'সরকারের অত্যাচারে বাংলাদেশে ভয় এবং চরম অনিরাপত্তার পরিবেশ তৈরি হয়েছে'

গণতন্ত্রের লড়াইয়ে বাংলাদেশের জনগণের পাশে থাকার ঘোষণা ৬ মানবাধিকার সংস্থার

গণতন্ত্রের লড়াইয়ে বাংলাদেশের জনগণের পাশে থাকার ঘোষণা ৬ মানবাধিকার সংস্থার

গণতান্ত্রিক সমাজ গড়ার জন্য বাংলাদেশের জনগণ যে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে তাতে পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছে আন্তর্জাতিক ছয়টি মানবাধিকার সংস্থা। 

সরকারের সহিংসতা এবং অত্যাচারি আচরণ বাংলাদেশের জনগণের জন্য ভয়, উৎকন্ঠা এবং চরম অনিরাপত্তার পরিবেশ তৈরি করেছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সংস্থাগুলো।

মঙ্গলবার এক যৌথ বিবৃতিতে এই উদ্বেগ জানিয়েছে ছয় মানবাধিকার সংস্থা--রবার্ট এফ কেনেডি হিউম্যান রাইটস, ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট জাস্টিস প্রজেক্ট, দ্য ইউনাইটেড অ্যাগেইনস্ট টর্চার কনসরটিয়াম, এশিয়ান ফেডারেশনস অ্যাগেইনস্ট ইনভলানটারি ডিসঅ্যাপায়েরেন্সেস, অ্যান্টি ডেথ পেনাল্টি এশিয়া নেটওয়ার্ক এবং ইন্টারন্যাশনাল কোয়ালিশন অ্যাগেইনস্ট এনফোর্সড ডিসঅ্যাপায়েরেন্সেস।

বিবৃতিতে আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশের চলমান মানবাধিকার পরিস্থিতি এবং নাগরিক স্বাধীনতা সংকুচিত হওয়া নিয়ে গভীর উদ্বেগ জানিয়ে বলা হয়েছে, ২৮ অক্টোবরে বাংলাদেশে বিরোধীদলগুলো বিক্ষোভ সমাবেশ ডাকার পর থেকেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার দল আওয়ামী লীগ বিক্ষোভ এবং বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের দমন করতে সহিংসতামূলক কর্মকাণ্ড শুরু করে দিয়েছেন। সরকারের এই দমন-পীড়নের কারণে এক সাংবাদিকসহ ১৭ জন নিহত হয়েছে এবং বিরোধীদলের ৮,২৪৯ জন নেতাকর্মী আহত হয়েছে। এদিকে, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে হবিগঞ্জ শহরের শায়েস্তাগঞ্জ এলাকায় আয়োজিত এক মানববন্ধনে পুলিশ, ক্ষমতাসীন দল এবং বিরোধীদলের মধ্যকার সংঘর্ষে অন্তত ৫০ জন লোক আহত হয়েছে। চলমান এসব ঘটনাগুলো দ্রুত জবাবদিহিতা এবং নিরপেক্ষ তদন্তের দাবিকে জোরদার করে তুলেছে।

বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোকে খুব দ্রুততার সঙ্গে মানবাধিকারের আন্তর্জাতিক নীতি মেনে চলার আহবান জানিয়ে ছয় মানবাধিকার সংস্থা বলেছে, বিক্ষোভে আইন শৃঙ্খলাবাহিনীগুলোর নির্বিচার এবং মাত্রাতিরিক্তভাবে টিয়ার গ্যাস, লাঠি, লাঠিচার্জ, রাবার বুলেট এবং একইরকমের অন্যান্য  অস্ত্র ব্যবহারের কারণে সহিংসতা ব্যাপকতা লাভ করে। বিষয়টি গভীর উদ্বেগের। 

এতে বলা হয়, পুলিশের অস্ত্রের অন্যায় ব্যবহার বন্ধে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। পুলিশের অস্ত্রের এরকম যাচ্ছেতাই ব্যবহারের কারণে শুধু যে নাগরিকদের মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয় তা নয় বরং এর কারণে ভিন্নমত, শান্তিপূর্ণ সমাবেশ এবং সংলাপের পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্থ হয়। 

বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের ওপর সরকারের নির্যাতন প্রসঙ্গে যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, অক্টোবর মাসের শেষের দিক থেকে এ পর্যন্ত ২০,০০০ এর বেশী লোককে গ্রেফতার করেছে বাংলাদেশের সরকার। বলা হচ্ছে গ্রেফতারকৃতরা বিরোধীদলের নেতাকর্মী। তাদের বিরুদ্ধে ৮৩৭ টি বানোয়াট মামলা দায়ের করা হয়েছে। যথাযথ প্রক্রিয়া মেনেই যেখানে জামিন পাবার সুযোগ রয়েছে সেখানে গ্রেফতারকৃতদের জামিন পাবার অধিকার বারবার খর্ব করা হচ্ছে। কারাহেফাজতে বন্দিদের নির্যাতন এবং অবৈধভাবে একঘরে করে রাখার বিশ্বস্ত প্রমাণ রয়েছে। 

এতে বলা হয়েছে, বিচার ব্যবস্থাকে হাত করে সরকার গণহারে বিরোধীদলের নেতাদের আদালতের মাধ্যমে সাজা দিচ্ছে। আগামী বছরের ৭ জানুয়ারীর নির্বাচনকে সামনে রেখে বিরোধীদলের সম্ভাব্য প্রার্থীদের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করার জন্য রাতেও আদালতে বিচার কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।

বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে মাত্রাতিরিক্ত সহিংসতা, বেআইনী গ্রেফতারের মাধ্যমে দেশটির গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার পরিস্থিতির দুর্দশা বুঝা যায়। এই অন্যায়গুলো এমন একটা সময়ে হচ্ছে যখন আগামী জানুয়ারিতে একটি অবাধ এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে জনগণ বিক্ষোভ করছে। মৌলিক গণতান্ত্রিক নীতির চর্চার বদলে সরকারের সহিংসতা এবং অত্যাচারের নীতির কারণে দেশটির জনগণের জন্য ভয়, উৎকণ্ঠা এবং চরম অনিরাপত্তার পরিবেশ তৈরি হয়েছে।

উপাত্ত সুরক্ষা আইনের খসড়া নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়েছে, উপাত্ত সুরক্ষা আইনের খসড়া হলো আরেকটি উদ্বেগের বিষয়। এই আইনের খসড়ায় অনুযায়ী জাতীয় নিরাপত্তা, অপরাধ প্রতিরোধ এবং শনাক্ত করার প্রয়োজনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চাইলে লাগামহীনভাবে নাগরিকের তথ্য দেখার সুযোগ পাবে। এই ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে ব্যাপক গোয়েন্দাগিরি, বিশেষ করে ভিন্ন মতের রাজনৈতিক কর্মীদের পিছনে গোয়েন্দাগিরি করার সুযোগ তৈরি হবে। এটি মানবাধিকার, বিশেষ করে ব্যক্তির তথ্যের গোপনীয়তার জন্য হুমকি।

বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ন্যায়, গণতান্ত্রিক এবং শান্তিপূর্ণ সমাজ ব্যবস্থার জন্য যেসব জনগণ লড়ছেন তাদের প্রতি আমাদের সমর্থন রইলো। বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের লক্ষ্য করে সহিংসতা, অত্যাচার এবং ভীতি প্রদর্শন অবলিম্বে বন্ধ করার জোর দাবি জানাচ্ছি।

বিবৃতিতে বাংলাদেশ সরকারের কাছে চারটি সুপারিশ তুলে  ধরা হয়েছে। সুপারিশগুলো হলো- বিবৃতিতে বাংলাদেশ সরকারের কাছে চারটি সুপারিশ তুলে  ধরা হয়েছে। সুপারিশগুলো হলো- 

১. প্রতিবাদকারীদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে সহিংসতা বন্ধ করতে হবে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা, শান্তিপূর্ণ সমাবেশের স্বাধীনতা, জীবন, নিজের স্বাধীনতা এবং ব্যক্তি মর্যাদা যেন সম্মান জানানো হয় এবং সুরক্ষিত রাখা হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। 

২. অবিলম্বে এবং নিঃশর্তভাবে সব রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমূলক মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। বেআইনী আটক অধিকারকর্মী এবং বিরোধীদলীয় সদস্যদের মুক্তি দিতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে সুষ্ঠু এবং স্বচ্ছ বিচারিক প্রক্রিয়া। 

৩. ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের পূর্ণাঙ্গ এবং পক্ষপাতহীন তদন্ত করতে হবে। বিশেষ করে মৃত্যু এবং নির্যাতনের অভিযোগগুলো তদন্ত করতে হবে।

৪. আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে উপাত্ত সুরক্ষা আইনের খসড়াকে পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে।

বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা এবং মৌলিক অধিকারের সুরক্ষায় কাজ করে যাবার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহবান জানিয়েছে এই ছয় মানবাধিকার সংস্থা।