যুক্তরাজ্যে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামানের প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার সাম্রাজ্য

যুক্তরাজ্যে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামানের প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার সাম্রাজ্য

উত্তর-পশ্চিম লন্ডনের ব্যক্তিগত আবাসিক রাস্তায় একটি সম্পত্তি ২০২২ সালে ১ কোটি ৩৮ লাখ ডলারে (১৫২ কোটি টাকায়) বিক্রি হয়। রিজেন্টস পার্ক এবং লর্ডস ক্রিকেট গ্রাউন্ড থেকে পাথর ছোড়া দূরত্বে যুক্তরাজ্যের রাজধানীর সবচেয়ে সমৃদ্ধ এলাকাগুলোর একটিতে সাদা টাউনহাউসের সারি। একটি সম্পত্তি বিপণন কোম্পানির আলোকচিত্রে দেখা যায়, এর মেঝে থেকে সিলিং পর্যন্ত জানালা, বেশ কয়েকটি ফ্লোরজুড়ে সর্পিল সিঁড়ি, রয়েছে থিয়েটার এবং ব্যায়ামাগার।

সম্পত্তি প্ল্যাটফর্মের হিসাবে বর্তমানে বাড়িটির দাম ১৮০ কোটি টাকারও (১.৩ কোটি পাউন্ড) বেশি। বাড়িটি বাংলাদেশের সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদের মালিকানাধীন।

অথচ বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী দেশটির কোনো নাগরিক, বাসিন্দা এবং সরকারি কর্মচারী বছরে ১২ হাজার ডলারের (১৩ লাখ ১৭ হাজার টাকার) বেশি অর্থ দেশের বাইরে নিতে পারেন না। বাংলাদেশের আইনে করপোরেশনের বিদেশে তহবিল স্থানান্তরেও নানা বিধিনিষেধ রয়েছে। শুধু কিছু শর্ত পূরণ সাপেক্ষে অনুমতি দেওয়া হয়।

সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ গত জানুয়ারি পর্যন্ত পাঁচ বছর ভূমিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৬ সাল থেকে তাঁর মালিকানাধীন কোম্পানি প্রায় ২০ কোটি ব্রিটিশ পাউন্ড (২৭৭০ কোটি টাকা) মূল্যের ৩৫০টিরও বেশি সম্পত্তি কিনে যুক্তরাজ্যে রিয়েল এস্টেট সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে। যুক্তরাজ্যের কোম্পানি হাউস করপোরেট অ্যাকাউন্ট, বন্ধকি চার্জ এবং এইচএম ল্যান্ড রেজিস্ট্রি লেনদেনের ওপর ভিত্তি করে এ পরিসংখ্যান পেয়েছে বার্তা সংস্থা ব্লুমবার্গ।

রোববার ব্লুমবার্গের প্রায় আড়াই হাজার শব্দের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, মধ্য লন্ডনের বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট থেকে শুরু করে ইংল্যান্ডে বাংলাদেশি সম্প্রদায়ের বৃহত্তম আবাস টাওয়ার হ্যামলেটস এবং লিভারপুলে ছাত্রদের আবাসন পর্যন্ত বিস্তৃত তাঁর সাম্রাজ্য। জাভেদের প্রায় ২৫০টি সম্পত্তি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রায় ৯০ শতাংশ নতুন অবস্থায় কেনা হয়।

গত ২৮ ডিসেম্বর যুক্তরাজ্যে জাভেদের সম্পত্তি নিয়ে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে দৈনিক সমকাল। তখন তা দেশজুড়ে আলোচিত হয়। এর আগে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ জানিয়েছিল যুক্তরাজ্যে একজন মন্ত্রীর প্রায় ২৭০০ কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে। তবে সংস্থাটি তখন তার নাম প্রকাশ করেনি। পরে সমকালের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে জাভেদের নাম।

এ লেনদেনগুলো এমন সময়ে ঘটেছিল যখন যুক্তরাজ্য সরকার বিদেশিদের সম্পত্তির মালিকানা অর্জনকে আরও স্বচ্ছ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কারণ রাশিয়ান অলিগার্করা সহজে যুক্তরাজ্যে সম্পদ কিনে গোপন রাখতে সক্ষম হয়েছিল। দুর্নীতিবিরোধী প্রচারকারীদের মতে, জাভেদের এই সাম্রাজ্য অর্জনে রাজনীতিবিদদের এ ধরনের সম্পত্তি কেনা যাচাই করার জন্য যুক্তরাজ্যের আইন কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন পুনরুজ্জীবিত হতে পারে।

মিউনিসিপ্যাল ​​সম্পত্তির রেকর্ড অনুসারে, ব্লুমবার্গ ম্যানহাটানে জাভেদের অন্তত পাঁচটি সম্পত্তি চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছে। ২০১৮ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ৬০ লাখ ডলার বা ৬৬ কোটি টাকায় এগুলো কেনা হয়।

দৃশ্যত এই কেলেঙ্কারির কারণে জাভেদ এবার এমপি হিসেবে পুনর্নির্বাচিত হলেও মন্ত্রিসভায় স্থান পাননি। তবে তিনি ভূমি মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি হয়েছেন।

