গণতন্ত্র হরণ এবং একতরফা নির্বাচন নিয়ে দ্য ডিপ্লোম্যাটকে যা বললেন তারেক রহমান

গণতন্ত্র হরণ এবং একতরফা নির্বাচন নিয়ে দ্য ডিপ্লোম্যাটকে যা বললেন তারেক রহমান

নির্বাচনের ফলাফল আগেই ঠিক করে রেখেছে সরকার। আর তাই ৭ জানুয়ারির এই পাতানো নির্বাচনে বাংলাদেশের প্রধান বিরোধীদল বিএনপি অংশগ্রহণ করবেনা বলে জানিয়েছেন দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।

বিএনপি কেন নির্বাচনে যাচ্ছেনা এ প্রসঙ্গে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে দ্য ডিপ্লোম্যাটকে এই মন্তব্য করেন তারেক রহমান।স্নিগধেন্দু ভট্টাচার্যকে দেয়া সাক্ষাৎকারে শুধু নির্বাচন বয়কট নয় বরং সরকার পতনের একদফা দাবির আন্দোলন, বিএনপি নেতা-কর্মীদের ওপর সরকারের অকথ্য নির্যাতন, দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, বিএনপির কৌশল এবং সুষ্ঠু নির্বাচন ইস্যুতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের অবস্থান, নানান বিষয় নিয়ে এই বিশেষ সাক্ষাৎকারে কথা বলেছেন বিএনপি প্রধান তারেক রহমান।

জাস্ট নিউজ পাঠকদের জন্য দ্য ডিপ্লোম্যাটকে দেয়া বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সাক্ষাৎকারের অনুবাদটি তুলে ধরা হলো। সাক্ষাৎকারটি অনুবাদ করেছেন সাংবাদিক তাশফিন চৌধুরী।

ডিপ্লোম্যাট: ২০২৪ সালের নির্বাচন বয়কটের সিদ্ধান্তে বিএনপি অনঢ় অবস্থানে কেন?

তারেক রহমান: ৭ জানুয়ারির তথাকথিত নির্বাচন শুধু বিএনপি বয়কট করেছে বিষয়টা এমন না। বিএনপির বাইরে গণতন্ত্রের পক্ষের আরও ৬২ টি দল এই নির্বাচন বয়কট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বাংলাদেশের জনগণের প্রত্যাশা পূরণে আমাদের যে প্রতিশ্রুতি সেই জায়গা থেকে আমরা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমরা একটি অর্থবহ নির্বাচন চাই যেখানে জনগণ অংশগ্রহণ করার সুযোগ পাবে, সেখানে তারা স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারবে আর তাদের ভোট সত্যিকার অর্থে গণনা করা হবে। 

নির্বাচনে নানান কায়দায় কারচুপি আর অনিয়ম করে শেখ হাসিনা প্রহসনের নির্বাচনের যে কলঙ্কিত ইতিহাস তৈরি করেছেন পুরো বিশ্ব এখন এটা জেনে গেছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে কোনো ধরনের প্রতিদ্বিন্দ্বতা ছাড়া ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৪ টি আসনে জয় লাভ করেছে আওয়ামী লীগ। আর ২০১৮ সালে নির্বাচনের আগের রাতেই ব্যালট বক্স ভর্তি করে গণতন্ত্রের উপহাস তৈরি করেছে।

নির্বাচনের আগেই অংশগ্রহণকারি দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতা করে ফলাফল কী হবে তা আগেই নির্ধারিত করে নিয়েছে আওয়ামী লীগ। ২০২৪ সালে আরেকটি প্রতারণার নির্বাচনের আয়োজন করতে যাচ্ছে দলটি। যে দলগুলো নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে তারা আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক মিত্র হিসেবে পরিচিত তাদের ব্যাপারে জনগণের কোনো আস্থা নেই। এই মিত্র দলগুলোর মধ্যে শুধুমাত্র জাতীয় পার্টির কিছুটা জনসমর্থন রয়েছে। কিন্তু দলের একটি বৈঠকে জাতীয় পার্টির তৃণমূল নেতারা নির্বাচন বয়কট এবং আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটে না থাকার জোর দাবি জানিয়েছিলো। এর জের ধরেই সরকারের লোকেরা দলটির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে দেখা করে এবং তাদের বাধ্য করে নির্বাচনে অংশ নিতে।

শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের নির্দেশ দিয়ে রেখেছেন তারা যেন মাঠ পর্যায়ে নিজেদের ডামি প্রার্থী প্রস্তুত রাখে। এটার লক্ষ্য এমন না যে ডামি প্রার্থীরা নির্বাচনে জেতার সুযোগ পাবে বরং তাদের দিয়ে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যাটা বেশী করে দেখানো। রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে বিএনপিতে ভাঙন ধরানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে শেখ হাসিনা। এছাড়া বিভিন্ন দল থেকে বহিষ্কার করা নেতাদের দিয়ে বেশ কিছু কিংস পার্টি গঠন করেছেন তিনি যার উদ্দেশ্য হলো অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের একটা বানোয়াট পরিবেশ তৈরি করে দেখানাে। এটা প্রচার করা যে নির্বাচনে হাজার হাজার প্রার্থী রয়েছে। আসন বন্টন নিয়ে আওয়ামী লীগের মধ্যে অস্থিরতা বিরাজ করছে, যেমন প্রার্থীতা প্রত্যাহারের শেষ দিনে জাকের পাটির ২০০ এর বেশী প্রার্থী তাদের প্রার্থীতা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। অন্যান্য ছোট দলগুলোর প্রাথীরাও তাদের প্রার্থীতা প্রত্যাহার করতে চেয়েছিলো কিন্তু গোয়েন্দা সংস্থার বাধার কারণে সেটা করতে পারেনি।

শেখ হাসিনার অধীনে অনুষ্ঠিত কম গুরুত্বপূর্ণ উপ-নিবার্চনগুলোর দিকে খেয়াল করলে দেখতে পাই যে, রাষ্ট্রযন্ত্রের সহযোগিতা নিয়ে আওয়ামী লীগের কর্মীরা দীর্ঘ দিনের ভোট জালিয়াতির সেই অপকৌশল প্রয়োগ করে ব্যাপক মাত্রায় ভোট কারচুপি অব্যাহত রেখেছিলো। প্রতিটি নির্বাচনে বিরোধীদলের এজেন্টদের বের করে দেওয়া হয়েছে, প্রকাশ্য ত্রুটিপূর্ণ ভোটার তালিকা তৈরি করা হয়েছে, জাল ভোট দেওয়া এবং জাল ভোট দিয়ে ব্যালট বাক্স ভর্তি করা হয়েছে। গত মাসেই ভোট জালিয়াতির নতুন এক রেকর্ড আমরা প্রত্যক্ষ করলাম। আওয়ামী লীগের এক এজেন্ট মাত্র ৫৭ সেকেন্ডে ৪৩ ব্যালট পেপারে নৌকা প্রতীকে জাল সিল মেরেছে। এটা খুব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে শেখ হাসিনা যতদিন ক্ষমতায় থাকবে ততদিন বাংলাদেশের প্রতিটি নির্বাচনে ব্যাপক মাত্রায় ভোট কারচুপির ঘটনা ঘটবে। এছাড়া তার অধীনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের কথা ভাবাটা দূরাশা মাত্র।

নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে এই ফ্যাসিস্ট সরকার সারাদেশে বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের ওপর আক্রমণের মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে। এর লক্ষ্য একটাই যাতে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কোনো পরিবেশ দেশে বিরাজমান না থাকে। জেলখানাগুলোতে ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত বন্দি আটকে রাখা হয়েছে, এছাড়া এখনো বানোয়াট মামলায় বেআইনীভাবে গ্রেফতার অব্যাহত রয়েছে, এর বাইরে গুম, বিচারবর্হিভূত হত্যাকান্ড এবং নিষ্ঠুর কায়দায় নির্যাতনসহ গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে। এটা এখন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, অরাজনৈতিক, নিরপেক্ষ এবং নির্বাচনকালীন একটি সরকারের অধীনেই একটি অংশগ্রহণমূলক, বিশ্বাসযোগ্য এবং স্বচ্ছ নির্বাচন আয়োজন এবং ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনা সম্ভব। আর এরকমের সরকারই বাংলাদেশের জনগণের ম্যান্ডেট পাবে।

ডিপ্লোম্যাট: কয়েক সপ্তাহ পর নতুন সরকার ক্ষমতায় বসলে বিএনপির আন্দোলন কী গতি হারিয়ে ফেলবেনা?

