‘শুধু শিল্পের জন্য শিল্পকে বেছে নিতে চাইনি’

‘শুধু শিল্পের জন্য শিল্পকে বেছে নিতে চাইনি’

ক্ষমতাসীন সরকারের শাসন ব্যবস্থার সমালোচনা করায় কারাগারে নির্যাতন আর হুমকির ভেতর দিয়ে দিন কাটাতে হয়েছে খ্যাতিমান আলোকচিত্রী শহীদুল আলমকে। কষ্টের ভিতরেও পরাজয় না মেনে জীবনসংগ্রামে বেঁচে থাকার যে লড়াই-সে থিমকে কেন্দ্র করে তাঁর তোলা ছবি প্রিক্স পিকটেট-২০১৯ প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে।

ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসে প্রকাশিত শহীদুল আলমের সাক্ষাতকারটি নিয়েছেন রাসেল স্পেনস।      

জাস্ট নিউজ পাঠকদের জন্য এর ভাবানুবাদ তোলে ধরা হলোঃ

“স্টিল সি স্মাইলস” অর্থাৎ “এখনো তার মুখে হাসি!” শিরোনামে শহীদুল আলমের তিনটি ছবি প্রিক্স পিকটেট-২০১৯ প্রতিযোগিতার জন্য মনোনীত হয়েছে। “দি অরপানেজ” শিরােনামের ২০১৪ সালে তোলা ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে হাজেরা বেগম নামের একজন প্রাক্তন যৌনকর্মী ২০০৮ সালে ঢাকায় নিজের সঞ্চয়ের টাকা দিয়ে একটি এতিমখানা তৈরি করেছেন।

“দি কিস” শিরোনামে ২০১৪ সালে তোলা আরেকটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে জন্মের কিছুক্ষণ পরই ফেলে যাওয়া রাহাত নামের একটি শিশুকে নিজের আশ্রয়কেন্দ্রে জায়গা করে দিয়েছেন হাজেরা।

“হাজেরা এট ক্রিসেন্ট লেক” শিরোনামে ১৯৯৬ সালে তোলা ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে হাজেরা বেগম ক্রিসেন্ট লেকের একপাশে বসে আছেন আর সহ যৌনকর্মীদের সঙ্গে কৌতুকে মেতে উঠেছেন। সংসদের পাশের এই লেকটিতে একজন আরেকজনের মধ্যে এইডস প্রতিরোধী কনডম বিতরণ করছেন।

লেকের ধারে যে মহিলাগুলো আড্ডা দিচ্ছিলো তাদের দেখে যেকেউ ভাববে দীর্ঘদিনের পুরনো বন্ধু। একজন দিকে আরেকজন তাকিয়ে থেকে যেভাবে প্রাণ খুলে হাসছিলো তা ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর কিছুই না। কিন্তু এই যে হাসি তার আড়ালের যে গল্পটা, সেটা কিন্তু খুবি সাদামাটা ধরনের।

ঢাকায় সংসদ ভবনের বাইরের এ জায়টাতে যারা আড্ডায় মেতেছে তারা আসলে যৌনকর্মী। এইডস থেকে সুরক্ষার জন্য এক সতীর্থ আরেক সতীর্থের কাছে কনডম বিলি করছে।এতক্ষণ যা নিয়ে কথা হচ্ছিলো সেটা ছিলো একটা ছবির ভেতরের গল্প। ছবিটি ১৯৯৬ সালে শহীদুল আলমের হাতে তোলা। শিরোনাম ছিলো- “স্টিল সি স্মাইলস!”

২০১৯ সালের প্রিক্স পিকটেট প্রতিযোগিতায় আরো ১০ শিল্পীর সঙ্গে ঠাঁই পেয়েছে শহীদুলের এই সিরিজ ছবিগুলো।এ বছরের প্রতিযোগিতার প্রতিপাদ্য হচ্ছে- আশা।

“স্টিল সি স্মাইলস” আলোকচিত্রে এ প্রতিপাদ্যটি লুকিয়ে আছে। যার কেন্দ্রবিন্দু হাজেরা বেগম। ছবিতে তাকে দেখা যাচ্ছে সংসদের বাইরে লেকের দেয়াল ঠেসে বসা।

