বাংলাদেশ নিয়ে কী হিসাবের নতুন খাতা খুলতে যাচ্ছে ওয়াশিংটন?

বাংলাদেশ নিয়ে কী হিসাবের নতুন খাতা খুলতে যাচ্ছে ওয়াশিংটন? Bangladeshi Prime Minister Sheikh Hasina. Photo: Russell Watkins/Department for International Development

মুশফিকুল ফজল আনসারী

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে গত বছর ওয়াশিংটনে লাল গালিচা সংবর্ধনা দেবার আগেই দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের স্ট্র্যাটেজিকস কমিউনিকেশনস কোঅর্ডিনেটর জন কিরবি বলেছিলেন, "বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নিয়ে সেদেশের সরকারই কথা বলুক। কিন্তু আমাদের প্রত্যাশার কথা আমরা স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছি যে, যুক্তরাষ্ট্র চায় বাংলাদেশে একটি অবাধ এবং সুষ্ঠু নির্বাচন।"

সরাসরি এই কথার অর্থ ধরতে গেলে হয়তো খারাপ শুনাবে কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র কোনো রাখঢাক না করেই বাংলাদেশে গণতন্ত্রের জন্য তাদের সমর্থনের কথা বলে যাচ্ছে। সত্যি কথা বলতে গেলে, গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠার সর্বোচ্চ  গুরুত্ব দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি আবর্তিত হয়েছে এবং তার অংশ হিসেবে বাইডেন প্রশাসন নিজেদের পরিকল্পনার একদম কেন্দ্রবিন্দুতে রেখেছিলো বাংলাদেশ ইস্যুকে।

ডামি নির্বাচন

জানুয়ারির ৭ তারিখ যে নির্বাচন হয়ে গেলো জনগণ সে নির্বাচনের নাম দিয়েছে 'ডামি নির্বাচন'। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগকে সেই নির্বাচনে কারো সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয়নি। নির্বাচনটি বাংলাদেশের জনগণকে এক দলীয় স্বৈরশাসন ব্যবস্থার দিকে ঠেলে দিলো। এই নির্বাচনের এক মাস পর হাসিনা সরকারের শীর্ষ কূটনীতিক মাসুদ বিন মোমনের কাছে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের লেখা একটি চিঠি হস্তগত করা হয়। হাসিনাকে উদ্দেশ্য করে লেখা এই চিঠিতে বলা হয়েছে, 'যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী।' এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই যে চিঠি পাঠানো হলো, এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র কী বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য যে অবস্থান নিয়েছিলো সেটা থেকে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেলো? এটার বাস্তব উত্তর মনে হতে পারে, হ্যাঁ।

প্রহসনের এই নির্বাচনের পরও যখন দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্র গহণ করেনি সেকারণে কেউ কেউ মনে মনে করতেই পারেন বাংলাদেশে গণতন্ত্রের প্রসারে যুক্তরাষ্ট্র যে অবস্থান নিয়েছিলো তা থেকে দেশটি সরে গেছে। হাসিনাকে পাঠানো হোয়াইট হাউসের চিঠিই এই বিশ্বাসকে গ্রহণযোগ্যতা দিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপ

নির্বাচনের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত, বিগত আড়াই বছরে দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটিতে যাতে একটি অবাধ এবং বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় সে জন্য একের পর এক বিবৃতি আর চোখে পড়ার মতো বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে যুক্তরাষ্ট্র।

যুক্তরাষ্ট্র উল্লেখ করার মতো পদক্ষেপগুলোর যাত্রা শুরু করে গুম, নির্যাতন এবং বিচারবর্হিভূত হত্যাকান্ডের মতো চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে কুখ্যাত আধা সামরিক বাহিনী র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়নের (র‍্যাব) ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের মাধ্যমে। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবার বেশ আগেই যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিংকেন ঘোষণা দেন যে, গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়া খর্বের সঙ্গে জড়িত যেকোনো বাংলাদেশি নাগরিকের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে যুক্তরাষ্ট্র।

ভিসা নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি কীরকম সেটা স্পষ্ট করতে বাংলাদেশের একটি  বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের টকশোতে হাজির হয়ে এ নিয়ে কথা বলেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। অন্যদিকে স্টেট ডিপার্টমেন্ট এবং জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের মুখপাত্ররা বারবার যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান পুর্নব্যক্ত করে বলেছেন, দেশটি চায় বাংলাদেশে একটি বিশ্বাসযোগ্য এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন।

