আইএমএফ’র বিশেষ সংবাদ সম্মেলনে রাহুল আনন্দ

ঋণের টাকা ছাড় দিলেও দুর্নীতি, মুদ্রাপাচার ও সুশাসনে নজর রাখছে আইএমএফ

ঋণের টাকা ছাড় দিলেও দুর্নীতি, মুদ্রাপাচার ও সুশাসনে নজর রাখছে আইএমএফ

মুশফিকুল ফজল আনসারী

চলমান অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় দ্বিতীয় কিস্তিতে বাংলাদেশকে ঋণের টাকা ছাড় দিয়েছে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ)। শর্তারোপ করে ঋণের টাকা ছাড় দেওয়া হলেও দুর্নীতি, মুদ্রাপাচার এবং সুশাসনের বিষয়ে নজরদারি রেখেছে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।

শুক্রবার সকালে আইএমএফ’র এশীয় ও প্যাসিফিক বিভাগের আয়োজিত এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিক মুশফিকুল ফজল আনসারীর করা এক প্রশ্নের জবাবে এ মন্তব্য করেন আইএমএফের এশীয় ও প্যাসিফিক বিভাগের প্রধান রাহুল আনন্দ।

সংবাদ সম্মেলনে স্বাগত ও সমাপনী বক্তব্য দেন রাহুল আনন্দ। এর আগে বাংলাদেশের ওপর কান্ট্রি রিপোর্ট প্রকাশ করে সংস্থাটি। রিপোর্টে বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও করণীয় নিয়ে পর্যালোচনা রয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে বিভিন্ন প্রশ্নেরও জবাব দেন রাহুল আনন্দ।

সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে বিশেষজ্ঞদের আশংকার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে মুশফিক জানতে চান, একতরফা নির্বাচন আয়োজনের মুহূর্তে বাংলাদেশ সরকারকে আইএমএফ’র এই ২য় কিস্তির ঋণ ছাড় দেওয়াটা চলমান স্বৈরশাসনকে ইন্ধন যুগাবে এবং রাজনৈতিক সংকটকে আরও ঘনীভূত করে তুলবে বলে আশংকা করছেন বিশ্লেষকরা। আপনাদের মূল্যায়নই বলে দিচ্ছে নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে শর্ত পূরণে ব্যর্থ হয়েছে সরকার আর এ অবস্থায় ছাড় দিলে ভবিষ্যতে শর্ত পূরণের প্রতিশ্রুতির বিষয়টি অনিশ্চিত থেকে যায়। এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কী?

প্রতিবেদকের এই প্রশ্নের জবাবে আইএমএফ মিশন প্রধান বলেন, কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিষয়ে আইএমএফ সরাসরি কোনো মন্তব্য করবেনা। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও করছেনা।

আইএমএফ’র রিপোর্টে বলা হয়েছে, জানুয়ারিতে বাংলাদেশের নির্বাচন অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা বাড়াতে পারে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির বড় বাধা দুর্নীতি উল্লেখ করে এই প্রতিবেদক জানতে চান, বাংলাদেশে দূর্নীতি এবং মুদ্রাপাচার সবচেয়ে বড় সমস্যা। ক্ষমতাসীন সরকারের তরফে এই দুই ক্ষেত্রেই পৃষ্ঠপোষকতা করা হয় মর্মে অভিযোগ রয়েছে। গত দেড় দশকের বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৬১ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে বলে এক রিপোর্টে জানিয়েছে গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি, যা প্রায় ২০১৬-১৭ সালের জিডিপির ২৫ শতাংশ। এ বিষয়গুলো কী আইএম এফ নজর দিচ্ছে?

জবাবে রাহুল আনন্দ বলেন, আমরা দূর্নীতি এবং মুদ্রা পাচারের উপর নজর দিচ্ছি। বিষয়টি স্যতিই দেশের অর্থনীতির জন্য অশুভ। আমাদের অংশীজনদের সাথে আমরা মুদ্রা পাচারের বিষয়টি পরিস্কার অবস্থান তুলে ধরেছি। আপনি বাংলাদেশ ব্যংকের রিপোর্ট ঘটালেও এ বিষয়ে আমাদের অবস্থান জানতে পারবেন। সুশাসন, দূর্নীতি ও মুদ্রাপাচার রোধে আমাদের পদক্ষেপ আরও বেগবান হবে।

বাংলাদেশকে প্রবৃদ্ধি সহায়ক সংস্কারে মনোনিবেশ করার পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ। এজন্য কঠোর আর্থিক নীতিমালা প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন রাহুল আনন্দ। তিনি বলেন, একই সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার চাপ কমাতে আরও নমনীয় বিনিময় হার ব্যবস্থা প্রয়োজন।

