মামলার বিচার তদন্তে হঠাৎ গতি, বিএনপিতে উদ্বেগ

মামলার বিচার তদন্তে হঠাৎ গতি, বিএনপিতে উদ্বেগ

আনোয়ার হোসেন। সরকারি তিতুমীর কলেজ ছাত্র সংসদের জিএস ছিলেন। ছাত্রদলের রাজনীতি করেন। ২০১৫ সালে গুলশানে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার আসামি। এ মামলায় বিএনপি’র আরও ১৪ নেতাকর্মীর নাম রয়েছে। ২০১৬ সালে ওই মামলায় আদালতে প্রতিবেদন জমা দেয় পুলিশ। পরের দুই বছর মামলার বিচার প্রক্রিয়া আর এগোয়নি। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে মামলাটি সচল করে রাষ্ট্রপক্ষ। তখন আসামিদের গ্রেপ্তারও করা হয়। ৪ মাস জেল খেটে সবাই জামিনে মুক্তি পান।

নির্বাচনের পর ২ বছর আবার স্থবির থাকে মামলার কার্যক্রম। নিয়মিত প্রক্রিয়া হিসেবে ২০২১ সালে বিচারকাজ শুরু করতে চার্জ গঠন করেন আদালত। তবে ৩ বছরে একজন সাক্ষীকেও আদালতে হাজির করতে পারেনি রাষ্ট্রপক্ষ। চলতি বছরের মে মাস থেকে এই মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ প্রক্রিয়া আবার শুরু হয়। অনেকটা বিদ্যুৎগতিতে চলছে সাক্ষ্যগ্রহণ। আইনজীবীরা জানান, এভাবে চলতে থাকলে অল্প সময়ের মধ্যেই মামলার রায় দেয়া সম্ভব। শুধু আনোয়ার হোসেনের মামলাই নয়, গত ৩ মাসে বিএনপি শীর্ষ নেতা ও মাঠপর্যায়ের কর্মীদের বিরুদ্ধে হওয়া দুর্নীতি, জ্বালাও পোড়াও, সন্ত্রাসবিরোধী ও নাশকতার মামলাগুলোর বিচারে গতি ফিরেছে। কোনো কোনো মামলা দিনে ৭ থেকে ৮ জনের সাক্ষ্য নেয়া হচ্ছে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত একটানা সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে। কোনো কোনো সময় রাতেও সাক্ষ্য নেয়ার ঘটনা ঘটছে। এসব মামলায় হঠাৎ গতি আসায় বিএনপিতেও এক ধরনের উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।

সংশ্লিষ্ট আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রচলিত প্রথা ও রীতি ভঙ্গ করে সাক্ষ্য নেয়া হচ্ছে। সাধারণত ফৌজদারি মামলায় তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষ্য নেয়া হয় সবার শেষে। অথচ ঢাকার সিএমএম কোর্টে বিচারের প্রচলিত প্রথা ও রীতি ভঙ্গ করে সবার আগে তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তার সাক্ষী নেয়া হচ্ছে। বাকি সাক্ষীদের খুঁজে পাওয়া যায়নি বলে উল্লেখ করা হচ্ছে। প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী একদিন শুনানির পর দুই থেকে ৩ সপ্তাহ পর পরবর্তী শুনানি গ্রহণের জন্য তারিখ নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু চিহ্নিত মামলাগুলো কখনো পরের দিনই অথবা ১ থেকে ২ দিন সময় দিয়ে তারিখ নির্ধারণ করা হচ্ছে। এ ছাড়া একদিনে টানা ৮ জনের সাক্ষ্য নেয়ার ঘটনাও ঘটছে।

ঢাকা কোর্টের একজন আইনজীবী জানান, ঢাকার সিএমএম কোর্টে গত ১৯শে জুলাই একটি মামলায় ৮ জনের সাক্ষ্য নেয়া হয়েছে। বেলা দুইটা থেকে একটানা সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত আদালত এই সাক্ষীর জেরা এবং জবানবন্দি গ্রহণ করেন। এ ছাড়া অস্বাভাবিক গতিতে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদলের সভাপতি রফিকুল ইসলাম মজনুর মামলার সাক্ষ্য নেয়া হচ্ছে। তিনি আটকের পর দীর্ঘদিন ধরে কারাগারে রয়েছেন। তার একটি মামালায় জামিন ছিল। ওই জামিন বাতিল করেন সিএমএম কোর্টের চার নাম্বার আদালতের বিচারক তোফাজ্জল হোসেন। জামিন বাতিলের পর একদিনে ৭ জনের সাক্ষ্য নেয়া হয়েছে।

জানা গেছে, বিএনপি শীর্ষ নেতাদের দুর্নীতির মামলাগুলো শুনানির তালিকায় আনা হচ্ছে গত মার্চ মাস থেকে। শুধু উচ্চ আদালতে দুর্নীতির মামলার বিচার নয়, নিম্নআদালতে ৩৭টি মামলা দ্রুত বিচারের কাজ শুরু হয়েছে। এরমধ্যে ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, মির্জা আব্বাস, আব্দুল্লাহ আল নোমান, মোসাদ্দেক হোসেন ফালু, আসলাম চৌধুরী, আলতাফ হোসেন চৌধুরী, লুৎফুজ্জামান বাবর, হাফিজ ইব্রাহিম, মিয়া নুুরুদ্দিন অপু, রেদোয়ান আহমেদের মামলা রয়েছে। এ ছাড়া নাশকতার অভিযোগে আমানউল্লাহ আমান, বরকত উল্যা বুলু, রুহুল কবির রিজভী, হাবিব উন নবী খান সোহেল, আজিজুল বারী হেলাল, সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, খায়রুল কবির খোকনসহ ৫১ জনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে। ২০১৪ থেকে ১৫ সালের ৩৭টি মামলার বিচার চলছে নিম্নআদালতে। এই সময়ে পেছনের মোট ৭৯টি মামলা সচল করা হয়েছে। মামলার আসামি যুবদল, ছাত্রদল, স্বেচ্ছাসেবক দলের বর্তমান ও সাবেক নেতাকর্মীরা। এ ছাড়া ঢাকার বিভিন্ন থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতারাও রয়েছেন।