একই সময়ে দেখা গেলো যে হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের মন্ত্রীরা ইঙ্গিতে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র গণতান্ত্রিক নির্বাচনের জন্য যে চাপ দিচ্ছে সেটাকে পাশ কাটাতে ভারত তাদের সহযোগিতা করবে। এটাও ধারণা করা হচ্ছিলো যে ওয়াশিংটন যেনো নয়া দিল্লির প্রতিবেশিদের বিষয়ে, বিশেষ করে বাংলাদেশ, যেনো নাক না গলায় তার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে বাগে আনতে সক্ষম হবে। নয়া দিল্লিতে টু প্লাস টু সামিটের পরপরই ঢাকায় একটি চিঠি পাঠান ডোনাল্ড লু। চিঠিতে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সব দলকে সংলাপে বসার আহ্বান জানানো হয়। নির্বাচন অবাধ এবং সুষ্ঠু হবে কীনা সেই বল হাসিনার কোর্টে, এই উদ্যেগ তাকে নিতে হবে- চিঠির মাধ্যমে সেটা স্পষ্ট হয়ে উঠে। অনেকেই ধারণা করেছিলেন যে, ডোনাল্ড লুর এই চিঠি এবং ঘোষিত থ্রি সি ভিসা নিষেধাজ্ঞার পর ঢাকা যদি সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন না করে তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের অসন্তোষের মুখোমুখি হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের এতো পদক্ষেপের পরও ডামি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে আর শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসাবে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের কাছ থেকে চিঠি পেয়েছেন যাতে লেখা রয়েছে 'একসঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী।'

স্পষ্টতই যে নির্বাচনে জনগণের আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটেনি, হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার যেখানে গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে খর্ব করেছে সেখানে দৃশ্যত কোনো ধরনের পদক্ষেপ নেয়নি যুক্তরাষ্ট্র। পররাষ্ট্রনীতি বিশেষজ্ঞ শ্রীরাধা দত্ত তার এক পর্যবেক্ষণে বলেছেন বাংলাদেশের ১০ শতাংশ মানুষ নির্বাচনে ভোট দিয়েছে।

গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন

অবাধ এবং সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের এতো সময় ধরে ঢোল পিটানো এবং নির্বাচনের পর হাত গুটিয়ে বসে থাকায় সাধারণ মানুষ এবং অভিজ্ঞ রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মধ্যে এই প্রশ্নের গুঞ্জন উঠেছে যে, হাসিনার দিল্লির 'ডার্লিং চাইল্ড' হবার কারণে ভারতের প্ররোচণায় গণতন্ত্র প্রসারের নীতি থেকে যুক্তরাষ্ট্র কী পিছু হটেছে? যুক্তিসংগত এই প্রশ্নের স্পষ্ট একটা ধারণা পেতে হলে পাঠকদের সঙ্গত কিছু কারণে আরও কয়েক মাস অপেক্ষা করতে হবে।

বর্তমান সময়টাতে নীতি নির্ধারণী বিষয় নিয়ে দর কষাকষির জন্য যে সময়ের দরকার ওয়াশিংটনের সে সময়টা খেয়ে বসেছে মধ্যপ্রাচ্যের চলমান বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহ। দ্বিতীয়ত, গণতন্ত্র খর্ব করা এবং দক্ষিণ এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ বিঘ্নিত করার দায়ে যুক্তরাষ্ট্র যদি হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারকে শায়েস্তা করতে চায় তাহলে ওয়াশিংটনকে এই অঞ্চলের পরিস্থিতিকে নতুন করে পুনমূল্যায়ন করতে হবে।

উল্লেখ্য, প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মাধ্যমে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের অভিষেক হবার পর শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানানো থেকে বিরত থেকেছে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার প্রধান মিত্র দেশগুলো। ঠিক একইভাবে হোয়াইট হাউস এবং স্টেট ডিপার্টমেন্টের পোডিয়ামগুলো থেকে একটি বার্তারই প্রতিধ্বনি হচ্ছে। সে বার্তা হলো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ফিরে যাবার বার্তা।

গত ৫ ফেব্রুয়ারি থ্রি সি ভিসা নিষেধাজ্ঞা নিয়ে করা আমার এক প্রশ্নের জবাবে স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রধান উপ মুখপাত্র ভেদান্ত প্যাটেল বলেন, "নির্বাচন শেষ হয়ে গেছে মানে এটা নয় যে ভিসা নিষেধাজ্ঞা নীতির সূর্য ডুবে গেছে।"