অন্য আরেক ছবিতে আমরা দেখতে পাই একই হাজেরাকে। যিনি শিশুদের গোসল করাচ্ছেন, আদর দিয়ে চুমু খাচ্ছেন, মাথা থেকে উঁকুন সরিয়ে দিচ্ছেন খুব যতনে। তার চোখে-মুখে এখন আনন্দের খেলা কারণ ধর্ষণ, বিক্রি এবং নির্যাতনের জীবন থেকে সে মুক্ত।

এবার হাজেরার বর্তমানে ফিরে আসি। ২০০৮ সালে নিজের সঞ্চয়ের টাকা খরচ করে একটি এতিমখানা বানিয়েছেন তিনি।এখান থেকে বেড়ে উঠা অনেকেই স্নাতকের পড়া চুকিয়ে উঠেছেন আবার অন্যরা পড়া চালিয়ে যাচ্ছেন স্কুলে।

প্রিক্স পিকটেট প্রতিযোগিতার জন্য কেন হাজেরার কর্মকে বেছে নিলেন?-এমন প্রশ্নের জবাবে শহীদুল আলম বলেন, “আমরা অনেকের সঙ্গেই সহযোগিতা করার ভান করে যাই। যৌনকর্মীদেরকে আমরা এরকম টার্গেট ভাবি এবং তাদের সঙ্গে এ আচরণটা করি। যৌনকর্মী হবার পরও সবকিছুর আড়ালে হাজেরার ক্ষেত্রে যেটা প্রমাণ হয়েছে সেটা আসলেই অবিশ্বাস্য এবং চমৎকার এক নারীর গল্প। যৌনকর্মী হিসেবে যে ক্ষত তার তৈরি হয়েছিলো তিনি সেসব থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছেন। যে জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন, যা তাকে সহ্য করতে হয়েছে-সব কিছুকে তিনি তুচ্ছ করেছেন। এটুকু করেছেন মানুষের কাছে আশাকে ছড়িয়ে দেবার স্বপ্ন নিয়ে।”

একই কথাগুলো আমরা শহীদুল আলমের বেলায়ও বলতে পারি। সাদাসিধে, সাদা পায়জামা আর উজ্জ্বল ধূসর রঙ্গের পাঞ্জাবী গায়ে লাগানো ৬৪ বছরের ব্যক্তিত্বসম্পন্ন সুঠাম দেহের অধিকারী একজন মানুষ। এখন সময় কাটাচ্ছেন পশ্চিম লন্ডনে বোন নাজমা করীমের বাসায়। কোলে বসে আছে ছয় বছরের নাতি লায়লা। চোখ তার আইপেডে, নানা শিখিয়ে দিচ্ছে চিত্রকলার টুকিটাকি।

একবছর আগে শহীদুল আলমের দৃশ্যপটটা কিন্তু এইরকম ছিলোনা। সে সময়টাতে তিনি ছিলেন কারাপ্রকোষ্ঠে আটক আর লন্ডনে তাঁর মুক্তির স্বপক্ষে জোর প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছিলেন তাঁর বোন। ২০১৮ সালে গ্রীষ্মে ঢাকার রাজপথে কিশোর আন্দোলন চলাকালে আওয়ামী লীগ সরকারের শাসন নীতির সমালোচনা করার কারণেই জেলে আটক করা হয়েছিলো শহীদুলকে। ঢাকার ট্রাফিকের বাজে ব্যবস্থাপনা আর সড়ক দুর্ঘটনায় দুই স্কুল শিক্ষার্থীর মৃত্যুর কারণে এই কিশোর আন্দোলন তুঙ্গে উঠলেও পেছেনর মূল কারণটা ছিলো আরো গভীরের। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দূর্নীতি, পুলিশি নির্যাতন, সহিংসতা আর বৈষম্যের কারণেই বিক্ষোভের স্ফূরণ ঘটেছিলো।

আগস্টের ৫ তারিখে বিক্ষোভটি ফেসবুক লাইভে সম্প্রচার করেন শহীদুল। এরপর আল-জাজিরাকে দেয়া এক সাক্ষাতকারের শেখ হাসিনা এবং তার সরকারের বিরুদ্ধে উপরোক্ত অভিযোগগুলো নিয়ে কথা বলেন তিনি। ঐদিন রাতেই বাসা থেকে শহীদুলকে আটক করা হয়, জেলে পুরে দেয়া এবং নির্যাতন করা হয়। লক্ষ্য একটাই হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে যেনো আর একটা শব্দও উচ্চারণ না করতে পারেন। তার এই গ্রেফতারের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠে বিশ্বজনমত। আর তাতে যোগ দেন নোবেল বিজয়ী, শিল্পী, লেখক, চলচ্চিত্র তারকাসহ সাধারণ জনতা। তারা সবাই নিবেদিত প্রাণ এই সমাজকর্মীর স্বপক্ষে আওয়াজ তোলেন।

