কান্ট্রি পলিসি এন্ড ইনফরমেশন নোটস ২০২৩

বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রমাণ বৃটেনের হাতে

বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রমাণ বৃটেনের হাতে

বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ বৃটেনের হাতে রয়েছে। কোনো ধরনের জবাবদিহিতা ছাড়াই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা এ ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন করে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছে দেশটি।সম্প্রতি বৃটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের বার্ষিক কান্ট্রি পলিস এন্ড ইনফরমেশন নোটসের (দেশ ভিত্তিক নীতি এবং তথ্য নোটের) বাংলাদেশ অংশে এ মন্তব্য করা হয়েছে।

এতে বলা হয়েছে, পুলিশ বাহিনীতে ব্যাপক মাত্রায় দুর্নীতি হয়। কোনো ধরনের জবাবদিহিতা ছাড়াই দেশটির আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা মানবাধিকার লঙ্ঘন করে যাচ্ছে। এর বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ রয়েছে। 

রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার স্বাধীনতাকে ক্ষুন্ন করছে উল্লেখ করে বৃটেনের তথ্য নোটের সারসংক্ষেপে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বিচার কার্যক্রমে ঘুষ আর দুর্নীতির ব্যাপক ছড়াছড়ি। আর এটা বেশি মাত্রায় হচ্ছে নিম্ন আদালতে। এসব কারণে বিচার কার্যক্রমে ধীর গতি দেখা দেয় এবং মামলা জট লেগে থাকে।

এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে নাগরিকদের কার্যকর নিরাপত্তা দেবার সামর্থ রয়েছে। তবে বিষয়টা নির্ভর করে সরকারের ইচ্ছার উপর। যাকে নিরাপত্তা দেয়া হবে তার সামাজিক অবস্থান কী রকম এবং বিশেষ করে সরকারি দলের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা রয়েছে কীনা--এসব বিষয় বিবেচনায় আনা হয়।

বিরোধী রাজনৈতিক দলের কর্মী কিংবা যাদেরকে সরকার বিরোধী মনে করা হয় অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের বিরুদ্ধেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটিয়েছে বলে বৃটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের নোটে বলা হয়েছে।

পুলিশ বাহিনীর সমালোচনা করে বৃটেনের এই নোটে বলা হয়েছে, দুর্নীতি আর ঘুষ পুলিশের মধ্যে ব্যাপক মাত্রায় ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে পুলিশ বাহিনীকে সবচাইতে দুর্নীতিপরায়ণ হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়। সরকারের সঙ্গে এই বাহিনীটির ঘনিষ্ট যোগাযোগ রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদেরকে সরকার বিরোধীদল এবং ভিন্নমত দমনের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে থাকে। সরকার দাবি করছে, পুলিশের প্রতি জনগণের আস্থা এবং বিশ্বাস উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। অধিকতর জনবান্ধব হওয়ার ক্ষেত্রে পুলিশের অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই পুলিশকে বিশ্বাস করেনা। তারা দুর্নীতি এবং সহিংসতার জন্য পুলিশকে দায়ী করে থাকে।

বিশ্বস্ত সূত্রের বরাত দিয়ে বৃটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের নোটে বলা হয়েছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো, বিশেষ করে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন (র‍্যাব), ডিবি পুলিশ এবং অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলো নির্যাতন এবং অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক, বাজে আচরণ আর শাস্তি দেবার মাধ্যমে মানবাধিকার লঙ্ঘন করে থাকে। এজন্য তাদেরকে কোনো জবাবদিহিতা করতে হয়না।  

এতে বলা হয়েছে, বিশেষ করে যাদের বিরোধীদলের সমর্থক মনে করে আটক করা হয় তাদের রিমান্ড কিংবা শাস্তি দেবার হাতিয়ার হিসাবে শারীরিক এবং মানসিক দুই ধরনের নির্যাতনই করে থাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো। মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের তথ্যমতে, ২০২২ সালে কারা হেফাজতে ১০, ২০২১ সালে ৮ এবং ২০২০ সালে ১৯ জন লোকের মৃত্যু হয়েছে। প্রায়ই এসব ঘটনাকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়া হয়। ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে র‍্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র।

