অ্যান্থনি ব্লিংকেনের কাছে ডেমোক্রেট দলীয় ৬ কংগ্রেসম্যানের চিঠি

সুষ্ঠু নির্বাচন এবং র‍্যাব, ডিবি পুলিশ, ডিজিএফআইকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে স্টেট ডিপার্টমেন্টকে কংগ্রেসের তাগিদ

সুষ্ঠু নির্বাচন এবং র‍্যাব, ডিবি পুলিশ, ডিজিএফআইকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে স্টেট ডিপার্টমেন্টকে কংগ্রেসের তাগিদ

মুশফিকুল ফজল আনসারী

বাংলাদেশে ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে চলমান মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন ডেমোক্রেট দলীয় ৬ কংগ্রেস সদস্য। একইসঙ্গে চরম মানবাধিকার লংঘনের দায়ে সম্প্রতি নিষেধাজ্ঞা পাওয়া র‍্যাবসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার আহবান জানিয়েছেন এই ৬ কংগ্রেসম্যান। বাংলাদেশে র‍্যাব, ডিবি পুলিশ এবং ডিজিএফআইসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলবাহিনীর মানবাধিকার লংঘনের ঘটনাগুলোর তথ্য স্টেট ডিপার্টমেন্ট কীভাবে যাচাই করে তা জানতে চেয়েছেন তারা।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিংকেনের কাছে লেখা এক যৌথ চিঠিতে এই আহবান জানানো হয়। হাউস মানবাধিকার কমিটি-ল্যানটস হিউম্যান রাইটস কমিশনের কো-চেয়ারম্যান কংগ্রেসম্যান জেমস পি ম্যাকগভার্ন বুধবার চিঠিটির একটি কপি এই প্রতিবেদকের নিকট প্রেরণ করেন। চিঠিতে সাক্ষর করা সরকার দলীয় ছয় কংগ্রেসম্যান হলেন- উইলিয়াম আর কিটিং, জেমস পি ম্যাকগভার্ন, বারবারা লী, জিম কস্টা, দিনা টাইটাস এবং জেমি রাসকিন।

চিঠির শুরুতে বলা হয়েছে, “বাংলাদেশে ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশটির চলমান মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ জানাতে আমরা আপনাকে লিখছি। আমরা স্টেট ডিপার্টমেন্টসহ যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য সংস্থাগুলোকে বাংলাদেশে চরম মানবাধিকার লংঘনের দায়ে সম্প্রতি নিষেধাজ্ঞা পাওয়া র‍্যাবসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার আহবান জানাচ্ছি।”

এতে বলা হয়, “যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের কর্মকর্তাদের স্পষ্ট ভাষায় দেওয়া বিবৃতি এবং পদক্ষেপের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারকে মানবাধিকার মেনে চলায় বাধ্যবাধকতা আরোপ করা যেতে পারে। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতির জন্য এরকম পদক্ষেপ নেওয়াটা খুবি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বাংলাদেশে ইতিমধ্যে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থকদের গণহারে গ্রেফতার এবং সহিসংতার ঘটনা ঘটেছে। এর ফলে নির্বাচনের ফলাফলে কারচুপি হতে পারে এবং দেশটিতে সামাজিক সংঘাত বাড়তে পারে।”

চরম মানবাধিকার লংঘনের দায়ে ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে র‍্যাব এবং বাহিনীটির বর্তমান এবং সাবেক সাত অফিসারের বিরুদ্ধে দেওয়া যুক্তরাষ্ট্র সরকারের নিষেধাজ্ঞাকে স্বাগত জানিয়ে এই ৬ কংগ্রেসম্যান নিষেধাজ্ঞাটিকে ‘জরুরি’ এবং ‘যুক্তিসংগত’ বলে মন্তব্য করেন।

যুক্তরাষ্ট্রের সর্বশেষ বার্ষিক মানবাধিকার রিপোর্টের বরাত দিয়ে চিঠিতে বলা হয়, “রিপোর্টে বলা হয়েছে, মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের তথ্যমতে বাংলাদেশে  র‍্যাব, ডিবি পুলিশ, ডিজিএফআইসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যদের মাধ্যমে ২০২২ সালে দেশটিতে  ৩১ টি বিচারবর্হিভূত হত্যাকান্ড, ২১ টি গুম, পুলিশি হেফাজতে মারা গেছে ৬৮ জন, সাংবাদিকদের ওপর ১৮৩ টি হামলার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনাগুলো প্রমাণের মাধ্যমে উপস্থাপিত হবার পরও বাংলাদেশ সরকারের কর্তা ব্যক্তিরা মানবাধিকার লংঘনের ঘটনাগুলো ক্রমাগত অস্বীকার করে যাচ্ছে। এধরনের প্রমাণগুলোকে তারা দেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার বলে উড়িয়ে দিচ্ছে। শুধু তাইনা বরং গুম এবং বিচারবর্হিভূত হত্যাকান্ডের মতো ভয়ংকর মানবাধিকার লংঘনের ঘটনায় জড়িত অফিসারদের পুরস্কৃত করা হচ্ছে এবং পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে।”