শহীদুল আলমকে ১০৭ দিন কারাগারে কাটাতে হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের তথ্য-প্রযুক্তি আইনে মামলা করা হয়েছিল যেটি অনেকটা ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। এ আইনের আওতায় -জাতির ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার অভিযোগ এনে যেকােনাে বিরুদ্ধমতকে দমন করে দেয়া যাবে।নভেম্বরের ২০ তারিখে তাঁর জামিনে কারামুক্তি ঘটে।

এটা মানুষের জীবনের একটা দুর্বিষহ অধ্যায় বলা যায়। অন্যায়ের বিস্তার ঘটানোর ইচ্ছে থেকে এমন পরিস্থিতির উদ্ভব করা হয়। বিগত বছরগুলোতেও বেশ কয়েকবার কারাবন্দি হতে হয়েছে শহীদুলকে। রাস্তার ছুরির জখম হজম করেছেন। আলোকচিত্র প্রদর্শনে এসেছে পুলিশি বাধা তবু তা উপেক্ষা করেছেন।

তাঁর বাবা ছিলেন একজন বিজ্ঞানী আর মা মনোবিজ্ঞানী। ১৯৮০ দশকে লন্ডনে রসায়নে ডক্টরেট করতে আসেন শহীদুল। সে সময় বন্ধুর কাছ থেকে উপহার পান প্রথম ক্যামেরাটি।

শহীদুলের প্রথম দিককার কর্মময় জীবনের আলোকচিত্রীগুলো ছিলো শিশুদের নিয়ে। কিন্তু তিনি সর্বদাই তাঁর ক্যামেরাকে ব্যবহার করেছেন মানুষের অধিকার আদায়ের হাতিয়ার হিসেবে।

শহীদুল বলেন, “শুধু শিল্পের জন্য শিল্পকে আমি এখানে বেছে নিতে চাইনি।” লন্ডন আর্ট কাউন্সিল থেকে পাওয়া একটি পুরস্কার তাঁকে আলোকচিত্রকে পেশা হিসেবে বেছে নিতে অনুপ্রাণিত করেছে।

তারো অনেক আগে তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে, দৃশ্য গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ আর উৎসাহের ভিত হিসেবে কাজ করতে পারে।

১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়টাতে শহীদুলের বয়স ছিলো ১৬। সে সময়ের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, “ছবির প্রতি আমাদের একটা প্রচন্ড তৃষ্ণা ছিলো। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি- সে সময়টাতে মনে হতো শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তরুণপ্রাণ মুক্তিযোদ্ধাদের যে লড়াই, সে লড়াইয়ের ছবি হয়তো কেউ “টাইম” অথবা “নিউজ উয়িক” থেকে সরিয়ে দিতে পারে। এ ছবিগুলো হলো আমাদের আশার জায়গা।”

দেশের প্রতি শহীদুল আলমের ভালোবাসাটা অন্য রকমের। ১৯৮৪ সালে দেশে ফিরে গিয়েছিলেন তিনি। লন্ডনে থাকার সুবিধা থাকার পরেও নানা প্রতিকূল আর বাধার মুখে এখনও দেশের মাটিকে আঁকড়ে আছেন শহীদুল। শত জটিলতা উপেক্ষা করে তার ছবিতে ফুটে উঠে বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি।

“আওয়ার স্ট্রাগল ফর ডেমোক্রেসি” সিরিজের ছবিগুলোতে দৃশ্যমান হয়ে উঠে ১৯৮৩-১৯৯০ সালে তৎকালীন স্বৈরাশাসক জেনারেল এরশাদের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধের কথা। বাংলাদেশে আলোকিচত্রের দিকপাল তানজিম ওয়াহাব সে সম্পর্কে বলেন, “সে সময়ের ছবিগুলো হল মুক্তবাক আর শংকাহীনতার প্রতিচ্ছবি।গণতন্ত্রের লড়াইয়ের সবগুলো বিষয় তাতে ধাপে ধাপে ফুটে উঠেছে। আদিবাসী অধিকার রক্ষা আন্দোলন, ভোটাধিকার, পরিবেশের সুরক্ষা, ইসলামী আন্দোলন, জেদা-জেদির নেতৃত্ব আর শ্রেণী সংগ্রাম-এসবই রয়েছে শহীদুলের আলোকচিত্রে।”

