চাপের মুখে বাংলাদেশ ব্যাংক

১০ হাজার কোটি টাকা বের করে নিলেন ব্যাংক মালিকরা

১০ হাজার কোটি টাকা বের করে নিলেন ব্যাংক মালিকরা

ঢাকা, ২ এপ্রিল (জাস্ট নিউজ) : চাপের মুখে ১০ হাজার কোটি টাকা বের করে নিচ্ছেন ব্যাংকের মালিকরা। এসব টাকা সাধারণ মানুষের আমানত। নিরাপত্তার স্বার্থে বাংলাদেশ ব্যাংকে রাখা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংককে এক ধরনের জিম্মি করে বের করে নিচ্ছে বিধিবদ্ধ নগদ জমার হার (সিআরআর) থেকে ১ শতাংশ অর্থ।

রবিবার দুপুরে রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে এক জরুরি সভায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। অপর এক সিদ্ধান্তে যেসব ব্যাংক অতিরিক্ত ঋণ বিতরণ করেছে, তা সমন্বয়ে তাদের ডিসেম্বরের পরিবর্তে আরো তিন মাস সময় বাড়ানো হয়েছে।

এদিকে সিআরআর ১ শতাংশ কমিয়ে আনার সিদ্ধান্তে তীব্র বিরোধিতা করেছেন ব্যাংকার, অর্থনীতিবিদ, বিশ্লেষক ও সুশীলসমাজের সদস্যরা। তারা বলেন, এতে ঝুঁকিতে পড়বেন আমানতকারীরা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের কোমর ভেঙে যাবে। তারা মনে করেন, এভাবে একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ব্যাংক সেক্টরকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

এছাড়া রবিবারের এ বৈঠকে সরকারি আমানতের ৫০ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে রাখার বিষয়ে এর আগে নেয়া প্রস্তাবটি চূড়ান্ত করা হয়। ব্যাংক বিশ্লেষকদের অনেকে গণমাধ্যমের কাছে দেয়া প্রতিক্রিয়ায় এর বিরোধিতা করলেও অর্থমন্ত্রী তা আমলে নেননি।

জানা গেছে, সরকারি আমানতের অর্ধেক পাওয়ার পর বেসরকারি ব্যাংকগুলো আরো বড় ধরনের নিয়ন্ত্রণমূলক ছাড় পেয়েছে। এখন থেকে ব্যাংকগুলোর আমানতের ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকে যে নগদ টাকা জমা রাখা (সিআরআর) হয়, সেখান থেকেও ১ শতাংশ কম রাখতে পারবে। অর্থাৎ বর্তমানে ব্যাংকগুলো সাড়ে ৬ শতাংশ টাকা নগদ জমা রাখে। এ হিসাবে তা কমে আসবে সাড়ে ৫ শতাংশে। এর ফলে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর জমা রাখা সাড়ে ৬ শতাংশ থেকে ১ শতাংশ সমপরিমাণ প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা তুলে নেবে।

সভা শেষে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সাংবাদিকদের বলেন, বেসরকারি ব্যাংকে ৫০ শতাংশ সরকারি আমানত রাখার ব্যাপারে যে সিদ্ধান্ত দিয়েছি তা বহাল থাকবে। সরকারি টাকার অর্ধেক বেসরকারি ব্যাংকে রাখা যাবে। অন্য সুবিধা (সিআরআর) আমি দিতে পারি না। ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রক গভর্নর। আমি শুধু প্রভাবিত করতে পারি। এছাড়া এ নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। ব্যাংকগুলোকে সাড়ে ৬ শতাংশ নগদ জমা রাখতে (সিআরআর) হয়, তা ১ শতাংশ কমানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। এটি অবশ্য জুনের মধ্যে রিভিউ হবে, যা সালমানের (সালমান এফ রহমান) আইডিয়া।

এ সময় একজন সিনিয়র সাংবাদিক অর্থমন্ত্রীর কাছে জানতে চান, এতগুলো টাকা বাজারে এলে মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব পড়বে কিনা। এ প্রশ্ন শুনেই তিনি তার স্বভাবজাত ভঙ্গিতে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং সাফ জানিয়ে দেন- এতে মূল্যস্ফীতিতে কোনো প্রভাব পড়বে না। অপর এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, হ্যাঁ সুদের হার শিগগিরই সিঙ্গেল ডিজিটে নেমে আসবে।