তারেক রহমান: শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে ক্ষমতায় বসার পর থেকে এখন পর্যন্ত ২,৬৮৭ জন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক বিচারবর্হিভূত হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছে এবং অন্তত ৬৭৫ জন গুম হয়েছে। বিএনপিসহ অন্যান্য গণতান্ত্রিক দলগুলোর ৫০ লাখ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ১,৩৮,৫০০ এর বেশী রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা দায়ের করা হয়েছে। ২৮ অক্টোবরে বিএনপির মহাসমাবেশের পর থেকে এখন পর্যন্ত ২২,০০০ এর বেশী নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। জেলখানাগুলোতে ধারণক্ষমতার ২.৫ গুণের বেশী বন্দি আটক রাখা হয়েছে। তারপরও রাজনৈতিক কর্মীদের আটকের উন্মত্ততা অব্যাহত রয়েছে। এই সরকারের অবর্ণনীয় নির্যাতন আর অবিচার সহ্য করতে হয়েছে বিএনপিকে। জাতির গণতান্ত্রিক মূলনীতিগুলোকে টিকিয়ে রাখতে এটা হচ্ছে আমাদের দেয়া প্রতিশ্রুতির প্রমাণ। যে ক্ষমতা প্রকৃত অর্থে জনগণের সেই ক্ষমতাকে অন্যায়ভাবে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। সেটাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসা প্রধান বিরোধীদল হিসেবে আমাদের দায়িত্ব। কথিত নির্বাচন হয়ে গেলো কীনা অথবা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় ফিরে এলো কীনা সেটা বিষয় না। তবে বিএনপিকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন দিয়ে জনগণ ঐক্যবদ্ধ থাকবে। বৃহৎপরিসরের কথা ভেবে আমাদের আন্দোলনে হয়তো কৌশলগত পরিবর্তন হতে পারে কিন্তু চলমান এই আন্দোলন অব্যাহত থাকবে এবং সেটা তীব্রতর হবে।

সর্বশেষ বিএনপির ১৬ ডিসেম্বরের র‌্যালিতে হাজার হাজার গণতন্ত্রের পক্ষের লোক অংশগ্রহণ করেছে। রাষ্ট্রীয় মদদপুষ্ট সহিংসতার বিরুদ্ধে এটা আমাদের সক্ষমতার প্রমাণ জানান দিয়েছে। একইসঙ্গে এটাও প্রমাণ হয়েছে জনগণকে সম্পৃক্ত করে আন্দোলন অব্যাহত রাখতে সক্ষম বিএনপি। বিগত কয়েক বছরে সারা বাংলাদেশে আমরা বড় বড় সমাবেশ করেছি যেখানে লাখো লাখো মানুষ জমায়েত হয়েছে। এই সমাবেশগুলোতে যত মানুষ জমায়েত হয়েছে তা দেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন।

ডিপ্লোম্যাট: অবাধ এবং সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের জন্য আওয়ামী লীগ সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের ওপর চাপ অব্যাহত রয়েছে। বিএনপি কী এটা ধারণা করে নিয়েছে যে এই চাপে কোনো কাজ হবেনা?

তারেক রহমান: আপনার প্রশ্নের ভিতরেই এটার উত্তর লুকিয়ে রয়েছে। প্রশ্নটাই বলে দিচ্ছে যে অবাধ এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের কোনো অনুকূল পরিবেশ নেই এবং এটি আমাদের চলমান আন্দোলনের নৈতিক এবং বৈধ অবস্থানকে আরও জোরালো করছে। সর্বশেষ কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, 'নির্বাচনে আসার শর্তে একরাতে সব নেতাকে জেল থেকে মুক্তি দেয়ার প্রস্তাবেও রাজি হয়নি বিএনপি।' সরকারের পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই বিএনপি নেতাদের জেলে আটকে রাখা হয়েছে বলে তিনি দাবি করেছেন। তার এই বক্তব্যই বলে দিচ্ছে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় আওয়ামী লীগ কীভাবে রাজনৈতিকভাবে গ্রেফতার এবং বিচারিক প্রক্রিয়ায় হয়রানি করছে। দলীয় অনুগতদের বিচার বিভাগ, পুলিশ, প্রশাসন  এবং সেনাবাহিনীসহ রাষ্ট্রীয় সব প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দিয়েছেন শেখ হাসিনা। এছাড়া তার অবৈধ আদেশ না মানলে কী পরিণতি হবে সে হুমকিও তিনি প্রকাশ্যে দিয়ে রেখেছেন। তিনি এসকল প্রতিষ্ঠানকে ভিন্নমত দমন এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের ওপর নিজের প্রতিহিংসা দমনে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন। 