পুলিশের বেআইনী গ্রেফতার প্রসঙ্গে নোটে বলা হয়েছে, পুলিশ গ্রেফতার এবং আটকের ক্ষেত্রে তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার করে। পুলিশ বেআইনীভাবে গ্রেফতার করে, অধিকাংশ রিপোর্টে এটা দেখে গেছে যে তাদের এই গ্রেফতারগুলো হয়ে থাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। বড় ধরনের বিক্ষোভের সময়টাতে এধরনের গ্রেফতার চালায় পুলিশ। এসব বিক্ষোভে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ, বেআইনী গ্রেফতার এবং আটকও করে থাকে।

গুম প্রসঙ্গে নোটে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে একের পর এক গুমের ঘটনা ঘটছে। অধিকাংশ এসব গুমের শিকার হয়ে রাজনৈতিক বিরোধীদলের কর্মী এবং সমালোচকরা। ২০২১ সালের আগস্ট মাসের হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো স্বল্প এবং দীর্ঘ মেয়াদে নিয়মিতভাবে গুমের ঘটনা ঘটিয়ে যাচ্ছে। এ সংক্রান্ত বিশ্বস্ত প্রমাণাদি মানবাধিকার সংস্থাটির হাতে রয়েছে। সংস্থাটির তথ্য বলছে, বাংলাদেশে অন্য যেকোনো বাহিনীর চাইতে গুমের জন্য বেশী দায়ী হচ্ছে র‍্যাব। র‍্যাবের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর গুমের ঘটনা কমেছে। এরপরও অব্যাহতভাবে ঘটে যাওয়া গুমের ঘটনা নিয়ে রিপোর্ট করে যাচ্ছে মানবাধিকার সংস্থাগুলো। গুমের শিকার ব্যক্তিদের অনেকেই সরকারের সমালোচক। 

এতে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগ ২০০৯ সাল থেকে ক্ষমতায় আসার পর এ পর্যন্ত ৬১০ জন লোক গুম হয়েছে।

বিচারবর্হিভূত হত্যাকান্ড সম্পর্কে বৃটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের নোটে বলা হয়েছে, পুলিশ, ডিবি পুলিশ, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ এবং র‍্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর বিরুদ্ধে বিচারবর্হিভূত হত্যাকান্ডের অভিযোগ রয়েছে। হত্যাকান্ডের পর বিষয়টিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো তাদের ইচ্ছামতো ক্রসফায়ার, বন্দুক যুদ্ধ এবং পাল্টা হত্যাকান্ড বলে চালিয়ে দেয়। দোষীদের হত্যার দায় থেকে বাঁচাতে এটা করা হয়। মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের তথ্যমতে, ২০১৮ সালের জুন মাস থেকে ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত ১,২২০ টি বিচারবর্হিভূত হত্যাকান্ড হয়েছে। এসব ঘটনায় থানায় মামলা করতে ভুক্তভোগীর পরিবারের সদস্যরা নানান ঝামেলার মুখে পড়ে, আর তাই এর প্রকৃত সংখ্যাটা জানা কঠিন হয়ে পড়ে।

বিচার ব্যবস্থার সমালোচনা করে নোটে বলা হয়েছে, আইনে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা দেয়া থাকলেও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এই স্বাধীনতাকে ক্ষুন্ন করেছে। সরকার নিম্ন আদালত নিয়ন্ত্রণ করায় নির্বাহী এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতার অবনতি ঘটেছে। বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করার অভিযোগ রয়েছে। বিচারকরা কখনো কখনো রায় দেবার ক্ষেত্রে, বিশেষ করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলার রায় দেবার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলের দ্বারা প্রভাবিত হয় অথবা আনুগত্য প্রকাশ করে।