‘পুলিশ হামলা করার আগপর্যন্ত বিক্ষোভকারীরা শান্তিপূর্ণ ছিলো’

বাংলাদেশে বিক্ষোভকারীদের ওপর বলপ্রয়োগ বন্ধ, আইন লঙ্ঘনকারী পুলিশ অফিসারদের বিরুদ্ধে তদন্তের আহবান অ্যামনেস্টির

বাংলাদেশে বিক্ষোভকারীদের ওপর বলপ্রয়োগ বন্ধ, আইন লঙ্ঘনকারী পুলিশ অফিসারদের বিরুদ্ধে তদন্তের আহবান অ্যামনেস্টির

বাংলাদেশে অবিলম্বে বিক্ষোভকারীদের ওপর অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ বন্ধের আহবান জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। গত ২৯ জুলাই বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি আয়োজিত অবস্থান কর্মসূচিতে বিক্ষোভকারী ও বিরোধী দলের নেতাদের ওপর সহিংস আক্রমণের খবর যাচাই করার পর এই আহবান জানিয়েছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংস্থাটি।

একইসঙ্গে হামলার সঙ্গে জড়িতদের অবশ্যই বিচার আওতায় আনতে এবং যেসকল পুলিশ অফিসাররা আইন লঙ্ঘন করেছে তাদের বিরুদ্ধে নিরপেক্ষ, স্বাধীন এবং দ্রুত তদন্ত করতে সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছে মানবাধিকার সংস্থাটি।

শুক্রবার অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলেছে। তারা বলেছেন, পুলিশ হামলা করার আগপর্যন্ত বিক্ষোভকারীরা শান্তিপূর্ণ ছিলো।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনরত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ওই দিন রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন প্রবেশপথে অবস্থান নেয়। তাদের এই বিক্ষোভ পুলিশের সঙ্গে সহিংসতার মধ্য দিয়ে শেষ হয়।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের অন্তর্বর্তীকালীন দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক আঞ্চলিক পরিচালক স্মৃতি সিংহ বলেন, ‘যেসব ভিডিও ও ছবি অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল যাচাই করেছে, সেগুলো বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে আলোকপাত করে। আমরা বাংলাদেশের সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি, যেন আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো কঠোরভাবে আইন মেনে চলে এবং নাগরিকদের বাক্‌স্বাধীনতা ও শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকে। মানুষের আরও শারীরিক ক্ষতি এড়াতে এবং সংকট যেন আরও না বাড়ে, সে কারণেই এটা করা দরকার।’

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের গবেষকেরা এবং ক্রাইসিস এভিডেন্স ল্যাব বাংলাদেশের ওই বিক্ষোভের ৫৬টি ছবি ও ১৮টি ভিডিও পর্যালোচনা করেছেন। পাশাপাশি ঘটনার নয়জন প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তারা।

যাচাই করা একটি ভিডিওতে ঢাকার মাতুয়াইলের শিশু ও মাতৃসদন হাসপাতাল এলাকায় পুলিশের কাঁদুনে গ্যাস থেকে নিজেদের রক্ষায় লোকজনকে দৌড়াতে দেখা গেছে। তাদের মধ্যে অন্তত পাঁচজন নারী ছিলেন। অ্যামনেস্টি বলেছে, হাসপাতালের আশপাশে কাঁদুনে গ্যাস ব্যবহার করা যাবে না। কম প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার নিয়ে জাতিসংঘের নির্দেশনায় বলা আছে, বয়োবৃদ্ধ, শিশু, অন্তঃসত্ত্বা নারী, অসুস্থ ব্যক্তিসহ যাদের পক্ষে আক্রান্ত এলাকা থেকে সরে যাওয়া কঠিন, তাঁদের কথা বিবেচনায় নিয়ে পুলিশকে শক্তি প্রয়োগের প্রভাব ন্যূনতম করতে হবে।  

স্মৃতি সিংহ বলেছেন, পুলিশের শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের ওপর কাঁদুনে গ্যাস, রাবার বুলেট ব্যবহার করা উচিত নয়। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে, বাংলাদেশের পুলিশ হাসপাতালের ভেতরে কাঁদুনে গ্যাস ব্যবহার করছে, যার মধ্য দিয়ে তাদের আন্তর্জাতিক আইনকে তোয়াক্কা না করার বিষয়টি প্রকাশিত হচ্ছে। এটা উদ্বেগজনক।

আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর বেআইনী বলপ্রয়োগ সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, টুইটারে পোস্ট করা এক ভিডিওতে দেখা গেছে ঢাকার ধোলাইখালে ব্যাটনের মতো দেখতে লাঠি দিয়ে বিক্ষোভকারীদের পেটাচ্ছে পুলিশের অফিসাররা। ভিডিওতে স্পষ্টই বুঝা যাচ্ছিলো যে যাদের পেটানো হচ্ছিলো তারা পুলিশ থেকে পালাচ্ছিলো। তাদের হাতে কোনো রকমের অস্ত্র ছিলোনা এবং পুলিশ অফিসারদের জন্য কোনাে হুমকিও ছিলোনা তারা। নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে অস্ত্রের ব্যবহার অযৌক্তিক এবং বাড়াবাড়ি।

একই ভিডিওর অপর অংশ দেখা যাচ্ছে, বিক্ষোভকারীরা রাস্তায় পড়ে আছে আর তাদের পিটিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। 

টুইটারে পোস্ট হওয়া অপর একটি ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, মাটিতে পড়ে যাবার পরও বিএনপির সিনিয়র নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে অন্তত চার জন পুলিশ অফিসার লম্বা লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছে, যদিও তিনি পুলিশের জন্য কোনো হুমকির কারণ ছিলেন না।

প্রতিবেদনে বলা হয়, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বার বার বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে সংযত আচরণের আহবান জানিয়ে আসছে। 

পুলিশের সঙ্গে সাদাপোশাকের লোকদের বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিএনএস সেন্টার মার্কেটে পুলিশের হামলায় আহত বিএনপির কর্মী নিলুফার ইয়াসমীন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালকে বলেছেন, “পুলিশ টিয়ার গ্যাস ছোঁড়ার পরপরই আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই। তখন সাদাপোশাকের কিছু লোক আমাকে ধরে ফেলে এবং হামলা করে। পুলিশ তাদের থামাতে কিছুই করেনি তখন।”

আরেক প্রত্যক্ষদর্শী অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালকে বলেছেন, পুলিশ ব্যারিকেড তৈরির সময় সেখানে শুধু আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর কর্মকর্তারা ছিলো বিষয়টা এমন নয় বরং তাদের সঙ্গে সাদাপোশাকে সরকার দলীয় কর্মীরাও ছিলো। 

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ঐঘটনার সাতটি ছবি, দুইটি ভিডিও এবং প্রত্যক্ষদর্শী এক সাংবাদিকের প্রমাণ যাছাই করে দেখেছে। এগুলোতে দেখা গেছে সাদাপোশাকের ব্যক্তিরা হাতুড়ি এবং লাঠি উঁচিয়ে বিক্ষোভকারীদের দিকে তেড়ে গেছে। যাচাই করা তথ্যগুলোতে দেখা গেছে ঐসব সাদাপোশাকের ব্যক্তিরা পুলিশের পাশাপাশি থেকে বিক্ষোভকারীদের পিটিয়েছে। 
সাদাপোশাকধারীদের পুলিশের সঙ্গে যোগ দিয়ে বিক্ষোভকারীদের হামলা করাটা অগ্রহণযোগ্য বলে মন্তব্য করেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।