বিরোধীদলের ব্যাপক ধরপাকড়ে কোনো বাধা দিচ্ছেনা নির্বাচন কমিশন, ভুয়া রাজনৈতিক দল এবং নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের বৈধতা দেওয়া আরও প্রমাণ করে যে নির্বাচনী প্রক্রিয়াটা পরিচালিত হচ্ছে আপোসের মাধ্যমে। সম্প্রতি নির্বাচনী প্রচারণা ছাড়া রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়কে নির্বাচন কমিশন যে নির্দেশনা দিয়েছে সেটি মেনে নেওয়া যায়না। সরকারিভাবে সমাবেশ এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করার যে নির্দেশ সেটি শুধু অনৈতিক, অবৈধ এবং অসাংবিধানিকই নয় বরং এটি নির্বাচন কমিশনের ওপর শেখ হাসিনার নিয়ন্ত্রণ এবং অবৈধ হস্তক্ষেপের নগ্ন বহিঃপ্রকাশের প্রমাণ।

ডিপ্লোম্যাট: ২০১৪ সালে বিএনপি নির্বাচন বয়কট করার পর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনো টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়নি। বিএনপি কীভাবে প্রত্যাশা করছে যে তাদের এ নির্বাচন বয়কটের কারণে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এই সরকারের অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়বে?

তারেক রহমান: বাংলাদেশ কার্যত একটি দুর্নীতিবাজ একদলীয় সরকারের শাসনে চলছে। দেশের ভিতরে ধনকুবেররা এবং দেশের বাইরে স্বৈরশাসকেরা এই সরকারকে মদদ দিয়ে যাচ্ছে। শেখ হাসিনা গণতান্ত্রিক দেশগুলোকে শুধু যে প্রতিশোধমূলক হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন তাই নয় বরং দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও বিতর্কিত ভূমিকা রাখছেন। আর এর মাধ্যমে ক্রমেই গণতান্ত্রিক বিশ্ব থেকে একঘরে হয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। গণতান্ত্রিক নীতির প্রতি আন্তর্জাতিক আহবানকে তিনি অবমাননা করছেন এবং আন্তর্জাতিক নিয়ম-নীতিকে তিনি তোয়াক্কা করছেননা।

গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার গণতান্ত্রিক দেশগুলোর মধ্যে সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করে। একইভাবে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্য অর্জনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং বাংলাদেশের জনগণের প্রত্যাশা এক বিন্দুতে এসে মিলিত হয়েছে। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সমর্থনে যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, বৃটেন, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জাপান এবং বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থাসহ বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অংশীদার সংস্থাসমূহ এবং উন্নয়ন সহযোগি দেশগুলো যেভাবে গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে নৈতিক সমর্থন দিয়ে উৎসাহ যুগিয়ে যাচ্ছে সেজন্য তাদের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ। র‍্যাবের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা, ভিসা নীতি এবং বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের জন্য আহবানসহ কূটনৈতিক যতগুলো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে সেগুলোকে সাধুবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশের জনগণ। সবগুলো পদক্ষেপ গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

ডিপ্লোম্যাট: শেখ হাসিনা আবার ক্ষমতায় ফিরে আসলে বিএনপির পরবর্তী পরিকল্পনা কেমন হবে? এই নির্বাচন বয়কটের কারণে ভোটারদের সঙ্গে বিএনপির কী দূরত্ব তৈরি হবেনা?