এরপর দৃষ্টি দেই “ক্রসফায়ার” সিরিজে। ২০১০ সালে করা এই আলোকচিত্রে শহীদুল বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাবাহিনী কর্তৃক বিচারবর্হিভূত হত্যাকান্ডের বিষয়টি ফুটিয়ে তােলেছেন। “কল্পনাস ওরিয়রস” সিরিজে এ ১৯৯৬ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী অধিকার রক্ষায় আন্দোলন করতে গিয়ে কল্পনা চাকমার গুম হবার বিষয়টি তোলে ধরেছেন।

ব্যক্তি স্বাতন্ত্র রক্ষা করে অর্থাৎ কারো কাছে নত না হয়ে মানুষ কিভাবে তার জীবন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে সেটা খুবি নান্দনিক কৌশলে ক্যামেরাবন্দি করতে পারেন শহীদুল। এ অর্জনের জায়গাটুকুতে কীভাবে আসতে পেরেছেন প্রশ্ন করা হলে ধীর কন্ঠে তিনি বলে উঠেন-“আলোকচিত্র হলো একজনের অবস্থার প্রতিচিত্র। আপনি যার আলোকচিত্র তৈরি করছেন তার প্রতিচ্ছবি তাতে কথা বলবে।”

নিজেকে আলোকচিত্রী সাংবাদিকের স্বীকৃতি দিতে নারাজ শহীদুল। তাঁর কথা হলো আমি কাজ যা করেছি তা অন্যদের তুলনায় খুবি স্বল্প। অনুকরণীয় আরেক আলোকচিত্রীর উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, “অন্যদের থেকে ভিন্ন একটা কিছু করার ইচ্ছে ছিলো আমার। আলোকচিত্র দিয়ে আমি সে শখ মেটাতে পারতাম। কিন্তু স্বপ্ন পথের সহযোদ্ধা বানিয়েও আমি সেটা করতে পারতাম।”

এরশাদের বিরুদ্ধে যেসব আলোকচিত্রী সরব হয়েছিলেন তাদের ছবিগুলো দৃশ্যমান করতে ১৯৮৯ সালে তিনি “দৃক পিকচার লাইব্রেরি” প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৯৮ সালে তৈরি করেন “পাঠশালা সাউথ এশিয়ান মিডিয়া ইন্সস্টিটিউট"।এর দুই বছর পর তিনি “ছবি মেলা”র আয়োজন করেন। এটি ছিলো দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক আলোকচিত্র প্রদর্শনী।

ল্যাটিন আমেরিকা, এশিয়া, আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের আলোকচিত্রীদের প্রদর্শনী বিস্তারের সুযোগ তৈরি করতে ২০০৭ সালে শহীদুল আরেকটি সংস্থা তৈরি করেন। “মেজরিটি ওয়ার্ল্ড” নামে এই সংস্থাটি গড়ার উদ্দেশ্য ছিলো বিস্তৃত এ অঞ্চলগুলোর এগিয়ে যাবার বিষয়টিকে প্রাধান্য দেয়া। তিনি বলেন, “এর মাধ্যমে পশ্চিমাদের বাগাড়ম্বরপূর্ণ গণতন্ত্র আর স্বাধীনতার বিষয়টিতে আমরা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতে চেয়েছিলাম। কারণ এ অঞ্চলের মানুষেরা সংখ্যাগরিষ্ট(গণতন্ত্রের মাপকাঠিতেও)কিন্তু তাদের আওয়াজ কারো কানে যাচ্ছেনা।”

১৯৯০ এরশাদের যখন পতন হয়েছিলো তখন কোনো পশ্চিমা সংস্থা শহীদুলের কাছ থেকে সে সময়টুকুর ছবি নেননি। তিনি বলেন, “সে দিনের দৃশ্যপটটা ছিলো মিসরের তাহরির স্কয়ারের মতো। ২০১১ সালের বিক্ষোভে যেভাবে মিসরবাসী হোসনী মোবারকের পতন ঘটিয়েছিলো তেমনরকম।কিন্তু সে সময়টাতে বাংলাদেশ নিয়ে এমন মনযোগ বহিঃবিশ্বের কারো ছিলোনা।” বিষয়টা আসলে কী রকম? তাহলে?

