হোয়াইট হাউসে মোদি-বাইডেন বৈঠক

মানবাধিকার প্রশ্নে  মুখ খুললেন মোদি, দ্বিপাক্ষিক স্বার্থে কৌশলি বাইডেন

মানবাধিকার প্রশ্নে  মুখ খুললেন মোদি, দ্বিপাক্ষিক স্বার্থে কৌশলি বাইডেন

মুশফিকুল ফজল আনসারী, হোয়াইট হাউস থেকে

সমস্যা, সম্ভাবনা, মৈত্রির বন্ধন আবার সমালোচনা, এমনকি ৭৫ আইন প্রণেতার যৌথ চিঠি চালাচালির মাঝেই তিন দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের পক্ষে সোচ্চার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যেমন ভবিষ্যত কৌশলের হিসেব কষে মোদিকে বলেছেন ‘স্বাগত’। অন্যদিকে নিজেকে নিরাপদ জোনে রাখার কৌশল বেছে নিয়েছেন মোদি।

বৃহস্পতিবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদিকে হোয়াইট হাউসে রাষ্ট্রীয় প্রথা অনুযায়ী স্বাগত জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। হোয়াইট হাউসের সাউথ লনে লাল গালিচা বিছিয়ে স্বাগত জানায় আর্মড কোরের একটি চৌকস দল। এরপর ওভাল অফিসে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন এই দুই নেতা এবং সন্ধ্যায় আয়োজন করা হয় রাষ্ট্রীয় নৈশ ভোজের।

কর্তৃত্ববাদের দিকে ঝুঁকে পড়া মোদি পশ্চিমাদের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছেন। ভিন্নমত দলন করা, সাংবাদিকদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু বানানো এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে মোদি দেশটিতে এমনসব নীতি তৈরি করছেন যা সংখ্যালঘু মুসলমানদের জন্য বৈষম্যমূলক। এশিয়াকে কেন্দ্র করে বাইডেন প্রশাসনের যে কৌশল তাতে মোদি এবং তার ভারতের অবস্থান অনেকটা ছিদ্র তৈরি করে দেয়ার মতোই বলা যায়। বাইডেনের দৃষ্টিতে বৈশ্বিক যে চ্যালেঞ্জ রয়েছে তা জলবায়ু থেকে প্রযুক্তি যাই হোক না কেনো সেখানে ভারতকে হিসাবের বাইরে রাখার সুযোগ নেই। চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যে ক্রমবর্ধমান বৈরিতা সেটা মোকাবিলায় হাতে অল্প কিছু দেশ রয়েছে যাদের মিত্র বানানো প্রয়োজন। বাইডেন এ বিষয়টিতে যথেষ্ট মনোযোগী। যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সূত্রে জানা গেছে মোদিকে রাষ্ট্রীয় আমন্ত্রণ জানানোর পেছনে গোপন কারণ এটাই।

দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন ইস্যুতে দেন-দরবার করেছেন বলে জানা গেছে। এরপর সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন বাইডেন এবং মোদি। সংবাদ সম্মেলনে কেবল দুই সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দেন উভয়েই। ক্ষমতায় আসার পর থেকে রিবোধীমত দলন এবং সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে নেয়া বৈষম্যমূলক নীতির বিষয়ে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের হোয়াইট হাউস করেসপন্ডেন্ট সাবরিনা সিদ্দিকের প্রশ্নের সরাসরি কোনো জবাব না দিলেও হোয়াইট হাউসে কিছু সময়ের জন্য মুখ খুলেছেন প্রধানমন্ত্রী মোদি। প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে দোভাষীর মাধ্যমে মোদি বলেন, “আসলে বৈষম্য করার কোনো সুযোগ নেই।”

তিনি বলেন, “আমরা যখন গণতন্ত্র নিয়ে কথা বলবো তখন মানবিক মূল্যবোধ, মানবতা এবং মানবাধিকার যদি না থাকে তাহলে সেটাকে আর গণতন্ত্র বলা যাবেনা।”

সংবাদ সম্মেলনে মোদির এই কথা বলাটা মনে রাখার মতো একটা বিষয়। কারণ ভারতের এই প্রধানমন্ত্রী কোনো সংবাদ সম্মেলনে যোগ দেননা। সাংবাদিকদের প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতেন না এবং দেশের বাইরে সাক্ষাতকার দিতেও রাজি হতেন না। সংবাদপত্রের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলো বলছে মোদির তত্ত্বাবধানেই গণমাধ্যম দলন হয়েছে।

জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারত দুই দেশের প্রতিনিধিদের দীর্ঘ সময়ের দেন-দরবারের পর সংবাদ সম্মেলনে যোগ দিতে সম্মতি জানান মোদি।