গত ডিসেম্বরে নির্বাচনী হলফনামায় জাভেদ তাঁর মোট সম্পদ দেখান মাত্র ২৫.৮৩ কোটি টাকার। তার স্ত্রী রুখমিলা জামানের সম্পদ দেখানো হয় মাত্র ১১ কোটি টাকার। জাভেদ বাংলাদেশে সম্পদের ঘোষণায় তাঁর যুক্তরাজ্যের সম্পত্তির বিষয় অন্তর্ভুক্ত করেননি।

বাংলাদেশের মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেসবাউল হক ব্লুমবার্গকে বলেছেন, ‘বাংলাদেশে বসবাসকারী কোনো ব্যক্তির জন্য বিদেশে সম্পদ কেনার বিধান নেই। সাধারণ নিয়ম হিসেবে আমরা কোনো ব্যক্তিকে এটি করার অনুমতি দিই না।’

তবে জাভেদ বা তার স্ত্রী– কেউই বাংলাদেশের বাইরে তাদের সম্পত্তির মালিকানা বিষয়ে মন্তব্য করার জন্য অনুরোধের জবাব দেননি।

জাভেদ যুক্তরাজ্যের মানি লন্ডারিং আইনের আওতায় ‘রাজনৈতিকভাবে উন্মোচিত ব্যক্তি’ বিভাগে নজরদারির আওতায় রয়েছেন। এ ধরনের ব্যক্তিরা সম্পত্তি কেনার মতো ব্যবসায়িক লেনদেনে জড়িত থাকলে তারা অতিরিক্ত যাচাই-বাছাইয়ের মুখোমুখি হন।

ব্লুমবার্গ জাভেদের মালিকানাধীন কোম্পানির জন্য সম্পত্তি কেনায় জড়িত আর্থিক পরিষেবা এবং আইনি প্রতিষ্ঠানসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে। তাদের কেউ কেউ বলেছেন, তারা সংশ্লিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন। অন্যরা আবার বাণিজ্যিক গোপনীয়তার অজুহাত দেখিয়ে মন্তব্য করতে চাননি।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল জানায়, ২০১৬ সাল থেকে যুক্তরাজ্যে সম্পত্তি কেনায় ৬৭০ কোটি পাউন্ড মূল্যের ‘সন্দেহজনক তহবিল’ চিহ্নিত করেছে।

জাবেদ তাঁর প্রয়াত পিতা আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর ইন্তেকালের পর ২০১৩ সালে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। এক বছর পর তিনি ভূমি প্রতিমন্ত্রী নিযুক্ত হন। ২০১৪ সালে ভূমি প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি খালি হাতে এসেছি এবং আমি খালি হাতে চলে যাব।’ ২০১৯ সালে তিনি ভূমিমন্ত্রী হন।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতির ধারণা সূচকে ১৮০টি দেশ ও অঞ্চলের মধ্যে বাংলাদেশের স্থান ১৪৯তম। অতি সম্প্রতি দেশটির রিজার্ভ ব্যাপকভাবে কমেছে। এ জন্য দায়ী কোভিড-১৯ মহামারি এবং মুদ্রাস্ফীতি। তবে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের গবেষণায় বলা হয়েছে, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনাও রিজার্ভকে মারাত্মকভাবে গ্রাস করেছে। শুধু যুক্তরাজ্যে জাভেদের রিয়েল এস্টেট সম্পদ বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের অন্তত ১%।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল ইউকের প্রধান তদন্তকারী বেন কাউডক বলেছেন, ‘যখন উচ্চ দুর্নীতির ঝুঁকিপূর্ণ দেশের রাজনীতিবিদরা তাদের সম্পদের সরকারি উৎসের চেয়ে অনেক বেশি খরচ করেন, তখন এই লেনদেনে জড়িত যুক্তরাজ্যের পেশাদারদের জন্য প্রধান লাল পতাকা হওয়া উচিত। এই মামলার দিকে তাকিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে, যে কোনো রাষ্ট্রীয় সংস্থা, আইনজীবী বা আর্থিক সংস্থাগুলো এ ক্ষেত্রে সতর্ক সংকেত বাজিয়েছে কিনা। আর বাজিয়ে থাকলে কেউ কি তাতে সাড়া দিয়েছেন?’

আটটি কোম্পানির মাধ্যমে জাভেদ এবং তার স্ত্রী রুখমিলা তাদের সব রিয়েল এস্টেট কিনেছেন। তারা দু’জনই এসব কোম্পানির পরিচালক এবং মালিক হিসেবে তালিকাভুক্ত। এই আটটি কোম্পানি এবং সহায়ক সংস্থাগুলো যুক্তরাজ্যে ৩৫০টিরও বেশি সম্পত্তি সংগ্রহ করেছে।

জাভেদ দম্পতির ১৭৫টিরও বেশি সম্পত্তি কেনায় ঋণের ব্যবস্থা করেছেন একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পরেশ রাজা। তিনি এ বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকার করেন।

এই দম্পতির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রসঙ্গে যুক্তরাজ্যের পেশাদারদের নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান সলিসিটর রেগুলেটরি অথরিটির প্রধান নির্বাহী পল ফিলিপ এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘আমরা মানি লন্ডারিং প্রবিধানের সম্ভাব্য লঙ্ঘনের বিষয়টিকে খুব গুরুত্ব সহকারে নিই। আমরা যদি দেখতে পাই যে, সংস্থাগুলো এই বাধ্যবাধকতা পূরণ করছে না, তবে আমরা ব্যবস্থা নেব।’-দৈনিক সমকাল