তারেক রহমান: মোটেও না। কারণ ভোটাররা ইতিমধ্যে এই নির্বাচনকে প্রত্যাখান করেছে। জনগণের প্রত্যাশার ওপর ভিত্তি করেই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে বিএনপি। আর এই সিদ্ধান্তে একটি কার্যকর নির্বাচন অনুষ্ঠানে দল এবং জনগণের সম্মিলিত আকাঙ্খার প্রতিফলন রয়েছে। আসল কথা হচ্ছে, আমি মনে করি ফ্যাসিজমের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়ে আওয়ামী লীগ  আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এর যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। পোশাক কারখানার শ্রমিক থেকে নোবেল বিজয়ী, সাংবাদিক থেকে সুশীল সমাজ, ছাত্র থেকে পেশাজীবি-- সমাজের প্রত্যেকটি স্তরের মানুষেরা মৌলিক অধিকার এবং স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বিএনপি শেখ হাসিনার পদত্যাগের যে দাবি জানাচ্ছে তার সঙ্গে বাংলাদেশের অধিকাংশ জনগণের ঐক্যমত রয়েছে।  ৩১ দফার রাষ্ট্র মেরামতের রুপরেখা, ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজিসহ যেকোনো নীতি নির্ধারণে আমাদের দল জনস্বার্থকে গুরুত্ব দেয়। 

আমার কথা হলো এই যে পাতানো নির্বাচন এর কারণে শুধু যে রাজনৈতিক দলগুলো অংশগ্রহণ করতে পারছেনা তা নয় বরং একই অবস্থা ভোটারদের ক্ষেত্রেও। তারা ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। শেখ হাসিনার অধীনে অনুষ্ঠিত বিগত ২ নির্বাচনে  ৩ কোটি নতুন ভোটারসহ প্রায় ১২ কোটি ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পায়নি। এই বঞ্চিত ভোটাররা এবং বিএনপি ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার একই লক্ষ্য নিয়ে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। ধর্ম, জাতিগত সংখ্যা লঘু সম্প্রদায়, লিঙ্গ এবং রাজনীতি নির্বিশেষে সব বাংলাদেশির স্বাধীনতা, সাম্য এবং সমৃদ্ধি নিশ্চিতে একই লক্ষ্যে একে অপরের সঙ্গে একতাবদ্ধভাবে কাজ করে যাচ্ছি।

ডিপ্লোম্যাট: আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন যে, সাংগঠনিক দুর্বলতা কারণে বিএনপি নির্বাচন বয়কট করছে। দলের অনেক নেতা কারাগারে এবং অনেকেই আত্মগোপনে রয়েছেন, বিএনপির নির্বাচন বয়কট করার পেছনে কী এটাই কারণ হিসেবে কাজ করছে?

তারেক রহমান: আমরা যদি সংখ্যার কথা বলি তাহলে বলতে হয় কর্মী, সমর্থক এবং দলীয় প্রার্থী-- এসবগুলো ক্ষেত্রে বিএনপি বাংলাদেশের সবচাইতে বড় এবং জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল। সাংগঠনিক শক্তি দিয়ে মোকাবিলা করে ব্যর্থ হয়ে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রযন্ত্রের অপব্যবহার করছে, তৃণমূল থেকে শুরু করে বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ে আমাদের সকল জনশক্তিকে ফাঁদে ফেলে নৃশংস কর্মকান্ড পরিচালনা করছে। বিএনপির জনসমর্থন দেখে ভয় পেয়ে এবং জনগণ থেকে আওয়ামী লীগের বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার বিষয়টি অনুধাবন করতে পেরে শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন সরকার এমন এক পরিবেশ তৈরি করেছে যাতে করে বিএনপি তাদের তথাকথিত নির্বাচনে অংশ নিতে না পারে। 

আইনের অপব্যবহার করার জন্য গণহারে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের ২ বছরের বেশী কারাদন্ড দেওয়া হচ্ছে। এটার লক্ষ্য হচ্ছে ২ বছরের সাজাপ্রাপ্ত প্রার্থীরা নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য অযোগ্য হয়ে পড়বেন। মিথ্যা অভিযোগ এনে পক্ষপাতদুষ্ট বিচার করা হচ্ছে। এসব অভিযোগের ক্ষেত্রে প্রায়ই দেখা যায় সরকার নিজেরাই অগ্নি হামলার ঘটনা ঘটাচ্ছে এবং বানোয়াট কাহিনী তৈরি করছে। কারাগারে আটক বন্দিদের সঙ্গে যে আচরণ করা হচ্ছে তা গভীরভাবে উদ্বেগজনক এবং একইসঙ্গে কারাহেফাজতে মৃত্যুর সংখ্য বাড়ছে। আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা এবং পুলিশ যৌথভাবে বাড়িতে হামলা করছে, অভিযান চালাচ্ছে, এছাড়াও বন্ধুক হামলা, ছুরিকাঘাত এবং ককটেল বোমা ফাটিয়ে হামলা করছে। আর এসব হামলার কারণে আমাদের লাখ লাখ নেতাকর্মীকে ঘর থেকে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। টার্গেটকৃত ব্যক্তিদের খুঁজে না পেলে তাদের আত্মীয়-স্বজনদের আটকে করে নির্যাতন করে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা এবং পুলিশ। এরকম অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে।

