি শ্রীলঙ্কায় এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। জনগণ রাস্তায় বেরিয়ে এসে তাদের উত্থানের মধ্য দিয়ে যারা দেশের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন, সেই প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীকে তারা সরিয়ে দিতে বাধ্য করেছে। একইভাবে নাইজেরিয়া ও ভেনিজুয়েলাতে একই অবস্থা আমরা দেখেছি।'

তিনি বলেন, 'সরকারের যখন উদ্দেশ্যই হয় জনগণের সম্পদ লুট করা, তখন সেই অর্থনীতি টেকসই হয় না। সে কারণে আয়-বৈষম্য বাড়তে থাকে। আজ আমাদের দেশে এক শ্রেণীর মানুষ অনেক বড়লোক হয়ে গেছে তাদের সম্পদ পাহাড়ের মতো হয়েছে, আরেক শ্রেণীর মানুষ দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হয়েছে, এই শ্রেণীর মানুষের সংখ্যা বেশি। ফলে অতি দ্রুত এই অর্থনীতি ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।'

লোডশেডিং ও জ্বালানি খাতে অব্যবস্থাপনার প্রতিবাদে সারা দেশে ৩ দিনের বিক্ষোভ কর্মসূচির ঘোষণা দেন তিনি।

বিএনপি মহাসচিব বলেন, 'লোডশেডিং ও জ্বালানি খাতে অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর জন্য ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণ ও অন্যান্য মহানগর আগামী ২৯ ও ৩০ জুলাই এবং সব জেলা পর্যায়ে আগামী ৩১ জুলাই প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ সমাবেশের সিদ্ধান্ত দলের স্থায়ী বৈঠকে গৃহীত হয়েছে।'

ঢাকায় ২৯ জুলাই মহানগর উত্তর এবং ৩০ জুলাই মহানগর দক্ষিণ বিক্ষোভ করবে বলে জানান তিনি।

'দলীয় সরকারের নির্দেশের বাইরে ইসির পক্ষে নির্বাচন করা সম্ভব নয়'

মঙ্গলবার সকালে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের দেওয়া বক্তব্যের বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব বলেন, 'এই নির্বাচন কমিশন নিয়ে আমি কথা বলতে চাই না। আমাদের বক্তব্য স্পষ্ট, বর্তমান সরকার যদি ক্ষমতায় থাকে এবং আমরা আগেই বলেছিলাম যে, দলীয় সরকারের অধীনে কখনোই অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না।'

তিনি বলেন, 'আওয়ামী লীগ যেটা করেছে গত ৩টা টার্মে এটাকে একটা নির্বাচনী গণতন্ত্র বলে তারা নাম দেওয়ার চেষ্টা করেছে এবং গণতন্ত্রের একটা মু্খোশ পরে রাখে, আরেক দিকে নির্বাচন মুখোশ দেখিয়ে ক্ষমতা ধরে রাখে। যেটা অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হাইব্রিড রেজিম বলেছেন। এই হাইব্রিড রেজিমের ফলে জনগণ ভোটাধিকার থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত হচ্ছে।'

'এর অর্থই হচ্ছে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন কমিশনের কোনো এখতিয়ারই নেই যে এখানে তারা সরকারের নির্দেশ ছাড়া নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে পারবে,' বলেন তিনি।

মঙ্গলবার সকালে নির্বাচন কমিশনে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সঙ্গে সংলাপে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, '২০১৮ সালের মতো নয়, আইন অনুযায়ী নির্বাচন হবে। সংসদ নির্বাচন হবে সময়মতো। বর্তমান কমিশন প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে এসেছে, ডিগবাজি নয়।'

এর আগে সোমবার দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সভাপতিত্বে স্থায়ী কমিটির সভা হয়। আজকের সংবাদ সম্মেলনে স্থায়ী কমিটির সভায় নেওয়া সিদ্ধান্তগুলো তুলে ধরেন বিএনপি মহাসচিব।

বিএসএফের ডিজির বক্তব্যের প্রতিবাদ

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, 'দলের স্থায়ী কমিটির সভায় সম্প্রতি ভারতীয় বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের মহাপরিচালক বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নিহত বাংলাদেশের সবাই অপরাধী-এই মন্তব্যে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি) মহাপরিচালক নীরব থাকায় তীব্র সমালোচনা করা হয়।'

'বিএনপি মনে করে সীমান্তে গুলি করে হত্যা মানবাধিকার লঙ্ঘন। কেউ অপরাধী হলেও তার বিচার পাওয়ার অধিকার আছে। এ বিষয়ে সরকারের স্পষ্ট বক্তব্য আমরা দাবি করছি,' বলেন তিনি।

সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ছাত্রীকে যৌন নিপীড়নের ঘটনার সঙ্গে ছাত্রলীগ অভিযুক্তের ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, 'ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের এই ধরনের ন্যাক্কারজনক, অসামাজিক কার্যকলাপকে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে মদদ দেওয়া হয় বলে এ ধরনের ঘটনাগুলো ঘটছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী ও অসামাজিক কার্যকলাপের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে।'

এসব ঘটনায় অপরাধীদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনার দাবি জানান তিনি।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সভায় দেশে দ্রব্য মূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং দেশে দারিদ্র্যের হার বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ এবং এবং মিয়ানমারের সামরিক জান্তা কর্তৃক ৪ গণতন্ত্র কর্মীকে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করায় নিন্দা জানানো হয়।