বাংলাদেশ সরকারকে তিনটি বিষয়ে জোর দিতে বলেছে সংস্থাটি।

প্রথমত, কর রাজস্ব বৃদ্ধি এবং অগ্রাধিকার নয় এমন খাতের ব্যয়কে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা হবে গুরুত্বপূর্ণ। এর ফলে কর্তৃপক্ষ সামাজিক উন্নয়নে বিনিয়োগ এবং জলবায়ু খাতে ব্যয় বৃদ্ধি করতে পারবে কর্তৃপক্ষ। সরকারি অর্থনৈতিক এবং বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনাকে অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি করতে হবে দক্ষতা বৃদ্ধি এবং আর্থিক ঝুঁকি হ্রাসের ক্ষেত্রে।

দ্বিতীয়ত, মুদ্রানীতির কাঠামো আধুনিকায়ন করে এবং আর্থিক নীতি উন্নত করে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে উৎসাহিত করা যাবে। বিনিময় হার আধুনিকায়ন করার জন্য আরও সংস্কার করতে হবে। তাতে শক্তিশালী হবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। এর ফলে বাহ্যিক স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি পাবে।

তৃতীয়ত, ব্যাংকিং খাত নিয়ন্ত্রণ শক্তিশালী করতে, নজরদারি করতে এবং সুশাসনের অধীনে আনতে এখাতের ঝুঁকিগুলোর সংস্কার কর্মকাণ্ডে অগ্রাধিকার দিতে হবে। প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যকে সমর্থন করতে বেসরকারি আর্থিক খাতকে গতিশীল করতে হবে।

রাহুল আনন্দ বলেন, আইএমএফ এক্সিকিউটিভ বোর্ড তার আইএমএফ সমর্থিত প্রোগ্রামের প্রথম রিভিউ এবং আর্টিক্যাল ৪ নিয়ে আলোচনা শেষ করেছে ১২ই ডিসেম্বর। এক্সটেন্ডেড ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি হিসেবে দ্বিতীয় কিস্তির প্রায় ৪৬ কোটি ৮৩ লাখ ডলার ছাড় দেয়ার অনুমোদন দিয়েছে বোর্ড। সব মিলে এখন পর্যন্ত ছাড় দেয়া অর্থের পরিমাণ দাঁড়াবে ৯৩ কোটি ৬৬ লাখ ডলার।

আইএমএফ’র নির্বাহী পর্ষদের সভায় ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের অনুমোদনের পর গত মঙ্গলবার বাংলাদেশের অনুকূলে ৬৮ কোটি ৯৮ লাখ ডলার ছাড়ের প্রস্তাবে অনুমোদন দেয় সংস্থাটির পর্ষদ। স্থানীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকার মতো।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় আইএমএফ গত জানুয়ারিতে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ অনুমোদন করে। গত ফেব্রুয়ারির শুরুতেই প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬৩ লাখ ডলার ছাড় হয়। ৭ কিস্তিতে ৪২ মাসে পুরো ঋণ পাওয়ার কথা রয়েছে। বর্ধিত ঋণ সহায়তা (ইসিএফ), বর্ধিত তহবিল সহায়তা (ইএফএফ) ও রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি ফ্যাসিলিটি (আরএসএফ) এ ৩টি ভাগে ঋণ দিচ্ছে আইএমএফ।

সংবাদ সম্মেলনে আইএমএফ প্রধান বলেছেন, সরকার সামষ্টিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। যেমন বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রানীতি কঠোর করেছে, মুদ্রা বিনিময় হার নমনীয় করার অনুমতি দিয়েছে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের প্রচেষ্টা সন্তোষজনকই এবং আইএমএফের ঋণ কর্মসূচির বেশির ভাগ লক্ষ্যমাত্রা ও সংস্কারের প্রতিশ্রুতি বাংলাদেশ পূরণ করেছে।

ভালো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য বেসরকারি খাতের মাধ্যমে পুঁজিবাজারকে গভীর করার পরামর্শ দেন রাহুল আনন্দ।

বাংলাদেশ গত জুন শেষে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংরক্ষণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি। আইএমএফের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে যে অব্যাহতি চেয়েছিল বাংলাদেশ, সংস্থাটি তা অনুমোদন করেছে। চলতি ডিসেম্বর শেষে রিজার্ভ সংরক্ষণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে নতুন করে। আইএমএফ বলেছে, ডিসেম্বর শেষে নিট রিজার্ভ থাকার কথা ছিল ২৬ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। এখন তা ১৭ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার অন্তত থাকা উচিত।

আইএমএফ জানায়, গত অক্টোবরে দেশের নিট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ১৫ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার, আর মোট রিজার্ভ ছিল ২০ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার। আর জুনে ২৩ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও নিট রিজার্ভ ছিল ১৯ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার।

এমআর/