ডিপ্লোম্যাট: আওয়ামী লীগ নেতারা অভিযোগ করেছেন যে, বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে ২০০৬-২০০৮ সালের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অবমূল্যায়ন করেছিলো। এবিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?

তারেক রহমান: ১৯৯৬ সালে বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে সংবিধানে নির্বাচনকালীন, নিরপেক্ষ এবং নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থা যুক্ত করা হয়েছিল, যেটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নামে পরিচিত। অবাধ, সুষ্ঠু এবং বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য এই সরকার ব্যবস্থা সকল রাজনৈতিক দলের সমঝোতায় প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিলো এবং এতে জনগণের ম্যান্ডেট ছিলো। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে জনগণের আকঙ্খাকে উপেক্ষা করে অবৈধভাবে ক্ষমতা আঁকড়ে বসে থাকতে সংবিধান থেকে এই সরকার ব্যবস্থাকে স্বৈরতান্ত্রিকভাবে বাতিল করে দেয়। 

সুপ্রিম কোর্টে অ্যাপিলেট ডিভিশনের নিয়োগ দেওয়া অ্যামিকাস কিউরিসহ স্বনামধন্য আইনজীবিরা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহালের পক্ষে নিজেদের মত দিয়েছেন। রাজনৈতিক দলসমূহ, অবসরপ্রাপ্ত বিচারক, আইন বিশেষজ্ঞ, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি এবং পত্রিকার সম্পাদকদের সঙ্গে এই সরকার ব্যবস্থা নিয়ে তাদের পরামর্শ চেয়েছিলো একটি সংসদীয় কমিটি। সবাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। এই ব্যবস্থা চালু রাখার পক্ষে সবার মত থাকা সত্ত্বেও শেখ হাসিনা অংশীদারদের এই মতামত এবং জনগণের ম্যান্ডেটকে স্বীকৃতি দেবার বিষয়টি প্রত্যাখান করেন। তিনি সংসদীয় কমিটিকে নির্দেশ দিলেন তড়িঘড়ি করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে বাতিল করে দিতে।

ডিপ্লোম্যাট: বিএনপির সঙ্গে ইসলামিক দলগুলোর জোট নিয়ে ভারত উদ্বিগ্ন, বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোটের বিষয়টি। বিএনপি সরকারের শাসনামলে পাকিস্তানের সঙ্গে ঘনিষ্টতা লক্ষ্য করা গেছে এবং তারা ভারতের নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়গুলোতে আন্তরিক ছিলেননা। এ বিষয়ে আপনি কী বলবেন?

তারেক রহমান: বৃহৎ দল হিসেবে বিএনপি মনে করে ধর্ম প্রত্যেকের ব্যক্তিগত বিষয় কিন্তু রাষ্ট্রটা সকলের। এছাড়া সব মানুষের এই দেশে প্রতিটি নাগরিকের সমান অধিকার রয়েছে। আমাদের নীতি হচ্ছে ধর্মকে আমরা রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করবোনা। কিন্তু কথা হচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত এবং পাকিস্তান-- এই তিন দেশের সংবিধানে ধর্মের ভিত্তিতে রাজনীতি করার অধিকার দেয়া হয়েছে। আর তাই এই তিন দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল রয়েছে। 