মোদির বিরুদ্ধে মানবাধিকার লংঘন ইস্যু প্রসঙ্গে বাইডেন বলেন, “ভারতের প্রধানমন্ত্রী এবং আমি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিষয়গুলো নিয়ে খুব ভালো একটা আলোচনা করেছি।”

তিনি বলেন, “আমাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ধরণটাই এরকম। দ্বিপাক্ষিক বিষয়ে আমরা স্পষ্ট করে কথা বলে থাকি। আমরা একে অপরকে সম্মান করি।”

বাইডেন বলেন, “গণতন্ত্র নিয়ে দুই দেশের প্রতিশ্রুতি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে আরও চমৎকার করেছে। এই প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে বিশ্বে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও বিস্তৃত করার সুযোগ রয়েছে।”

সকালে মোদিকে হোয়াইট হাউসে স্বাগত জানানোর সময় বাইডেন সম্পর্ককে সামনে এগিয়ে নিতে দ্বিপাক্ষিক মূল্যবোধের নীতির বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন।

সাউথ লনে দাঁড়িয়ে বাইডেন বলেন, “গণতান্ত্রিক দেশের অংশীদার হিসেবে আমরা জনগণের মেধাকে আরও বেশি কাজে লাগাতে পারি। সত্যিকার ও বিশ্বস্ত মিত্র এবং অগ্রসর জাতি হিসেবে আমরা আরও বিনিয়োগ বাড়াতে পারি। আমাদের রপ্তানি বাণিজ্যটা এর সেরা উদাহরণ।”

তিনি বলেন, “আইনের সমতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, বহু ধর্মের স্বাধীনতা, মানুষের বৈচিত্র্য--এই মৌলিক বিষয়গুলো অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে আমাদের জাতির ইতিহাসে কঠিন পথ পাড়ি দিয়েছে এবং বিকশিত হয়েছে। এগুলো আমাদের শক্তি যুগিয়েছে, ঋদ্ধ করেছে এবং ভবিষ্যতকে সমৃদ্ধ করেছে।”

দুই দেশের বৈঠকে প্রযুক্তি এবং সামরিক খাতে সহযোগিতা নিয়ে বেশ কিছু চুক্তি হয়েছে।

বৈঠকে অন্যান্যের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিংকেন, প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন, বাণিজ্যমন্ত্রী গিনা রায়মন্ডো, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলেভান, প্রেসিডেন্ট বাইডেনের জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক সহকারি জন পোদেস্তা, ভারতে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের এরিক গারসেটি এবং ভারতের পক্ষে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শংকর, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল, পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রা এবং রাষ্ট্রদূত তারানজিত সিং সান্দু উপস্থিত ছিলেন।

হোয়াইট হাউসে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী ক্যাপিটল হিলে কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে বক্তব্য দেন। ডেমোক্রেট এবং রিপাবলিকান উভয় দলের সম্মতিতে তাকে বক্তব্যের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হলেও নরেন্দ্র মোদির বক্তব্যে কংগ্রেসে মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেছে। অ্যালেকজান্দ্রিয়া ওকাসিও কর্টেজ, রাশিদা তালাইব এবং ইলহান ওমরের মতো কংগ্রেসম্যান প্রধানমন্ত্রী মোদির বক্তব্য বর্জন করেছেন।

সন্ধ্যায় প্রায় ৪শ আমন্ত্রিত অতিথির অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয় রাষ্ট্রীয় নৈশ ভোজ। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সম্মানে প্রেসিডেন্ট বাইডেন এবং ফার্স্টলেডি ড. জিল বাইডেনের দেয়া হোয়াইট হাউস স্টেট ডিনারের অতিথিদের তালিকায় নেটফ্লিক্সের বেলা বাজারিয়া, ইউনিভার্সালের ডোনা ল্যাংলি, মুভি ডিরেক্টর এম নাইট শ্যামলান, ওয়াসারম্যান মিডিয়া গ্রুপের কেসি ওয়াসারম্যান এবং জেমস মারডক সহ বেশ কিছু সেলিব্রেটি এবং মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

এছাড়াও যোগ দেন অপেন এআই’র সিইও স্যাম অল্টম্যান, অ্যাপেলের সিইও টিম কুক এবং গুগলের সুন্দর পিচাই, মার্টিন লুথার কিংয়ের ছেলে মার্টিন লুথার কিং থার্ড, রাল্ফ লরেন, টেনিস কিংবদন্তি বিলি জিন কিং, হাউস স্পিকার কেভিন ম্যাকার্থি, ডিজাইনার রিম আক্রা এবং বাইডেন প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাবৃন্দ।