চিঠিতে বলা হয়েছে, “২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দেবার পরই বাংলাদেশের অনেক লোক যারা মানবাধিকার লংঘনের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী, মানবাধিকার লংঘনের ঘটনার প্রমাণ যাদের হাতে রয়েছে কিংবা বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর হাতে মানবাধিকার লংঘনের শিকার হয়েছে তারা মুখ খুলেছে। এই মুখ খোলার অপরাধে সরকার সুশীল সমাজের বিভিন্ন সংস্থা, মানবাধিকার কর্মী, মানবাধিকার লংঘনের শিকার ভুক্তভোগী এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের ওপর প্রতিশোধমূলক আচরণ বাড়িয়ে দিয়েছে। উদাহরণ হিসেবে গুমের শিকার হওয়া পরিবারের সদস্যদের কথা বলা যায়। তাদেরকে হয়রানি করা হয়েছে, জোর করে খালি কাগজে অথবা আগে থেকেই লিখে নিয়ে আসা কাগজে সই নেয়া হয়েছে, যেখানে লেখা ছিলো-তাদের পরিবারের সদস্যদের কেউ গুম করেনি তারা এমনি নিখোঁজ হয়ে গেছে।”

চিঠিতে বলা হয়েছে, “এসকল অভিযোগের বাইরে ২০২২ সালের জুন মাসে মানবাধিকার লংঘন নিয়ে রিপোর্ট করে বিশ্বে  দেশের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুন্ন করার দায়ে অধিকারের রেজিস্ট্রেশন বাতিল করে দিয়েছে সরকার।  অধিকারের কর্মকর্তা, সদস্য এবং পরিবারের সদস্যরা আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর অফিসারদের নজরদারি, হয়রানি এবং জেরার মুখোমুখি হয়েছেন।”

যুক্তরাষ্ট্রের ৬ কংগ্রেস সদস্য বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার পদক্ষেপ নেবার পরও সুশীল সমাজ, মানবাধিকার কর্মী, ভুক্তভোগী এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা  র্যাবের সদস্য এবং অন্যান্য আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর ওপর অধিকতর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের প্রতি আহবান জানিয়েছে। এতে করে বাংলাদেশ সরকারকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা যাবে এবং তাদেরকে একটা স্পষ্ট বার্তা দেয়া যাবে যে- কোনো অনিয়ম সহ্য করা হবেনা।”

এতে আরও বলা হয়, “আমরা এটা জানি যে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশীদার দেশ। তারা যেভাবে ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে সেটা সাধুবাদ জানাবার বিষয়। একিসঙ্গে ২০২৩ সালে গণতন্ত্র সম্মলনে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ না জানানোর মাধ্যমে স্টেট ডিপার্টমেন্ট আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশটির গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে একটি স্পষ্ট সংকেত দিয়েছে।”

চিঠিতে বাংলাদেশ ইস্যুতে বেশ কিছু বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান কী তা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিংকেনের কাছে জানতে চেয়েছেন এই কংগ্রেস সদস্যরা।

বাংলাদেশে র‍্যাব, ডিবি পুলিশ এবং ডিজিএফআইসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলবাহিনীর মানবাধিকার লংঘনের ঘটনাগুলোর তথ্য স্টেট ডিপার্টমেন্ট কীভাবে যাচাই করে তা জানতে চেয়েছেন ছয় কংগ্রেস সদস্য।

তারা জানতে চেয়েছেন- বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলাবাহিনীগুলো মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়ন করছে নাকি অবনতি ঘটাচ্ছে- সেটা মূল্যায়নে কী মানদন্ড ব্যবহার করছে স্টেট ডিপার্টমেন্ট? আর এই মানদন্ডের ওপর ভিত্তি করেই কী নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা এবং প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় কীনা তা জানতে চাওয়া হয়েছে।

২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা ঘোষণার পর বাংলাদেশে সুশীল সমাজ, মানবাধিকার কর্মী এবং মানবাধিকারের শিকার ব্যক্তিদের সরকারের প্রতিশোধমূলক আচরণ থেকে সুরক্ষা দিতে স্টেট ডিপার্টমেন্ট কী ধরনের পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করছে তা জানতে চেয়েছেন ক্ষমতাসীন দল ডেমোক্রেটের এই ৬ সদস্য।

র‍্যাব এবং বাহিনীটির বর্তমান ও সাবেক অফিসারদের বিরুদ্ধে  যুক্তরাষ্ট্রের অন্য মিত্রদের নিষেধাজ্ঞা আরোপে উৎসাহিত করতে স্টেট ডিপার্টমেন্ট কী ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে তাও জানতে চেয়েছেন কংগ্রেসের এই সদস্যরা।

তারা জানতে চেয়েছেন- বাংলাদেশের ২০২৪ সালে অবাধ এবং সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বাধাদানকারীদের বিরুদ্ধে ভিসা নীতির বিধিনিষেধ আরোপের সিদ্ধান্তের বাইরে যুক্তরাষ্ট্র সরকার বাড়তি আর কী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে?

বাংলাদেশে বর্তমানে অবাধ এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ, মতপ্রকাশ, সংগঠন এবং সমাবেশ আয়োজন স্বাধীনতা আছে- এগুলো যাচাইয়ে স্টেট ডিপার্টমেন্টের হাতে কী ধরনের মানদন্ড রয়েছে তারও উত্তর জানতে চেয়েছেন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের নেতৃত্বাধীন দলের এই ৬ কংগ্রেসম্যান।

প্রসঙ্গত, গত ১৯ মে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের কাছে লেখা অপর এক চিঠিতে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী শেখা হাসিনা এবং গুরুতর  মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানান কংগ্রেসের মেজরিটি পার্টি রিপাবলিকান দলীয় ৬ কংগ্রেসম্যান।

এনআর/