তবে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে কবে নাগাদ আনা হবে তা স্পষ্ট করেননি। উল্টো তিনি সাংবাদিকদের বলেন, বর্তমানে যে সুদহার রয়েছে তা দিয়ে ব্যবসা করা সম্ভব নয়।

এদিকে সিআরআর ১ শতাংশ কমিয়ে আনার বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, ব্যাংক মালিকদের সামনে এভাবে গভর্নরকে বসানো একটি অবাঞ্ছিত কাজ। পাকিস্তান আমল থেকে এখন পর্যন্ত এটি প্রথম ঘটনা। তিনি বলেন, এভাবে গভর্নরকে ব্যাংক মালিকদের মুখোমুখি করলে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোমর ভেঙে যাবে। এ সংস্কৃতি চালু হওয়া নিয়ে আমরা অত্যন্ত শঙ্কিত।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, যে প্রক্রিয়ায় টাকা বের করা হল, তা মোটেও ঠিক হয়নি। বিএবি নেতা, অর্থমন্ত্রী এবং গভর্নর মিলে এভাবে টাকা নিতে পারেন না। এ টাকা দেয়া হবে কি হবে না সেটা খতিয়ে দেখার দায়িত্ব ছিল গভর্নরের। কিন্তু তাকে প্রভাবিত করতে পারেন না অর্থমন্ত্রী। এটা নজিরবিহীন।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, পুরো ব্যাংকিং খাতের স্বাস্থ্য খারাপ। এরপরও একের পর এক সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। আসলে এসব সিদ্ধান্ত কার স্বার্থে নিচ্ছেন অর্থমন্ত্রী। তিনি কি গুটিকয় ব্যাংক মালিকের স্বার্থ দেখবেন নাকি করদাতা কোটি কোটি আমানতকারীর স্বার্থ দেখবেন। সেটা এখন ভেবে দেখার বিষয়।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, জনগণের আমানতে হাত দেয়ার আগে তাদের সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত ছিল। তাদের অনুমতি ছাড়া এভাবে টাকা নেয়া ঠিক হচ্ছে না। এছাড়া বিষয়টি নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গেও আলাপ করা দরকার ছিল।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, উদ্দেশ্য অর্জন হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। অর্থাৎ ব্যাংক ঋণের সুদহার কমানো এবং তারল্য সংকট মেটানো। সব ব্যাংকে তারল্য সংকট নেই। যারা নিয়মের বাইরে গেছে তাদের তারল্য সংকট। মূলত খেলাপি ঋণের উচ্চ হার, বেপরোয়া ঋণ বিতরণের কারণে এমনটি হয়েছে। এখন তাদের আমানত দিয়ে উৎসাহিত করা হচ্ছে।

ব্যাংক উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন দাবি নিয়ে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ছাড়াও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির, ডেপুটি গভর্নর এসএম মুনিরুজ্জামান, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উপদেষ্টা এসকে সুর চৌধুরী, বিএবির চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার, আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার বেসরকারি খাত উন্নয়নবিষয়ক উপদেষ্টা ও আইএফআইসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান, প্রিমিয়ার ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য এইচবিএম ইকবাল, অর্থ মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব মো. ইউনুসুর রহমান, ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন (এবিবি) চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহবুবুর রহমান, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আনিস এ খান, আইএফআইসি ব্যাংকের এমডি শাহ এ সারওয়ারসহ আর্থিক খাতের শীর্ষ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

সভা শেষে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের কোনো সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়নি। বর্তমান সরকারের চলতি মেয়াদে ব্যাংক খাতের সংকট মেটাতে আর্থিক খাতের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠকের ঘটনা এটাই প্রথম। এর আগে শুক্রবার রাতে বিএবি কার্যালয়েও এক সভা হয়। তবে সেখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কেউ উপস্থিত ছিলেন না।

বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ সরকারের আর্থিক খাতের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে শুক্রবার রাতে অর্থমন্ত্রী সভা করেন। সেখানে ব্যাংক উদ্যোক্তাদের চাপে ব্যাংকের অর্থ সংকট মেটাতে সরকারি তহবিলের ৫০ শতাংশ অর্থ বেসরকারি ব্যাংকে রাখা যাবে বলে সিদ্ধান্ত হয়। বিদ্যমান নিয়মে সরকারি তহবিলের ২৫ শতাংশ পর্যন্ত অর্থ বেসরকারি ব্যাংকে রাখা যায়।

(জাস্ট নিউজ/এমআই/১০৩৪ঘ.)