চীনা প্রতারকের সঙ্গে যোগসাজশে ২০১৬ সালে জাতিসংঘের অনুষ্ঠানে প্রধান বক্তা ছিলেন হাসিনা, অ্যাওয়ার্ড নেন জয়

চীনা প্রতারকের সঙ্গে যোগসাজশে ২০১৬ সালে জাতিসংঘের অনুষ্ঠানে প্রধান বক্তা ছিলেন হাসিনা, অ্যাওয়ার্ড নেন জয়

২০১৬ সালে জাতিসংঘে একটি সংস্থার অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে চীনের এক প্রতারক দম্পতির সঙ্গে যোগাযোগ করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়। জাতিসংঘের ঐ অনুষ্ঠানে যোগ দেবার সব ব্যবস্থা করে দিতে চীনা প্রতারক কেরি ইয়ান এবং তার স্ত্রী গিনা ঝো এর সঙ্গে সব ধরনের যোগাযোগ করেন জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের তৎকালীন স্থায়ী প্রতিনিধি মাসুদ বিন মোমেন। 

জাতিসংঘে ওয়ার্ল্ড অরগেনাইজেশন অব গভর্নেন্স এন্ড কম্পেটিটিভনেস নামের ঐ সংস্থার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান বক্তা ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আর সেই অনুষ্ঠানে ডিজিটাল খাতে ভূমিকা রাখার জন্য অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয় জয়কে। সংস্থাটির প্রেসিডেন্ট পদ বাগিয়ে নিয়েছিলেন প্রতারক ইয়ান।

অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের একটা আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্ট (ওসিসিআরপি) গত মঙ্গলবার তাদের ওয়েব সাইটে প্রকাশিত এক অনুসন্ধানী রিপোর্টে এ তথ্য জানিয়েছে। শুক্রবার এই রিপোর্টের বরাত দিয়ে ভারতের গণমাধ্যম নর্থইস্ট নিউজও আরেকটি রিপোর্ট প্রকাশ করে।

ওসিসিআরপি'র রিপোর্টে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করার পর থাইল্যান্ড থেকে গ্রেফতার করা হয় ইয়ান এবং ঝোকে। এরপর বিচারের জন্য তাদেরকে নিউইয়র্কে নিয়ে যাওয়া হয়। এবছরের শুরুতে ষড়যন্ত্রে যুক্ত থাকার কথা স্বীকার করার দায়ে আদালত চীনের এই দুই নাগরিককে কারাদন্ড দেয়। কারাদন্ড দেবার সংক্ষিপ্ত সময় পরে আদালত ঝোকে মার্শাল দ্বীপপুঞ্জে নির্বাসিত করে। নভেম্বর মাসে সাজা শেষে মুক্তি দেওয়া হবে ইয়ানকে।

রিপোর্টে বলা হয়েছে, একটি সন্ত্রাসী সংগঠনের শীর্ষ তালিকায় নাম রয়েছে ইয়ান এবং ঝোর। সংগঠনটির সঙ্গে চীনের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা মন্ত্রণালয় এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর যোগাযোগ রয়েছে। প্রতারক এই চীনা দম্পতি চল-চাতুরি করে জাতিসংঘে নিজেদের অবস্থান তৈরির সুযোগ করে নেয় ২০১৫ সালে।

ওসিসিআরপি'র রিপোর্টে বলা হয়েছে, ঘুষ দিয়ে জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব বান কি মুনের সঙ্গে বেশ কিছু ছবি তুলতেও সক্ষম হয়েছিলেন ইয়ান। এটা ছিলো জাতিসংঘের শীর্ষ কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে ছবি তোলার প্রথম ধাপ। নিজের সুনাম বাড়াতে জাতিসংঘের শীর্ষ কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে ছবি তোলার জন্য কিছু লোককে ঘুষ দিয়েছিলেন ইয়ান। 

জাতিসংঘে ইয়ান এবং ঝো কীভাবে নিজেদের প্রভাব বিস্তার শুরু করে সে প্রসঙ্গ উল্লেখ করে ওসিসিআরপি'র রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০১৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে জাতিসংঘে ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্রের দূত ফ্রান্সিস লরেঞ্জোর সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে ইয়ান এবং ঝো। এই যোগাযোগের তথ্য এবং অন্যান্য তথ্যগুলো এর সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা ইমেইলে এবং সাক্ষাতকারে বিষয়টি ওসিসিআরপিকে নিশ্চিত করেছে। জাতিসংঘের সবের্াচ্চ পর্যায়ে নিজেদের প্রবেশ নিশ্চিত করতে ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্রের নেটওয়ার্কের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে এই দুই চীনা নাগরিক।

লরেঞ্জোকে ব্যবহার করে ইয়ান যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক এনজিও সংস্থা ওয়ার্ল্ড অব হোপ ইন্টারন্যাশনালের এর মালিকানা নিয়ে নেন। এরপর জাতিসংঘের লগোর আদলে একটি লগো বানিয়ে সংস্থাটির নতুন করে নাম রাখেন ওয়ার্ল্ড অর্গানাইজেশন অব গভর্নেন্স এন্ড কম্পেটিটিভনেস।

নতুন এই সংস্থার অফিসে এর পর থেকে মৌরিতানিয়া, মালদ্বীপ, এলসালভাদর এবং বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের রাজনীতিবিদ, কর্মকর্তা এবং জাতিসংঘের দূতরা যাতায়াত করেন বলে ওসিসিআরপির রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে।

ইয়ানের সংস্থাটি ইকোনমিক এবং সোশাল কাউন্সিলের অুনমোদন পাবার পরপরই একেরপর এক বেশকিছু জাতিসংঘের অনুষ্ঠানের আয়োজন করার সুযোগ পায়। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭১ তম অধিবেশন চলাকালে ওয়ার্ল্ড অর্গানাইজেশন অব গভর্নেন্স এন্ড কম্পেটিটিভনেসের এক ঝমকালো উদ্বোধন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন ইয়ান। অনুষ্ঠানে প্রধান বক্তা ছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশন এ সংক্রান্ত প্রশ্নের বিষয়ে কোনো উত্তর দেয়নি।

ওসিসিআরপি'র রিপোর্টে ছাপানো একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ওয়ার্ল্ড অর্গানাইজেশন অব গভর্নেন্স এবং কম্পেটিটিভনেসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে হাসিনা এবং জয়ের এক পার্শ্বে দাঁড়িয়ে ছিলেন ইয়ান।

ওসিসিআরপি'র এই রিপোর্ট প্রকাশের পর বাংলাদেশ এবং অন্যান্য জায়গায় এ বিষয়ে অনুসন্ধান চালিয়েছে নর্থইস্ট নিউজ। অনুসন্ধানে জানা গেছে, জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের তৎকালীন স্থায়ী প্রতিনিধি মাসুদ বিন মোমেনের সহায়তায় অনুষ্ঠানে হাসিনা এবং জয়কে অংশ গ্রহণের সুযোগ করে দেন ইয়ান। ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর মাসুদ বিন মোমেনকে পররাষ্ট্র সচিব পদে নিয়োগ দেয় সরকার।

এনএইচ/