এই চায়নিজ রাইফেল এল কোত্থেকে, প্রশ্ন বিএনপির

শাওন হত্যার প্রতিবাদে বিএনপির বিক্ষোভ সমাবেশ জনসমুদ্রে পরিণত

শাওন হত্যার প্রতিবাদে বিএনপির বিক্ষোভ সমাবেশ জনসমুদ্রে পরিণত Photo credit: Babul Talukder

পুলিশের বর্বরোচিত গুলিতে যুবদল কর্মী শাওন প্রধান হত্যার প্রতিবাদে ঢাকায় বিক্ষোভ করেছে প্রধান বিরোধীদল বিএনপি। বিকালে বিক্ষোভ সমাবেশ শুরু করার কথা থাকলেও সকাল থেকেই মিছিল নিয়ে জড়ে হতে থাকেন দলটির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীরা। লাখো জনতার উপস্থিতিতে সমাবেশ ধীরে ধীরে রুপ নেয় জনসমুদ্রে।

বেলা সোয়া ৩টার দিকে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ শুরু হওয়ার সময় নয়াপল্টন এবং এর আশেপাশের এলাকার সড়কগুলোতে লাখো নেতাকর্মীর উপস্থিতি দেখা যায়। এসময় উপস্থিত নেতাকর্মীদের সরকারের পতনের দাবিতে নানা স্লোগান দিতে দেখা যায়।

সমাবেশে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘এই এসআই কনকের চায়নিজ রাইফেল রাখার কোনো এখতিয়ার ছিল না। তাহলে এই চায়নিজ রাইফেলটা এল কোত্থেকে। কোন আদেশ বলে সে গুলি করে হত্যা করল আমার ভাইকে।’

সরকারের উদ্দেশে তিনি প্রশ্ন তোলেন, ‘আমরা পরিষ্কার করে জানতে চাই, নারায়ণগঞ্জে বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে কী কারণে সরকারের পেটুয়া বাহিনী গুলি করেছে।’

বিএনপির মহাসচিব বলেন, দুই দিন ধরে নারায়ণগঞ্জের এসপি, আওয়ামী লীগের নেতারা বোঝানোর চেষ্টা করছেন এই ছেলেটা যুবদলের ছেলে নয়, ওয়েল্ডিং ফ্যাক্টরিতে কাজ করত। যদি তর্কের স্বার্থে ধরেও নিই যে সে যুবদলের কর্মী নয়, একটা ওয়ার্কশপের কর্মী। তাহলে এই সরকার, পুলিশকে সেই এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে একটা মানুষকে বিনা কারণে গুলি করে হত্যা করার?

এ সময় মির্জা ফখরুল ইসলাম নারায়ণগঞ্জে শাওন নিহত হওয়ার ঘটনায় একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত আজকের একটি প্রতিবেদন উঁচিয়ে দেখান। তিনি এসআই মাহফুজুর রহমানের ছবি দেখিয়ে বলেন, ‘এই সভা থেকে আমরা দাবি করছি, এই ছবির তদন্ত করা হোক এবং এই রাইফেল নিয়ে পয়েন্ট প্ল্যান গুলি করেছে, তার তদন্ত করে তাঁকে আইনের আওতায় এনে সাজা দিতে হবে।’

সংসদ ভেঙে দিয়ে নিরপেক্ষ সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যমে নির্বাচনের ব্যবস্থা না করলে সরকারের পরিণতি ভয়াবহ হবে বলে উচ্চারণ করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, নিরপেক্ষ নির্বাচন না দিয়ে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে গিয়ে বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর গুলি চালানোর ফল ভালো হবে না।

সরকারকে সতর্ক করে দিয়ে বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘যদি সাজা না দেন, আমরাও বসে থাকব না, বসে নেই। ভোলাতে মামলা করেছি, নারায়ণগঞ্জেও মামলা করব। যতবার আপনারা আইন ভঙ্গ করবেন, আমার ভাইদের ওপর অত্যাচার করবেন, ততবার মামলা হবে। ভাবছেন ক্ষমতায় আছেন, মামলা কী হবে। মামলায় হয়, মামলায় খুবই হয়।’

আইজিপি বেনজীর আহমেদের নাম উল্লেখ না করে মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘আজকে দেখুন, আপনাদের প্রধান আমেরিকায় গেছেন, তাকে শর্ত মেনে যেতে হয়েছে। তাকে বলা হয়েছে যে সুনির্দিষ্ট এলাকা, জাতিসংঘের ক্যাম্পাসের বাইরে তুমি যেতে পারবে না। এটা লজ্জা আমাদের জন্য। একটা স্বাধীন–সার্বভৌম দেশের জন্য কত বড় লজ্জার কথা যে আজকে পুলিশপ্রধানকে শর্তসাপেক্ষে ভিসা নিয়ে বিদেশে যেতে হচ্ছে। কেউ রক্ষা করতে পারে না। আজকে যারাই অত্যাচার করেছে, নির্যাতন করেছে, মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে, তাদের কেউই রক্ষা পায়নি।’

জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের হাইকমিশনারের ঢাকা সফর নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করার অভিযোগ করেন মির্জা ফখরুল ইসলাম। তিনি বলেন, তিনি এখানকার ভিকটিম, সাংবাদিক, সুশীল সমাজ, সর্বশেষ চারজন মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে যাওয়ার আগে প্রেস কনফারেন্স করলেন। তিনি খুব স্পষ্ট করে বললেন, বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে, গুম হচ্ছে, বিচারবহির্ভূত হত্যা হচ্ছে, পুলিশ কাস্টডিতে হত্যা করা হচ্ছে। বলেছেন, এই মানবাধিকার লঙ্ঘনের যদি সুষ্ঠু তদন্ত করা না যায়, তাহলে এদের একদিন না একদিন জবাব দিতে হবে।

মির্জা ফখরুল বলেন, ‘এরপরে তিনি আরেকটা ইঙ্গিত দিয়েছেন, যে ইঙ্গিতটা আমাদের দেশের জন্য, জাতির জন্য অত্যন্ত সতর্কতামূলক ইঙ্গিত। সেই ইঙ্গিতে কী বলেছেন? বাংলাদেশের সেনাবাহিনী বিশ্বের শান্তিরক্ষার স্বার্থে শান্তি মিশনে কাজ করে। এই মিশনে যাঁরা কাজ করেন, সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা—তাঁদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের কোনো ঘটনা আছে কি না, সেটি জাতিসংঘ দেখতে চায়। এই কথা অত্যন্ত বড় সতর্কবাণী। তিনি আওয়ামী লীগ সরকারকে দেশের বিচার, প্রশাসন, সংসদ, অর্থনীতি ধ্বংস করা এবং গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করে রাখার জন্য অভিযুক্ত করেন।’

মির্জা ফখরুল বলেন, ‘গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকার সব গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে দিয়েছে। পার্লামেন্ট, বিচারব্যবস্থা, প্রশাসন, অর্থনীতি ও গণমাধ্যমকে ধ্বংস করে দিয়েছে। তাদের একটাই লক্ষ্য, ক্ষমতায় টিকে থাকা। স্পষ্ট করে বলতে চাই, এ আওয়ামী লীগ পরিকল্পিতভাবে দেশের নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছে।’

তিনি বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে চারটি নির্বাচন হয়েছে সম্পূর্ণভাবে গ্রহণযোগ্য। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা তুলে নিয়ে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করেছে। সেদিনই খালেদা জিয়া বলেছিলেন, আজ থেকে বাংলাদেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি হলো। এখানে আর সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না।’

বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘এখন আওয়ামী লীগ আবার নতুন করে সম্পূর্ণ পাতানো নির্বাচন করে ক্ষমতায় যাওয়ার পাঁয়তারা করছে। বিরোধী দল যাতে কাজ করতে না পারে, তাদের সংবিধানসম্মত যে অধিকার, সেটা যেন আদায় করতে না পারে, মানুষ যেন তাদের ন্যায্য অধিকার পাওনা থেকে বঞ্চিত হয়, সেই কারণে আবারও তারা বিরোধী দলের ওপর চড়াও হতে শুরু করেছে। ভাঙচুর করছে, গুলি করছে, হত্যা করছে।’

তিনি বলেন, ‘আমরা দ্রব্যমূল্য ও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করছিলাম। এ পর্যন্ত তারা তিনজনকে হত্যা করেছে, মামলার সংখ্যা ২০ হাজার ছাড়িয়েছে। সেই আগের কায়দায় গায়েবি মামলা। হামলা-মামলা করে তারা আবার একই কায়দায় বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের মাঠ থেকে সরিয়ে দিতে চায়। মাঠে তারা একাই নির্বাচন করতে চায়।’

মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আমরা কোনোভাবেই এ দানবীয় সরকারকে একতরফা নির্বাচন করতে দেব না। হামলা- মামলা ও অত্যাচার করে মানুষকে হত্যা করার সুযোগ দেব না, লুটপাট করার সুযোগ দেব না। পত্রিকায় এসেছে, এক বছরে পাচার হয় ৮৫ হাজার কোটি টাকা। সেজন্য তাদের বিচার হবে এবং জনগণের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে।’

সমাবেশে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, জনগণের মালিকানা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে বিএনপি। এই চেষ্টায় তিনি দেশের সব গণতন্ত্রকামী মানুষকে রাজপথে নেমে আসার আহ্বান জানান।

স্থায়ী কমিটির অন্য সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, কোনোভাবে আর বর্তমান সরকারকে ছাড় দেওয়া হবে না। তাদের আর বিনা ভোটে ক্ষমতায় আসতে দেওয়া হবে না।

ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক আবদুস সালামের সভাপতিত্বে সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক আমানউল্লাহ আমান, আবুল খায়ের ভূঁইয়া, জয়নুল আবদিন, দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, যুবদলের সুলতান সালাহউদ্দিন, মহানগর উত্তর বিএনপির সদস্যসচিব আমিনুল হক, দক্ষিণের সদস্যসচিব রফিকুল আলম প্রমুখ।