বিএনপি নেতাদের মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবী এডভোকেট খাইরুল হক বলেন, গত ৬ বছরে মামলা সচল করা নিয়ে কোনো তোড়জোড় ছিল না। তবে গত জুন মাস থেকে বিচার প্রক্রিয়া চালু করা হয়েছে। মামলাগুলো দ্রুত শেষ করতে ফোন করে ডেকে সাক্ষীদের হাজির করা হচ্ছে। কোনো কোনো সময় সমন ছাড়াই সাক্ষী আনা হচ্ছে। আবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে। এটা নজিরবিহীন। এমন ঘটনা আগে কখনো চোখে পড়েনি। পুরনো, অচল ও স্থগিত মামলা সচল করে দ্রুতগতিতে এগিয়ে নেয়া হচ্ছে। এরমধ্যে ৫ শতাধিক নেতার মামলা শেষ পর্যায়ে পৌঁছেছে এবং ৩ শতাধিক মামলা রায়ের অপেক্ষায় রয়েছে। বিচার দ্রুত শেষ করার জন্য দুই দিনে এক মামলায় ১৪ জনের সাক্ষ্যও নেয়া হয়েছে। যারা সাক্ষী দিতে চান না তাদের জোর করে আদালতে আনা হচ্ছে। এই নিয়ে আদালত এলাকায় অওয়ামী লীগ ও বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের মধ্যে দুই দফা হাতাহাতি হয়েছে।

বিএনপি’র আইন বিষয়ক সহ-সম্পাদক এডভোকেট জয়নাল আবেদিন মেসবাহ বলেন, নির্বাচনে বিএনপিকে চেপে ধরতে রাজনৈতিক মামলাগুলো সচল করা হয়েছে। সকাল-সন্ধ্যা সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে। এমন ঘটনা আদালতে অতীতে ঘটেনি।

ঢাকা মহানগর আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী এডভোকেট মো. আব্দুল্লাহ আবু বলেন, তারা অভিযোগ করবেই। মামলা স্বাভাবিক নিয়মেই চলছে। যে ৩৭টি মামলার কথা বলা হচ্ছে এগুলো ফৌজদারি মামলা। আসামিদের বিরুদ্ধে আগুন ও ভাঙচুরসহ সুনির্দিষ্ট অভিযোগে চার্জশিট হওয়ার পর বিচার চলছে। আর সাক্ষী যদি আসে তাহলে আমাদের কি করার আছে। তাদের সাক্ষ্য না নিয়ে ফেরত পাঠিয়ে দেবো? রাতে কখনো সাক্ষ্য নেয়া হয়নি বলে তিনি উল্লেখ করেন।

গত ৭ই আগস্ট গাড়ি ভাঙচুর, পুলিশের কাজে বাধা দেয়া ও টাকা ছিনতাইয়ের মামলায় ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ইসহাক আলী সরকার সহ ২১ বিএনপি নেতাকর্মীর প্রত্যেককে দুই বছর করে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া গেল মাসে বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও তার স্ত্রী জোবাইদা রহমানকে ১২ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত।

বিএনপি’র ঢাকা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এডভোকেট আব্দুস সালাম আজাদ বলেন, সরকার আবারো অবৈধ উপায়ে ক্ষমতায় আসার জন্য বিএনপি’র শীর্ষ নেতাদের মামলা দ্রুত শেষ করতে চাচ্ছে। যাতে বিএনপি’র শীর্ষ নেতারা নির্বাচনে অংশ নিতে না পারে। তার জন্য রাষ্ট্রকে ব্যবহার করে মিথ্যা সাক্ষ্য নিয়ে মামলার তদন্তে গতি বাড়াচ্ছে। বিএনপি’র চলমান আন্দোলনকে নেতৃত্বশূন্য করতে সরকার মিথ্যে, বানোয়াট, কাল্পনিক অভিযোগে মামলা ও রায় দিয়ে মিথ্যাচার করছে।

বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব এডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, সারা বিশ্বের রাজনৈতিক বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, যারা ফ্যাসিস্ট তারা নিজেদের ক্ষমতাকে প্রলম্বিত করার জন্য অক্টোপাশের মতো সমস্ত রাষ্ট্রীয় শক্তিকে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে। আওয়ামী লীগও বিগত ১৪/১৫ বছর ধরে তেমনি আচরণ করছে। আবারো ক্ষমতায় আসার জন্য, বিরোধী দলকে দমন করার জন্য রাষ্ট্রকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। মামলা তদন্তে তড়িঘড়ি করছে। বিচার বিভাগ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এখন সেটাকেও বিএনপি’র বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে। সরকারের উদ্দেশ্য বিএনপি নেতারা যাতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে না পারেন।-মানবজমিন