ধরে নিলাম শুধুমাত্র জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে ভারতের উদ্বেগ রয়েছে। এক্ষেত্রে এবিষয়টা লক্ষ্য করা খুব গুরুত্বপূর্ণ যে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে আওয়ামী লীগের সুসম্পর্কের ইতিহাস রয়েছে। ১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ এবং জামায়াতে ইসলামী যুগপৎভাবে তৎকালীন  পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে; ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশে স্বৈরাচার এরশাদের শাসনকে বৈধতা দিতে এই দুই দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিলো; এবং ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত এই দুই দল গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে একসঙ্গে আন্দোলনে নেমেছিলো। কথা হচ্ছে জামায়াতে ইসলামী যখন আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট বাধে তখন সেটা কী কোনো সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায় না? একইভাবে বলা যায়, বিএনপির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামী যদি নির্বাচনী কোন জোট হয় তাহলে সেটা কী কোনো সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে? 

অন্যদিকে, ইসলামী মতবাদ যদি ভারতের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে থাকে তাহলে তো এটা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ২০০৬ সালে বাংলাদেশে ইসলামী ঐক্যজোটের সঙ্গে ইসলামী শরীয়াহভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের জন্য লিখিত চুক্তি করেছিলো আওয়ামী লীগ। শেখ হাসিনা তার দলের শীর্ষ পর্যায়ে চরম ইসলামপন্থীদের জায়গা করে দিয়েছেন যারা দলটিতে নিজেদের প্রাধান্য বিস্তার করছেন। অতিসম্প্রতি একেএম বাহাউদ্দিন নামের আওয়ামী লীগের এক প্রভাবশালী নেতা হিন্দুদের বলে দিয়েছেন কীভাবে দুর্গা পূজা পালন করতে হবে। এটা নিয়ে সমালোচনা হবার পরও তিনি কোনো দুঃখ প্রকাশ করেননি। উল্টো স্থানীয় হিন্দুরা যখন এই নেতার বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে প্রতিবাদ করেছিলো তখন তার সমর্থকরা প্রতিবাদকারীদের ওপর হামলা করে। হিন্দু নেতারা সতর্ক করার পরও আওয়ামী লীগের এই নেতাকে ডামি ইলেকশনের জন্য আবারো মনোনয়ন দিয়েছে দলটি। 

সন্ত্রাস, বিচ্ছিন্নতাবাদ এবং চরমপন্থা মোকাবিলার মতো বিষয়গুলো ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটিজিতে আমরা জোর দিয়েছি। আমরা এ বিষয়টি নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যে বাংলাদেশের সীমানা এমন কোনো কাজে ব্যবহার করতে দেওয়া হবেনা যাতে করে অন্য যেকোনো রাষ্ট্রের নিরাপত্তা এবং স্বার্থের জন্য তা ক্ষতিকর হয়।

ডিপ্লোম্যাট: ১৫ বছর ধরে দেশের বাইর রয়েছেন আপনি। বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টাসহ বিভিন্ন মামলায় আপনার বিরুদ্ধে কারাদন্ড দেওয়া হয়েছে। সরকার চেষ্টা করছে আপনাকে দেশে ফিরত নিয়ে সাজা বাস্তবায়ন করতে। বাংলাদেশের আদালত আপনার বক্তব্য টিভিতে প্রচার কিংবা গণমাধ্যমে প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, এমনকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও বক্তব্য প্রচারে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপির সমর্থকদের কতটা নেতৃত্ব দিতে পারবেন বলে আপনি আশা করেন?

তারেক রহমান: শেখ হাসিনার সঙ্গে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার বিরোধের জেরে হঠাৎ করেই তাকে দেশ থেকে জোর করে বের করে দেওয়া হয়। এঘটনাই প্রমাণ করে দেশে বিচার বিভাগের কোনো স্বাধীনতা নেই এবং একইসঙ্গে এটাও প্রমাণিত হয়েছে যে কীভাবে বাইরে থেকে নির্দেশ দিয়ে রায় কী হবে তা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। আরেকটি ঘটনার কথা বলি, শেখ হাসিনার হুমকি উপেক্ষা করে অবিশ্বাস্যরকমের সাহসিকতার সঙ্গে বানোয়াট মামলার রায়ে বিচারক মো. মোতাহার হোসেন আমাকে নির্দোষ হিসেবে খালাস দেন। এ রায় দেওয়ার কারণে তাকে দেশ থেকে পালাতে হয়েছে এবং বিদেশে আশ্রয় নিতে হয়েছে। আমি মনে করি এই সরকার বিচারকদের কাছে একটা বার্তা স্পষ্ট করে দিয়েছে, আর তা হলো: বিচারকের চাকুরি টিকিয়ে রাখতে হলে অবশ্যই তাদের নির্দেশমত সাজানো রায় ঘোষণা করতে হবে। 