“মুক্তিকামী মানুষেরা সেদিন মুক্তির জন্য নিজেদের জীবন বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত ছিলো।”

বহিঃবিশ্বের এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে একটা সময়ে। দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের ডেপুটি পিকচার এডিটর ন্যান্সি লি দৃকের কাছে ১৯৯১ সালে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষয়-ক্ষতির ছবি চাইলেন। সেসব ছবি দেয়া হলেও তারা শুধু কৃষকের বীজ বপন আর জেলের নৌকার মেরামতের ছবি প্রকাশ করলেন-যেটা ছিলো মানুষের ঘুরে দাঁড়াবার গল্প। এটুকু বলেন নিঃশ্বাস ফেললেন শহীদুল।

তিনি বলেন, “আমার এখনো যা মনে পড়ে সেটা হলো-ঘূর্ণিঝড়ের সেই ছবি আর তার কথাগুলো শুধু কোনো কাঠামোর উপর দৃশ্যমান কোনো বিষয় ছিলোনা।”

দক্ষিণ এশিয়া এবং তার আশেপাশে দৃশ্যমান গণমাধ্যমের প্রাতিষ্ঠানিক মিলনকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। আর তার বাহবাটুকু শহীদুল আলমের প্রাপ্য।

শহীদুলকে যখন কারাগারে আটক করা হয় তখন এর প্রতিবাদে একটি পোস্টার বানিয়েছিলেন কলকাতার চলচ্চিত্র পরিচালক এবং আলোকচিত্রী রননি সেন যাতে লেখা ছিলো-“শহীদুল আলম ঠিক আকাশের মতো, যেখানে আমরা উড়াউড়ি শেখি।” বিষয়টি তখন সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে উঠে। আমি যখন শহীদুলের বিষয়টি নিয়ে রননির কাছে লিখলাম। তিনি জবাব পাঠালেন এই বলে-“ভারত উপমহাদেশে এমন কোনো একক আলোকচিত্রী নির্মাতা নেই যিনি শহীদুল আলমের সংস্পর্শে আসেননি।”

বাইরে যেমন শহীদুল মানুষের স্বতস্ফূর্ত সাড়া পেয়েছেন তেমনি সাড়া পেয়েছেন কারাগারের ভেতরেও। তার স্বাভাবিক গুণাবলীর অন্যতম একটা বিষয় হলো ইতিবাচকতাকে গ্রহণ করা। কারাগারে ভিতরের কয়েদিরা তাঁকে ভালোবাসার প্রমাণ দিয়েছিলো তাঁর আঁকা একটি পালতোলা নৌকার ছবি কারাগার হাসপাতালের দেয়ালে এঁকে দিয়ে।

কিন্তু এই শহীদুল যখন বলেন, “আমি ছড়ুইপাখিগুলোকে খুব মিস করছি।যাদেরকে কারাকক্ষের কুঠুরিতে প্রতিদিন খাবার দিতাম সেই পাখিদের কিচির-মিচির মিস করছি।”-তখন তাতে না বলা অনেক ব্যাথার শব্দ শুনতে পাই।

কারাগারে শহীদুলকে পেটানো হয়েছে, চোখ বেঁধে রাখা হয়েছে, মাথায় ভারী বোঝা চাপানো হয়েছে এবং পানিতে চুবানোর হুমকি দেয়া হয়েছিলো। এমনকি তাকে এই বলেও হুমকি দেয়া হয়েছিলো- “তিনি যদি সরকারের কথামতো চুক্তিতে একমত না হন তাহলে তাঁর স্ত্রী লেখিকা রাহনুমা আক্তারের ক্ষতি করা হবে।”

