রাজনৈতিক কর্মসূচিতে সরকারের নিষেধাজ্ঞা

রাজনৈতিক কর্মসূচিতে সরকারের নিষেধাজ্ঞা

একতরফা আরকেটি জাতীয় নির্বাচন করতে নির্বাচন কমিশনের ঘাড়ে বন্দুক রেখে এবার রাজনৈতিক কর্মসূচিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে সরকার। গণতন্ত্রের পরিবর্তে নিজেরা একদলের শাসন কায়েম করে 'ভোটে বাধা' দেবার হাস্যকর কারণ দেখিয়ে বৃহস্পতিবার সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়। একতরফা নির্বাচন নিয়ে বিরোধীদলগুলো যেনো কোনো প্রতিবাদ জানাতে না পারে  সেজন্য তাদের কন্ঠরোধ করতেই এরকম নজিরবিহীন একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন কর্তৃত্ববাদী সরকার।

রাজনৈতিক কর্মসূচিতে ১৮ই ডিসেম্বর থেকে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত এ বিধিনিষেধ জারি থাকবে বলে এক প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার জারি করা সরকারের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, “১৮ ডিসেম্বর হতে ভোটগ্রহণ সমাপ্ত হওয়ার পূর্ববর্তী সময় পর্যন্ত নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা ব্যতীত নির্বাচনী কাজে বাধা হতে পারে বা ভোটারগণ ভোট প্রদানে নিরুৎসাহিত হতে পারে- এরূপ কোনো প্রকার সভা, সমাবেশ বা অন্য কোনো প্রকার রাজনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা থেকে সকলকে বিরত রাখার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।”

এ ধরনের ব্যবস্থা নিতে গত মঙ্গলবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছিল নির্বাচন কমিশন। তার একদিন বাদেই সেই ব্যবস্থা নেয়া হলো।

নির্বাচন কমিশনের ঘোষিত একতরফা এবং ফরমায়েশি তফসিল অনুযায়ী, আগামী ১৭ই ডিসেম্বর প্রার্থিতা প্রত্যাহারের সময় শেষ হবে। পরদিন প্রতীক বরাদ্দের পর থেকে ৫ই জানুয়ারি পর্যন্ত মোট ১৯ দিন ভোটের প্রচার চালানোর সুযোগ পাবেন প্রার্থীরা।

ভোট বর্জন করে একদফার আন্দোলনে থাকা বিএনপি ও সমমনা দলের হরতাল-অবরোধের মধ্যে এ নির্বাচন হতে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে ভোটের প্রচার শুরুর আগে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে নিষেধাজ্ঞা এলো।

বর্তমানে ইসিতে নিবন্ধিত দল রয়েছে ৪৪টি। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টিসহ ২৮টি দল ভোটে অংশ নিচ্ছে।
গত ১২ই ডিসেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এ সংক্রান্ত একটি নির্দেশনা পাঠিয়েছিল নির্বাচন কমিশন। 

সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও এসআইপিজি’র সিনিয়র রিসার্চ ফেলো (এনএসইউ) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, “এর আগে কোনো নির্বাচনের আগে এমন পরিস্থিতি আমি দেখিনি। এমনকি ২০১৪ সালের দিকে যখন দেশের সার্বিক পরিস্থিতি এর চেয়েও নাজুক ছিল তখনো এমন অবস্থা দেখা যায়নি। এর আগে কোনো কমিশন কোনো সরকারকে এই ধরনের অনুরোধ করেছে কিনা, তা আমরা জানি না। নির্বাচনের সময়ে যারা থাকেন, তারা কেবল রুটিন কাজ করবেন। এটাই বলা আছে। রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ করতে দেয়া হবে কি হবে না, কাকে আটক করবে, কাকে বাধা দেবে, কাকে মুক্ত করবে এটা তাদেরই করার কথা। কিন্তু কমিশন নিজে থেকে কেন এটা করতে গেল তা আমার বোধগম্য নয়। এখন সরকার বলার সুযোগ পাবে যে, নির্বাচন কমিশন আমাদের বলেছে, তাই আমরা করেছি। এখন সভা-সমাবেশের যে অধিকার সেটি কীভাবে নিশ্চিত করা হবে? শহরাঞ্চলে বা উপজেলা পর্যায়ে যদি আমরা দেখি তাহলে এই অধিকারটি কীভাবে নিশ্চিত করা হবে? কমিশন এই দায় কেন নিলো! অতীতে এমন ঘটনা তো ঘটেনি। কমিশন নিজেই সরকারকে একটি সুযোগ দিলো। সরকার সেটি লুফে নিয়েছে।”

আগামী নির্বাচন সামনে রেখে যেখানে বিএনপিসহ আরও বেশকিছু রাজনৈতিক দল নির্বাচন বর্জনের কথা বলছে এবং নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে মাঠে রয়েছে, এমন সময়ে সভা-সমাবেশ বন্ধের সিদ্ধান্ত কীভাবে মূল্যায়ন করবেন জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, “নির্বাচন কমিশনের এই সিদ্ধান্ত থেকে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় যে, এটি একটি বিশেষ দলকে যারা ক্ষমতায় রয়েছে তাদের সুবিধা দিতেই দেয়া হয়েছে। নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে, অনেক রাজনৈতিক দল তার বিরোধিতা করছে। তারা দাবি আদায়ে রাস্তায় রয়েছে, সভা-সমাবেশ করছে। এখন এই সভা-সমাবেশের অধিকার তো সাংবিধানিক। সংবিধান নাগরিককে এই অধিকার দিয়েছে। এখন এভাবে সভা-সমাবেশের অধিকার বন্ধ রাখার ঘোষণা দেয়া সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।” 

বিশেষ অবস্থা ছাড়া রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ এইভাবে ঘোষণা দিয়ে বন্ধ করা যায় কিনা জানতে চাইলে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, “বাংলাদেশে যে কতো আইন আছে তা দেশের সাধারণ মানুষের জানার কথা নয়। আইনজীবীরা হয়তো ৩৬ হাজার আইন কিংবা ৫০ হাজার বিধি থেকে একটি রেফারেন্স খুঁজে বের করতে পারবেন। কিন্তু কথা হলো, এটা কোনো আইন নয়, বিধান। অতীতে যদি এমনটা না ঘটে থাকে তাহলে এটাকে ‘বিশেষ ব্যবস্থা’ বলা যায়।”