ভারত, চীন এবং যুক্তরাষ্ট্র এই তিন দেশের মধ্যে কোন দেশটি ঢাকায় নিজেদের মাঠ দখলে রাখতে পেরেছে সেটা নিয়ে নতুন করে একটা পর্যালোচনার প্রয়োজন রয়েছে। বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের যে নিষ্ক্রিয়তা দেখা যাচ্ছে সেটাকে এভাবে ধরে নেওয়া যায় যে, এখানে 'কম শক্তি খাটানো হচ্ছে' কারণ মধ্যপ্রাচ্য এবং আগামী নভেম্বর মাসের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য 'বেশী শক্তি খাটানো হচ্ছে।'

ভারতের সংকট

দক্ষিণ এশিয়ায় নীতি নির্ধারণী বিষয়ে ওয়াশিংটন খুব বেশী মনযোগ না দিতে পারলেও কৌশলগত গুরুত্বের কারণে এটাও সম্ভব নয় যে তারা নৌকার বৈঠা উঠিয়ে শুধু শুধু বসে থাকবে। রাখাইন প্রদেশে কিয়াউকফুতে চীন গুরুত্বপূর্ণ যে গভীর সমুদ্র বন্দরটি পুর্ননির্মাণ করছে তা দেশটিকে এই অঞ্চলের প্রতিযোগিতায় এগিয়ে রাখছে। ৭০ শতাংশ মালিকানার মাধ্যমে কার্যত বন্দরটির দখল নিয়েছে চীন। এই বন্দরের কাছেই বিএনএস শেখ হাসিনা নৌ ঘাঁটি পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছে দেশটি। আর এর মাধ্যমে এ অঞ্চলে নিরাপদে সাবমেরিন এবং যুদ্ধ জাহাজ নিয়ে সমুদ্র বন্দরে নোঙ্গর করতে পারবে চীন। এই বিষয়গুলো ঢাকার চাইতেও চীন, রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের কাছে কৌশলগত কারণে গুরুত্বপূর্ণ। এদিকে, দক্ষিণ এশিয়ায় ওয়াশিংটনের বিশ্বস্ত মিত্র হবার পরও বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি তাদের জন্য অপ্রত্যাশিত এক ধরনের অস্বস্তি এনে দিয়েছে। অন্যদিকে, বিরোধীদলসমূহের হাজার হাজার নেতা-কর্মী জেলে বন্দি থাকা অবস্থায় দলগুলো তাদের পরবর্তী কর্মসূচি নিয়ে ভাবছে, মালদ্বীপের 'ইন্ডিয়া আউট' ক্যাম্পেইনের আদলে বাংলাদেশে 'বয়কট ইন্ডিয়া' ক্যাম্পেইন শুরু হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে। এই বয়কটের ডাক কতটা প্রভাব ফেলবে সেটা নিশ্চিত না হলেও বিষয়টা এতদূর পর্যন্ত গড়িয়েছে যে, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্করকে প্রশ্ন শুনতে হচ্ছে যে, ভারত কী তার প্রতিবেশী নীতিতে ব্যর্থ হচ্ছে?

যদিও ২০১৪ সালের নির্বাচনের মতো এবারের নির্বাচনে শেখ হাসিনার বিজয় নিশ্চিত করতে ঢাকায় নিজেদের পররাষ্ট্র সচিবকে পাঠায়নি দিল্লি তবে নির্বাচনে ভারতের হস্তক্ষেপের বিষয়টি দৃশ্যমান। প্রতিবেশি ভারতের প্রতি এদেশের জনমত সন্তুষ্ট নয়। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অধঃপতন যা-ইহোক না কেন, সেই পতনের সহায়ক হিসেবে ভারতকে দায়ী করা অমূলক নয়। ফলে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র বা চীনের কর্মকাণ্ড কিংবা নিষ্ক্রিয়তা, এর খেসারত কিন্তু দিল্লিকেই দিতে হবে।

দ্য ওয়্যারে প্রকাশিত সাউথ এশিয়া পার্সপেক্টিভস এর নির্বাহী সম্পাদক মুশফিকুল ফজল আনসারীর লেখা এই বিশ্লেষণটি জাস্ট নিউজের পাঠকদের জন্য অনুবাদ করেছেন সাংবাদিক তাশফিন চৌধুরী