কীভাবে এই ধকল সামলে উঠেছিলেন?-এমন প্রশ্নের জবাবে শহীদুল বাংলাদেশের উদীয়মান গণতন্ত্রের পথে নাগরিক নির্যাতনের ভয়াবহতার উদাহরণ তোলে ধরেন। তিনি বলেন, “আমার বাসায় অনেক ছবি আছে যেখানে অনেক বন্ধু একসঙ্গে ছবি তোলেছি। তাদের আজ কেউ নেই। হয় গুম হয়েছে নয়তো খুন করা হয়েছে। সে সংখ্যাটা কমেনি বরং বেড়েছে।” হারানো বন্ধুরাই তাঁর ঘুরে দাঁড়াবার অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে।

শহীদুল জানান তাঁকে হুমকি দেয়া হয়েছিলো যে তাঁর সঙ্গে আরো নিষ্ঠুর আচরণ করা হবে। এমনকি অন্যদেরকেও উঠিয়ে আনা হবে।..এটুকু বলে থামলেন তিনি।

এরপর শহীদুল বলেন, “তারা (আইনশৃঙ্খলাবাহিনী) বললো আপনাকে বাড়িতে ফেরত দেয়া হবে। যতক্ষণ মুখ বন্ধ রাখবেন কেউ কিছু করবেনা আপনার সঙ্গে।” তারা আমার সঙ্গে এ চুক্তিটাই করতে চাইছিলো। কিন্তু যখন আমি তা প্রত্যাখান করলাম তারা ক্ষোভে ফেটে পড়লো।

আটকের এই সময়টাতে শহীদুলের পরিবারের অবস্থানটা ছিলো খুবি দৃঢ়। সরকারের আশা ছিলো তাঁর পরিবার হয়তো মুক্তির জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে ক্ষমা চাইবে। শহীদুল বলেন, “আমরা এরকম কোনোকিছুই করিনি।আমি কারামুক্ত হয়ে আগের মতোই অবস্থান ধরে রাখলাম, আগে যা বলেছি এখনো তাই বলছি।”

কারামুক্তি কয়েকদিন পরই অবাধ এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে প্রচারণা চালান শহীদুল। কিন্তু ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের সে নির্বাচনে ভোট কারচুপি আর ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি করে গদিতে বসেন শেখ হাসিনা। একই মাসে টাইম ম্যাগাজিনে বর্ষ সেরা ব্যক্তিদের নাম ঘোষণা হয় যে তালিকায় সাংবাদিকদের মধ্য ছিলো শহীদুল আলমের নাম।

ছবি মেলার এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “সরকারের চাপ এবং করপোরেট গোষ্ঠীর এগিয়ে না আসার কারণে সাধারণ মানুষ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারছেনা।”

আগামী মাসে নিউইয়র্কে রুবিন মিউজিয়ামে “ট্রুথ টু পাওয়ার” শিরোনামে যুক্তরাষ্ট্রে প্রথমবারের মতো শহীদুলের আলোকচিত্র প্রদর্শনী হবে। লেখিকা অরুন্ধতী রায় শহীদুলকে উদ্দেশ্য করেই লিখেছিলেন-“দি টাইড উইল টার্ণ”।

কার্যত এখনো আইনের ঘুরপ্যাঁচে আটকে আছেন শহীদুল। গত আগস্টে তাঁর বিরুদ্ধে করা মামলায় স্থগিতাদেশ দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট। হাসিনার এ সময়টাতে তাঁকে আরো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে।

তিনি বলেন, “কিঞ্চিত কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া অধিকাংশ গণমাধ্যম এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মুখ বন্ধ করে চলার নীতি অবলম্বন করেছে। এ ক্ষেত্রে আরেকটা যে পন্থা অনুসরণ হচ্ছে তা হলো সরকারের তোষামোদি।”

শহীদুল এখনো বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যেই সাহসের ঝলক দেখতে পান। একমাত্র তারাই পারে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ চালিয়ে যেতে। অত্যাচারীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর মধ্যেও একরকমের সৃজনশীলতা খুঁজে পেয়েছেন তিনি। যখন কারাগারে মাসের পর মাস আটক ছিলেন ক্যামেরা বিহীন তখন নিজের গল্প অন্যকে জানানোর ভিন্ন পন্থা খুঁজছিলেন শহীদুল।

যখন ক্যামেরা হাতে ছিলোনা তখন আলোকচিত্রের কাজটা নিয়ে কী ভেবেছেন?-এমন প্রশ্নে শহীদুল বলেন-“চোখের আলাে বলছিলো পথের দেখা পেয়ে যাবো।”

জিএস/