বিচার ব্যবস্থায় অবিচারকে যারা ত্বরাণ্বিত করেছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একজন হলেন আবদুল কাহার আকন্দ। শেখ হাসিনার নির্দেশে তিনি অনেক সাজানো মামলায় তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। আপনি যে মামলাটির কথা উল্লেখ করে বলেছেন সেই মামলায় এই তদন্ত কর্মকর্তা আমার নাম চার্জশীটভুক্ত করেছে ঘটনার সাত বছর পর। এই মামলায় তিনি আমার বিরুদ্ধে ভুয়া প্রমাণ দাঁড় করিয়েছেন যার আসলে কোনো অস্তিত্ব নেই। অবসর নেবার পর এবার এই কর্মকর্তা আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী হিসেবে ডামি নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য কিশোরগঞ্জ-২ আসনের মনোনয়ন পেয়েছেন। আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সরকারি কর্মকর্তাদের এই সম্পৃক্ততাকে আমি দেখি তাদের দলীয় আনুগত্য এবং পুরস্কার-- এই দুটোর প্রতিফলন হিসেবে। এটা বিরক্তিকর।

হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার শুধু যে আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করেছে এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করেছে তা নয় বরং আমার স্ত্রীর বিরুদ্ধে বানোয়াট মামলা দায়ের করেছে যার রাজনীতির সঙ্গে কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা নেই। শেখ হাসিনা বাংলাদেশে আমাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেছে এবং যে বাড়িতে আমরা তিন দশকেরও বেশী সময় বসবাস করেছি সেই বাড়ি থেকে আমার মা এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে জোর করে বের করে দিয়েছে। জীবনের এই পর্যায়ে এসেও তাকে পর্যাপ্ত চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে যেটা কষ্টদায়ক। আমার পরিবার এবং আমি গণতন্ত্রের জন্য ত্যাগ স্বীকার করে যাচ্ছি কিন্তু বাংলাদেশের লাখ লাখ পরিবার যে কষ্ট স্বীকার করে চলছে তা আমাদের প্রেরণা যুগাচ্ছে।

বিদেশে নির্বাসনে থাকলেও আমার মন পড়ে রয়েছে দেশের মাটিতে, বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে আমার গভীর যোগাযোগ রয়েছে। একটা উল্লেখযোগ্য সময় ব্যয় করছি সারাদেশে নেতাকর্মীদের সঙ্গে ফোন কল এবং অনলাইন মিটিং করে। যেসব নেতাকর্মীরা জেল থেকে মুক্তি পাচ্ছেন তাদের দিকে যখন তাকাই তখন দেখতে পাই তাদের নির্ভীক এবং দৃঢ় মনোবল। গণতান্ত্রিক আদর্শের জন্য নিজেদের জীবনের মায়া উপেক্ষা করে কারামুক্তির পরদিনই তাদের দেখা যায় হয় রাজপথের বিক্ষোভে নতুবা জনসমাবেশে। এই সাহস এবং উৎসাহে আমি অনুপ্রাণিত হই। গণতন্ত্রের পক্ষের জনগণের এই আপোসহীন মনোভাবকে আমি সমর্থন করি। আমার পুরো শক্তি দিয়ে চেষ্টা করছি সব পক্ষকে একতাবদ্ধ করতে এবং তৃণমূলকে গতিশীল ও তাদের মনোবলকে দৃঢ় করতে। আমাদের সবার আকাঙ্খা হচ্ছে আবারো মুক্ত জাতি হিসেবে বেঁচে থাকা। যে জাতি বিশ্বাস করে গণতন্ত্রের জন্য ত্যাগ স্বীকার করতে হয় সেটার গুরুত্ব অপরিসীম। কষ্ট আর প্রতিবন্ধকতার চ্যালেঞ্জিং রাজনৈতিক যাত্রার মুখোমুখি হয়েও এ ত্যাগ স্বীকার করতে হয়।

এমআর/